Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

চন্ডীমঙ্গল কাব্যের তৎকালীন সমাজবাস্তবতা তুলে ধরো

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট সাহিত্যধারা হল মঙ্গলকাব্য সাহিত্যধারা। নিম্নবর্ণের হিন্দুদের দেবদেবী অর্থাৎ মনসা, চন্ডী, ধর্ম, শীতলা প্রমুখদের নিয়ে উচ্চবর্ণের কবি সাহিত্যিকরা এই ধারার কাব্যচর্চা করেছেন। এই মঙ্গল কাব্যগুলির সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল এগুলি চারটি খন্ডে বিভক্ত — বন্দনা অংশ, গ্রন্থোৎপত্তির কারণ, দেবখণ্ড এবং নরখন্ড। এর মধ্যে বন্দনাংশে কবিরা বিভিন্ন দেবদেবীর বন্দনা করেছেন। গ্রন্থোৎপত্তির কারণ অংশে কোন কবি কেন নিম্নবর্ণের দেবদেবীদের নিয়ে কাব্যরচনা করতে বসেছেন তার বিবরণ আছে। দেবখন্ডে দেখা যায় কোন স্বর্গের দেবতা অভিশাপ গ্রস্থ হয়ে মর্তে পূজা প্রচারের দায়িত্ব নিচ্ছেন; আর নরখন্ডে সেই মর্তবাসী দেবতা কীভাবে নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে উদ্দিষ্ট দেবতা বা দেবীর পূজা প্রচার করে শাপমুক্ত হয়ে স্বর্গে ফিরে যাচ্ছেন তার বিবরণ আছে। বেশিরভাগ মঙ্গলকাব্য এই চার খন্ডে বিভক্ত।

আমাদের আলোচ্য মুকুন্দ চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের ক্ষেত্রেও কবি এই চারখন্ডে বিভক্ত করে কাব্যটি রচনা করেছেন। এই কাব্যটি ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত। এখানে দু’টি কাহিনি আছে— ব্যাধ কালকেতুর কাহিনি এবং বণিক ধনপতি ও শ্রীমন্তের কাহিনি। দু’টি কাহিনির পূর্বেই মুকুন্দ চক্রবর্তী বন্দনা অংশ, গ্রন্থোৎপত্তির কারণ এবং দেবখন্ডের বর্ণনা দিয়েছেন।

বন্দনা অংশে স্বাভাবিক নিয়মে কবি বিভিন্ন দেবদেবীর উদ্দেশ্যে স্তুতি বাক্য রচনা করেছেন। আর দেবখন্ডে শিবদুর্গার ঘরকন্যার কাহিনি প্রাধান্য পেয়েছে। তবে এই কাব্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল গ্রন্থোৎপত্তির কারণ।

চন্ডীমঙ্গল কাব্যে সমকালীন সমাজের চিত্র 

মুকুন্দ চক্রবর্তী তার চন্ডীমঙ্গল কাব্যের গ্রন্থোৎপত্তির কারণ অংশটিতে তিনি কেন চন্ডীর মহিমা বিষয়ক চন্ডীমঙ্গল কাব্য রচনা করেছেন তার বিবরণ দিয়েছেন। এই বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি তাঁর কাব্যে নিজের জীবনের কথা নিয়ে এসেছেন। তাঁর জীবন ছিল সমকালীন সমাজ দ্বারাই অনেকটাই প্রভাবিত। স্বাবাবিকভাবেই এই গ্রন্থোৎপত্তির কারণ অংশে মুকুন্দ চক্রবর্তী তাঁর আত্মজীবনের পরিচয় দিতে গিয়ে সমকালীন সমাজের ছবি এঁকেছেন। এই ছবি আঁকার মধ্যে তৎকালীন মানুষের সামাজিক অবস্থান যেমন স্থান পেয়েছে, তেমনি সে সময়ের সমাজের রাজনীতি, অর্থনীতি বাস্তবসম্মত ভাবে স্থান পেয়েছে। তাই মুকুন্দ চক্রবর্তীর চন্ডীমঙ্গল হয়ে উঠেছে সমকালীন সমাজের জীবন্ত দলিল।

