ডাডাবাদের সূচনা: বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল ছিল ১৯১৪ থেকে ১৯১৮। ১৯১৬ সালে সুইজারল্যান্ডের জুরিকে শরণার্থীরা আশ্রয় নেয়। তাদের মধ্যে বিভিন্ন কোভিদ সাহিত্যিকেরাও ছিলেন। তাদের মধ্যে রুমিনিয়ো কবি ত্রিস্টান জারা,হানস আপ এবং আরো দুজন জার্মান শিল্পী নিরঙ্কুশ স্বাধীনতার দূতক শব্দের সন্ধানে খুঁজে নেন একেবারে নিরর্থক Dada শব্দটি।
“ডাডা” শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে মতভেদ আছে। “ডাডা” শব্দের উদ্ভবও রুমানিয় ভাষার সঙ্গে জড়িত। দুজন রুমানিয় শিল্পী ট্রিসটান জারা ও মার্সেল জানকো- এরা প্রায়ই ‘ডা’, ‘ডা’ করতেন। রুমানিয় ভাষায় ‘ডা” হচ্ছে: ঠিক। ইংরেজি ইয়ে ইয়ে বা হ্যাঁ হ্যাঁ।
কারও কারও মতে অবশ্য ডাডাবাদের উদক্তোরা জুরিখের সেই ক্যাফেতে বসে নতুন শিল্প আন্দোলনের জন্য যুৎসই একটি নাম খুঁজছিল। কার হাতে ছিল একটি ফরাসি-জার্মান অভিধান।সেখানেই ডাডা শব্দটি ছিল। ফরাসি ভাষায় ডাড়া মানে খেলনা ঘোড়া। . ‘ডাডাইজম’র নামকরণের প্রেক্ষিত পর্যালোচনায় Hulsenbeck তাঁর এক অভিযোজিত ও নিরীক্ষ্যমাণ বহুল আলোচিত নিবন্ধে (প্রকাশ কাল ১৯২০) তাঁর স্বগত উচ্চারণ:
“The word ‘Dada’ accidentally discovered by Hugo Ball Richard and myself in a German-French dictionary is French for a wooden horse. It is impressive in its brevity and suggestiveness.”
এভাবেই সুইজারল্যান্ডের জুরিখের একটি কাফেতে ডাডাবাদের সূচনা হল; যা ১৯১৬ থেকে ১৯২২ সাল অবধি তুঙ্গে ছিল।
১৯১৬ সালের অক্টোবরে জুরিখের কাভারেট ভলতেয়ার ক্যাফেতে সমমনা শিল্পী, সাহিত্যিকরা আলোচনার মাধ্যমে ডাডাইজমের সূচনা ঘটান। এ আলোচনায় অংশ নেন হুগো বেল, মার্সেল জ্যাঙ্কো, হার্নস রিচটার, জ্যঁ আপ, ট্রিস্টান জারা, রিচার্ড হিউলসেনব্যাক, সোফি টিম্বার প্রমুখ। জুরিখের সঙ্গে সঙ্গে এর ঢেউ নিউইয়র্কে গিয়েও পৌঁছে ছিল।মূলত যুদ্ধ বিরোধী আর প্রচলিত শিল্পধারনার বিমূখ এই শিল্প আন্দোলনটি তৎকালীন শিল্পসাহিত্য কবিতা শিল্পতত্ত্ব মঞ্চ গ্রাফিক ডিজাইন-প্রভৃতি শিল্পমাধ্যমে ছাপিয়ে যায়।
ডাডাবাদের বিকাশ: ডাডাবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষিত সমকালে – উল্লিখিত কবি ও শিল্পী সমন্বয়ে একটি ক্লাব গঠন করা হয়। নাম দেয়া হয় ‘ভল্টেয়ার ক্যাবারে’। উদ্দেশ্য হলো সাহিত্য ও শিল্পের প্রচল আদর্শকে আক্রমণ করে বক্তব্য দেয়া। তাঁদের উচ্চারিত বক্তব্যের বাণী ছিলো এরূপ “যা কিছু স্থির – অনুদ্বেগ, সুস্থিত, তাকে উন্মূল করো- গুঁড়িয়ে দাও-প্রাচীনকে থামিয়ে দাও -পুড়িয়ে মারো।’ এটাই ছিলো সমকালীন ‘ডাডাবাদী’ কবি-শিল্পীদের স্লোগান। এর মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের প্রচল কাব্য প্রথার বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থানকে স্পষ্টীকৃত করে তুলার জোরালো প্রয়াস অব্যাহত রাখেন। পাশাপাশি শতাব্দীর প্রচল ধারার কাব্যিক ঐতিহ্যকে রুখে দেবার জন্য ‘ডাডাবাদী’ লেখকগোষ্ঠী ছিলেন বেপরোয়াভাবে অঙ্গীকৃত।
১৯১৯ সালে যখন ডাডাবাদীরা আস্তানা গড়ে প্যারিসে, তখনই তার আন্তর্জাতিক চরিত্র প্রকট হতে থাকে। এই সময়ে এ আন্দোলনের জুটে গিয়েছিল আন্দ্রে ব্রেতোঁ, আরাগঁ, এলআর তারা এবং তাদের মতোই প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধাচারী কিউবিসড শিল্পী শিল্পীদের অনুমোদনও তারা পেয়েছিলেন।
জারা বলেছিলেন, “যা কিছুই আমরা দেখি, সব মিথ্যা”। যা কিছু মহাযুদ্ধের নিশংসতার জন্য দায়ী সব তারা সমূলে উচ্ছেদ করতে চেয়েছেন, ভাঙতে চেয়েছেন কাব্য আর শিল্পের পরম্পরাক্রমে চলে আসার রীতিনীতি। তারা লিখেছেন ইস্তেহার, ধনাত্মক কবিতা, রচনা করেছেন, সাধারণকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য ঘটিয়েছেন উদ্ভব ঘটনার প্রদর্শনী। এইসব উদ্ভট ক্রিয়া-কলাপের মধ্য দিয়ে তারা প্রমাণ করতে চেয়েছেন, তাদের তত্ত্বকে প্রয়োগ ও করতে চান উদ্ভট সংগঠনের উপস্থাপনায়।
যা কিছু ইতিহাসের নিয়মে দেউল হয়ে গেছে, তাকে উদ্ধেগ গোল প্রাণশক্তি দিয়ে উদ্ধার করা সম্ভব, এমন বিশ্বাসই তাদের প্রণোদিত করেছিল। এই নেতিবাচক আন্দোলনের ধাক্কা শেষ পর্যন্ত তাই ইতিবাচক হয়েছিল। শিল্পী কবিতায় তারা এনেছিলেন কোলাজ পদ্ধতি, যাতে বিচিত্র নিঃসম্পর্কিত বস্তু ইমেজের সমাবেশ ঘটে ন্যায় পরম্পরার বালাই না রেখে। দাদা তাদের কোলাজ পদ্ধতির ছাপ মিলবে এলিয়ট, এজরা পাউন্ডের কবিতায়, ম্যাক্স এরনস্ট, মার্শাল দুশাপ,মাগ্রিত মান রে-র শিল্পে।
দাদাবাদকে এক ধরনের প্রতিশিল্পও বলা যায়। বিরাজমান সংস্কৃতি যুদ্ধের জন্ম দেয়; কাজেই এর বিরোধীতা করা উচিত। শিল্পকে হতে হবে বিমূর্ত । কেননা, এটি পরিকল্পনা ও যৌক্তিক চিন্তাধারার বিপরীত। পরিকল্পনা ও যৌক্তিক চিন্তাধারা জন্ম দেয় যুদ্ধের আবহ।
রিচার্ড হিউয়েলসেনবেক বলেছেন-”Abstract art signified absolute honesty for us.”