মুকুন্দ চক্রবর্তী তার চন্ডীমঙ্গল কাব্যের গ্রন্থোৎপত্তির কারণ অংশে তাঁর আত্মজীবনের যে পরিচয় দিয়েছেন, তা থেকে জানা যায় কবিরা কয়েক পুরুষ ধরে বর্ধমানের রত্না নদীর তীরে দামুন্যা (দামিন্যা) গ্রামে বসবাস করতেন। মূলত কবিরা ছিলেন ব্রাহ্মণ কৃষিজীবী। কবিদের তালুকদার ছিলেন গোপীনাথ নিয়োগী। এসময় মোগল সম্রাট আকবরের সুশাসনে সারা ভারতে মোটামুটি স্থিতিশীল অবস্থা থাকলেও কবির বাসভূমিতে আঞ্চলিক শাসন কর্তাদের অত্যাচার বেড়ে গিয়েছিল। সেই অঞ্চলের ডিহিদার মামুদ শরীফ ও তার কর্মচারী রায়জাদা উজিরের অত্যাচারে সেই অঞ্চলের তাবৎ প্রজা দুর্বিষহ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিলেন। এই সময়কার বর্ণনা দিয়ে কবি বলেছেন-

“পেয়াদা সবার আগে

দুয়ার চাপিয়ে দেয় থানা।

প্রজা হইল ব্যাকুলি

প্রজার পালায় পাছে

বেঁচে ঘরের কুড়ালি”

ক্রমবিকাশ ঘটেছে আধুনিক যুগে।

১) কাহিনি,

২) চরিত্র,

৩) প্লট,

৪) বাস্তবতা,

৫) পটভূমি,

৬) প্রকাশ রীতি,

৭) লেখকের জীবন দর্শন প্রভৃতি হল উপন্যাসে সাধারণ লক্ষণ।

মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি মুকুন্দ চক্রবর্তী তাঁর চন্ডীমঙ্গল কাব্যটি রচনা করেছিলেন মধ্যযুগের ষোড়শ শতাব্দীতে। এই সময় বাংলা সাহিত্যে তো নয়ই বিশ্বসাহিত্যেও উপন্যাস রচনার কোন চল ছিল না। তবুও অনেক সমালোচক মুকুন্দ চক্রবর্তীর চন্ডীমঙ্গল কাব্যটিতে উপন্যাসের লক্ষণ খুঁজে পেয়ে মুকুন্দ চক্রবর্তী সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, তিনি এযুগে জন্মালে একজন সার্থক ঔপন্যাসিক হতেন। আমাদের আলোচনা করে দেখা দরকার মুকুন্দ চক্রবর্তীর চন্ডীমঙ্গল কাব্যে উপন্যাসের লক্ষণগুলি কতটা সার্থকভাবে প্রকাশিত হয়েছে।

উপন্যাসের লক্ষণগুলি বিচার করতে গেলে প্রথমেই আসে কাহিনি প্রসঙ্গ। মুকুন্দ চক্রবর্তী চন্ডীমঙ্গল কাব্যটি নিম্নবর্ণের হিন্দুদের দেবী চন্ডীর পূজা প্রচারের উদ্দেশ্যে রচনা করলেও একাব্যে একটি কাহিনি আছে এই কাহিনিটি ব্যাধ কালকেতু ও তার স্ত্রী ফুল্লরার কাহিনি। কাব্যটির দেবদেবীর অংশটি বাদ দিলেও কালকেতু ও ফুল্লরার কাহিনি হিসাবে কাব্যটি কোন অংশেই নিকৃষ্ট নয়। আমরা দেখি ধর্মকেতু ও নিদয়ার সন্তান কালকেতু বনে পশু শিকার করে এবং সেই পশুর মাংস, চামড়া, দাঁত প্রভৃতি বিক্রি করে তাদের জীবন চলে। কালকেতুর অত্যাচারে বিব্রত হয়ে পশুরা তাদের আরাধ্যা দেবী চন্ডীর শরণাপন্ন হলে দেবী চন্ডী তাদের অভয় দেন এবং কালকেতুকে ব্যাধ থেকে রাজাতে পরিণত করেন। এইভাবে কাব্যটিতে উপন্যাসের প্রথম লক্ষণ অর্থাৎ কাহিনির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