এ কারণেই ডাডাবাদকে বলা যায় উত্তরাধুনিক শিল্পের জনক। ডাডাবাদী ধ্যান ধারনা তারপর জুরিখ থেকে অপরাপর ইউরোপীয় শহরে ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায়। এর কর্মীসমর্থকরা মিছিল মিটিং বিক্ষোভ করে।
নিয়মিত বইপত্র-জার্নাল প্রকাশ করে। ডাডাবাদ পরের শিল্পান্দোলনকেও প্রভাবিত করেছিল। আজ যে আমরা বিমূর্ত (যা মূর্ত নয়) কবিতা ও চিত্রকলার কথা বলি – ডাডাবাদ তারই পথ তৈরি করে দিয়েছিল। উত্তরাধুনিক শিল্পের সূচনা করেছিল। পরাবাস্তববাদের ভিত্তিপ্রস্তর রচনা করেছিল।
১৯১৬ সাল থেকে শুরু হওয়া ডাডাইজমের জোয়ার ১৯২৪ সাল পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল। পরবর্তীকালে এ আন্দোলনের গতি ম্লান হয়। কিন্তু ডাডাবাদ নিঃশেষ হয়ে যায়নি। এ আন্দোলনটি সুইজারল্যান্ডে শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে ফ্রান্স, আমেরিকা, জার্মানি, রোমানিয়া, ব্রিটেন, বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একটি মতবাদ নতুন আরেকটি মতবাদ উদ্ভবে সহযোগিতা করে।
সময়ের আবর্তনে ডাডাইজমও পরবাস্তববাদসহ পরবর্তী শিল্প আন্দোলনগুলোতে মিশে গিয়েছিল। সে সময়ে ডাডা আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী হুগো বলেছিলেন, “ডাডা শিল্পের একটি নতুন প্রবণতা। এখন পর্যন্ত এটা সম্পর্কে কেউ জানে না। কিন্তু ভবিষ্যতের জুরিখে ডাডাইজম নিয়ে মানুষ আলোচনা করবে।”
ডাডাবাদ খুব অল্প সময় চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। জুরিখ থেকে টোকিও, নিউইয়র্কে ডাডাবাদীরা উন্মাদনা ছড়ায়। ত্রিস্তান জারা এক ইশতেহারে বলেন, “ডাডাবাদীরা কী চায়? কিছুই না।” কিছু চাই না বলে তারা, চাওয়ার মতো তুমি কোনো হেতু নও- এমনটাই জানান দেয়। এমন ইশতেহার, যা কোনো ইশতেহার নয়, সবরকম নিয়মের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোও যে একটা নিয়ম- এ নিয়মই শ্রেষ্ঠ, সেসব কথাই আমরা শুনি ত্রিস্তান জারার মুখ থেকে।
ডাডাবাদের কবিতা হবে এলোমেলো, যা যে কেউ লিখতে পারেন। “সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি”- এ কথাকে অস্বীকার করে তারা বললেন, এক খণ্ড খবরের কাগজকে টুকরো টুকরো করে এর প্রতিটি শব্দকে কেটে আলাদা করুন। এরপর কাটা শব্দগুলোকে একটা পাত্রে নিয়ে ভালো করে ঝাঁকুন, শব্দগুলোকে নিয়ে একের পর এক বসান কবিতার আদলে সাজান। যা হবে, তা-ই ডাডাবাদী কবিতা। ডাডার কোলাজগুলো দেখতে অনেকটা এখনকার ফটোশপের মতো লাগে। ডাইমেনশন বদলে দেয়, দেখতে কোনোরকম অর্থ প্রকাশ করে না, অ্যাবসার্ড লাগে। জ্যামিতিক, মেকানিকাল, আর্কিটেকচারাল এমন কোনো খাত নেই যেখানে ডাডা প্রবেশ করেনি, সবখানে ডাডার ধ্বংসযজ্ঞ চোখে পড়ার মতো।
ডাডাবাদীরা বলেন, “সব কিছু ঠিক হয়ে এসেছে আমরা মানলাম, তবে একবার আমাদের ভুল করার সুযোগ দিন, যদিও ডাডাবাদীরা কোনো ভুল করছেন না।”
আরো পড়ুন: (বিষয়ের উপর ক্লিক করুন)
ডাডাবাদের উদ্ভবের ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