উপন্যাসের দ্বিতীয় লক্ষণ চরিত্র। মুকুন্দ চক্রবর্তীর চন্ডীমঙ্গল কাব্যে দেব চরিত্র থেকে শুরু করে সকল প্রকার মানব চরিত্র চিত্রিত হয়েছে। এখানে নায়ক এবং নায়িকা হিসাবে কালকেতু ও ফুল্লরা যেমন স্থান পেয়েছে, তেমনি বুলান মন্ডলের মত ভাল মানুষও আছে। আধুনিক উপন্যাসে যেমন খল চরিত্র থাকে তেমনি এখানে মুরারী শীলও ভাঁড়ুদত্ত খল চরিত্র হিসাবে পরিকল্পিত। মুকুন্দ চক্রবর্তীর কাব্যে পশুদেরও মানব চরিত্রে উত্তরণ ঘটেছে। যখন মুকুন্দের ভালুক বলে—

“উই চারা খাই পশু নামেতে ভালুক। নেউগী চৌধুরী নহি না করি তালুক।।”

তখন ভালুক আর ভালুক থাকে না, সে মানুষে রূপান্তরিত হয়। তাই দেখা যায় উপন্যাসের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ সার্থক চরিত্র চিত্রণ তা প্রধান চরিত্রই হোক বা অপ্রধান চরিত্রই হোক; তার যথেষ্ট সমাবেশ এই কাব্যে আছে।

উপন্যাসের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হল উপন্যাসের প্লট বা কাহিনি বিন্যাস। মুকুন্দ চক্রবর্তীর চন্ডীমঙ্গল কাব্যে আমরা প্লট বা কাহিনি বিন্যাসের অপরূপ সমাহার আমরা দেখতে পাই। এখানে কোন ঘটনাই এমনি এমনি ঘটেনি। প্রতিটি কার্যের পিছনেই আছে কোন না কোন কারণ। তাই বলা যায় এখানে কার্যকারণ পরম্পরা সূত্র ঠিকমত মেনে চলা হয়েছে। এই জন্যেই নীলাম্বর ও ছায়া অভিশাপ গ্রস্থ হয়ে ব্যাধ রূপে জন্মগ্রহণ করেছে, ব্যাধ কালকেতু প্রথমে পশুশিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেছে, তারপরে পশুরা দেবীর কাছে নালিশ জানিয়েছে, দেবী তাদের অভয় দিয়েছেন এবং কালকেতুকে আশির্ব্বাদ করে ব্যাধ থেকে রাজায় পরিণত করেছেন। শেষপর্যন্ত রাজা কালকেতু দেবী চন্ডীর পূজা প্রচার করে অভিশাপ মুক্ত হয়ে পুনরায় স্বর্গে ফিরে গেছে। এইভাবে উপন্যাসের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ প্লট এখানে পুরোপুরি মেনে চলা হয়েছে।

উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল বাস্তবতা। চন্ডীমঙ্গল কাব্যটি মধ্যযুগের ভক্তির যুগে বসে লেখা। স্বাভাবিকভাবেই এই কব্যে বাস্তবতার অতটা প্রয়োগ অসম্ভব ছিল; কিন্তু মুকুন্দ চক্রবর্তী কাব্যক্ষেত্রে সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করে দেখিয়েছেন। এই কাব্যের গ্রন্থোৎপত্তির কারণ অংশে মুকুন্দের আত্মজীবনের পরিচয় অংশ, নরখন্ডের ফুল্লরার বারোমাসের সুখ দুঃখের বারোমাস্যায়, নারীগণের পতিনিন্দায় এবং দেবী চন্ডীর কাছে পশুদের দুঃখ নিবেদন করে ‘পশুগণের গোহারি’ অংশটি অত্যন্ত বাস্তব সম্মত উপায়ে লেখা। এই কাব্যের ব্যাধ কালকেতু, ফুল্লরা, বুলান মন্ডল, ভাডুদত্ত, মুরারী শীল, বনের পশুরা সকলেই বাস্তবধর্মী চরিত্র। এই কারণেই রমেশ চন্দ্র সেন বলেছেন—

“The thought and feelings and sayings of his men and women are perfectly natural, recorded with fidelity which has no parallel in the whole range of Bengali literature.”

স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যাচ্ছে চন্ডীমঙ্গল কাব্যটি বাস্তব সম্মত ভাবে রচিত।

প্রত্যেকটি উপন্যাসের ক্ষেত্রেই কোন না কোন পটভূমি থাকে, যার উপর ভিত্তি করে ঔপন্যাসিক উপন্যাস গড়ে তোলেন। চন্ডীমঙ্গল কাব্যের ক্ষেত্রে দেখা যায় দেবী চন্ডীর পূজা প্রচারই মুকুন্দ চক্রবর্তীর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। তাই পূজা প্রচারকে পটভূমি ধরে তিনি কাব্যটি রচনা করেছেন। আর এখানেই কাহিনি চরিত্র, প্লট, বাস্তবতা সবই প্রাধান্য পেয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই উপন্যাসের অন্যতম লক্ষণ পটভূমি এই কাব্যে আছে।

উপন্যাসের ক্ষেত্রে প্রকাশরীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। প্রকাশরীতি দুই রকমের— বর্ণনারীতি এবং সংলাপের রীতি। মুকুন্দ চক্রবর্তী তার কাব্যটির আখ্যানভাগ কবিতা আকারে রচনা করায় এখানে প্রকাশ রীতির ক্ষেত্রে তিনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বর্ণনা রীতি গ্রহণ করেছেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনি প্রয়োজন মত সংলাপের রীতিও গ্রহণ করেছেন। যদিও এই দু’টি রীতি যে কোন সাহিত্যের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য; তবুও উপন্যাসের ক্ষেত্রেই প্রকাশ রীতির আলোচনা বেশি আসে। তাই বলা যায় উপন্যাসের এই লক্ষণটিও চন্ডীমঙ্গল কাব্যে আছে।

উপন্যাসের মাধ্যমে লেখকের জীবন দর্শন প্রকাশিত হয়। চন্ডীমঙ্গল কাব্যে মুকুন্দের দর্শন ছিল দেবী চন্ডীর পূজা প্রচার করা; কিন্তু তার চেয়েও বড় দর্শন ছিল মানবিকতার প্রচার। এই কাব্যে আমরা দেখি মুকুন্দ চক্রবর্তী জীবনে অনেক দুঃখ কষ্ট পেয়ে নিজের সাত পুরুষের ভিটে মাটি ত্যাগ করতে বাধ্য হন ৷ তার এই সময়কার অবস্থার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেছেন—

“তৈল বিনা কৈনু স্নান

করিনু উদগ পান

শিশু কান্দে ওদনের তরে।”

কিন্তু মুকুন্দ চক্রবর্তী কখনোই দুঃখের যন্ত্রনাই ভেঙে পড়েন নি- দুঃখ যন্ত্রনা থেকে নিবারণের পথ খুঁজেছেন। তাই মুকুন্দের নায়ক কালকেতু গুজরাট নগর পত্তন করে বুলান মন্ডলকে আহ্বান করে বলেন-

“শুনো ভাই বুলান মন্ডল।

আইস আমার পুর

সন্তাপ করিব দূর

কানে দিব সোনার কুণ্ডল।।

আমার নগরে বস

যত ইচ্ছা চাষ চষ

তিনসন বহি দিও কর।।”

এমনকি মুকুন্দ চক্রবর্তী দরিদ্র ভাঁডুদত্তেরও পুনর্বাসন করেছেন তার কাব্যে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে আধুনিক ঔপন্যাসিকদের মত চন্ডীমঙ্গল কাব্যে মুকুন্দ চক্রবর্তীর জীবন দর্শন প্রকাশিত হয়েছে।

এইভাবে আলোচনা করলে দেখা যায় মুকুন্দ চক্রবর্তীর চন্ডীমঙ্গল কাব্যে আধুনিক উপন্যাসের প্রায় সব লক্ষণই সার্থকভাবে পরিস্ফুট। মুকুন্দ চক্রবর্তী মধ্যযুগে ষোড়শ শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করে কাব্যচর্চা করেছিলেন। সেই সময় ভারতীয় সাহিত্যে তো বহুদূরের কথা বিশ্বসাহিত্যেও উপন্যাসের প্রচলন হয়নি৷ স্বাভাবিকভাবেই মুকুন্দ চক্রবর্তীর দ্বারা উপন্যাস রচনা করা সম্ভব ছিল না; কিন্তু তিনি চন্ডীমঙ্গল কাব্যটি যেভাবে রচনা করেছিলেন তা পর্যালোচনা করে সমালোচকের মন্তব্যটি অর্থাৎ মুকুন্দ চক্রবর্তী এযুগে জন্মালে ঔপন্যাসিক হতে পারতেন মেনে নিতেই হয়।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

"সোজন বাদিয়ার ঘাট" কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

“সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

ভূমিকা: বাংলা কাব্যের ভুবনে বাংলাদেশের মানসকবি জসীম উদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) আবির্ভাব বিশ শতকের তৃতীয় দশকে। তিনি রবীন্দ্র-নজরুল ও তিরিশের কবিদের বলয় ও প্রভাব মুক্ত থেকে কবিতায় এক নতুন ও ব্যতিক্রম স্বর সৃষ্টি করেছেন। সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগরচেতনা, নাগরিক জীবন ও আচার-আচরণ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তুলে এনেছেন, জসীম উদদীন সেখানে তার কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কবির বিকল্প জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ উপন্যাসধর্মী রচনা। এ কাব্যে প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। নিম্নে … “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস ১. অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যে অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এ আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস, সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। “নমু পাড়ায় পূজা পরব, শঙ্ক কাঁসর বাজে, … মুসলমানের পাড়ায় বসে ঈদের মহোৎসবে,” ২. প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যেপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে মুসলমান চাষীর ছেলে সোজন আর হিন্দু নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠরতার আলেখ্য। গ্রামের হিন্দু বালিকা দুলীর সাথে মুসলমানের ছেলে সোজনের আবল্য বন্ধুত্ব। বন্ধু থেকে আস্তে আস্তে প্রেমে পরিণত হয়। কবিতায়- “নমুদের মেয়ে আর সোজনের ভারি ভাব দুইজনে, লতার সঙ্গে গাছের মিলন, গাছের লতার সনে।“ প্রেমের তুলনায় সমাজ অতিমাত্রায় কাব্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাব্যে সামাজিক অনুষঙ্গের উপস্থাপন করেছেন কবি। কবিতাতে তিনি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষকে আসার আহ্বান করেছেন। সমাজের মানুষের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, খেলাধুলা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায় কাব্যটিতে। দুলির মায়ের কণ্ঠে সমাজের রূঢ় রূপটি প্রকাশ পায়- “পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেত পাড়ায় যে ঠেকা ভার, চূণ নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!” ৩. জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রচনা: কবি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে। শহরজীবনে বসবাস করলেও তিনি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে গ্রামে কাজ করেছেন। ফলে তিনি মানুষের সাথে মিশতে পেরেছেন এবং তাঁর জীবনবোধ ও জীবন অভিজ্ঞতা হয়েছে সমৃদ্ধ। তাঁর জীবনপদ্ধতি ব্যতিক্রমধর্মী এবং বড় কবিতার ধারক হিসেবেই তিনি পরিচিত। ৪. উপন্যাসধর্মী রচনা: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” একটি উপন্যাসধর্মী রচনা। কাব্যের কবিতাগুলো জসীম উদদীন উপন্যাসের ঢংয়ে লিখেছেন। এ যেন লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক। ৫. মৌলিক রচনাধর্মী ও অনন্য: অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় সম্পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন কাহিনী নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রাম-বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। ৬. আধুনিকতা ও উদারনীতির বৈশিষ্ট্য: সময়কে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে স্বীকার করে নিয়ে লেখা আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাণিজগতের কল্যাণকামনা করে মানবিক হওয়াও আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। এসবের সংমিশ্রণে জসীম উদদীন কবিতায় অবয়ব দিয়েছেন। হিন্দু কিশোরী দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সুজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীমউদ্দীন লিখলেন- এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে . . . এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি। ৭. চরিত্র নির্মাণে দক্ষতা: ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে লেখক চরিত্রের আমদানি করেছেন, চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং চরিত্রের পরিণতি দেখিয়েছেন। চরিত্র যেন অনুভূতির মাধ্যমে কথা বলছে। তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভাষার ব্যবহারেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ৮. কাহিনী ও ভাষা বিন্যাসে পাণ্ডিত্য: কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ৯. ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ: আধুনিক কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীমউদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলঙ্কারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলঙ্কারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ।

Read More
কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলা: বাংলা সাহিত্যের একটি চরিত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়েন। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার

Read More

Keto Diet Recipes

Keto for Beginners: A Simple 7-Day Meal Plan The ketogenic (keto) diet has taken the health and wellness world by storm, promising weight loss, increased

Read More
শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক নাটক। এটি রচিত হয় ১৮৫৯ সালে। নাটকটি মহাভারতের কাহিনীকে উপজীব্য করে পাশ্চাত্য রীতিতে রচিত হয়। নাটকটির কাহিনী মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.