Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta
Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

চন্ডীমঙ্গল কাব্যের বনের পশুদের মানবিক মর্যাদা লাভ আলোচনা করো

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য যে কয়েকটি ধারার বিকাশ লাভ করেছিল তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা হল মঙ্গলকাব্য ধারা। এখানে নিম্নবর্ণের হিন্দু দেবদেবীদের মাহাত্ম্য প্রচার করে তাদের পূজা প্রচারের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। এই মঙ্গলকাব্য ধারার মধ্যে একটি গুরুত্বপুর্ণ ধারা হল চন্ডীমঙ্গল কাব্যধারা। অনেক কবির রচনা দ্বারা চন্ডীমঙ্গল কাব্যধারা সমৃদ্ধ হয়েছে। এসব কবিদের মধ্যে নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন কবিকঙ্কন মুকুন্দ চক্রবর্তী। তিনি শুধু চন্ডীমঙ্গল কাব্যধারার নয়, সমগ্র মঙ্গলকাব্যের তথা সমগ্র মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন। তাঁর এই শ্রেষ্ঠত্ব ছিল মূলত চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের আখেটিক খন্ডের জন্য। এই খন্ডে তিনি যে সকল বিষয়ে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম হল এই কাব্যের চরিত্র চিত্রন। দেব চরিত্র থেকে শুরু করে মানব চরিত্রের চিত্রণে মুকুন্দ চক্রবর্তী তো কৃতিত্ব দেখিয়েছেনই; তার কাব্যে বনের পশুরাও মানব চরিত্রের সমতুল্য হয়ে উঠেছে।

চন্ডীমঙ্গল যদিও দেবতার মাহাত্ম্য কীর্তন সূচক কাব্য, তবুও এর মধ্যে দেব মাহাত্ম্য কাটিয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে মানবিকতা। তাই এখানে দেবতারা যেমন মানুষ হয়ে উঠেছেন, তেমনি বনের পশুরা যখন কথোপকথন করে তখন আর তাদের শুধু পশু ভাবা যায় না— তারাও মানুষের সমতুল্য হয়ে ওঠে। আসলে দেবী চন্ডী হলেন বনের পশুদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তিনি যেমন তার সন্তানতুল্য বনের পশুদের আশ্রয় দেন, তেমনি রক্ষণাবেক্ষণও করেন। এই কারণে পশুরা যেমন তাকে ভক্তি বিনত চিত্তে প্রণাম জানায়, তেমনি বিপদ থেকে রক্ষা পেতে গেলে তারই শরণাপন্ন হয়।

সমগ্র চন্ডীমঙ্গল কাব্যে দু’বার পশুকুলের সাথে দেবী চন্ডীকে দেখা গেছে। প্রথমবার বিজুবনে দেবী চন্ডীর সাথে পশুদের দেখা হয়। দেবীকে দেখতে পেয়ে পশুরা তাকে প্রণাম করে এবং সেইসঙ্গে তারা যাতে নিৰ্ভয়ে, নিরাতঙ্কে থাকতে পারে সেজন্যে অভয় চায়। দেবী চন্ডী তাদের অভয় দিয়ে বলেন যে, তারা যেন নিজেদের মধ্যে ঐক্য, বন্ধুত্ব বজায় রাখে—

“যে জন যাহার শত্রু থাক মিত্রভাবে। থাকিবে আনন্দে সবে কেহ না হিংসিবে।।”

প্রথমবার দেবী চন্ডীর সাথে পশুদের এরূপ সাক্ষাৎ হলেও দ্বিতীয়বার তাদের যখন দেবীর সাথে সাক্ষাৎ হয়, তখন তাদের চূড়ান্ত দুরবস্থা। ব্যাধ কালকেতু তার সংসার যাত্রা নির্বাহের জন্য আপন বৃত্তি অর্থাৎ শিকারের উপর নির্ভরশীল। ফলে বনের পশুদের সামনে দেখা দিয়েছে সমূহ বিপদ। কালকেতু ব্যাধ হলেও প্রবল পরাক্রান্ত বীর, অসীম শক্তিশালী; বনের পশুরা কিছুতেই তার সাথে এঁটে উঠতে পারে না। তাই পশুরাজ সিংহ এবং অন্য পশুরা একত্রিত হয়ে স্থির করে যে, কালকেতুর হাত থেকে বাঁচতে হলে দেবী চন্ডীর শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় নেই। তারা নিজেদের অবস্থা জানানোর জন্যে চন্ডীর দেউলে সমবেত হয়— “উপনীত হইল পশু তমাল তরুমূলে। প্রদক্ষিণ নমস্কার করিল দেউলে।।”

সেখানেই তারা দেবী চন্ডীকে অভিযোগ পেশ করতে লাগে। সবার আগে সিংহের অভিযোগ। কারণ পশুদের রাজা হয়েও সে আজ নিরুপায়—

“ভালে টিকা দিয়া মাগো করিলে মৃগরাজ।

করিব তোমার সেবা রাজ্যে নাহি কাজ।।”

ভালুকের যন্ত্রণা অন্তহীন। সে নিতান্তই নিরীহ জীব; কারও কোন সাতে পাঁচে থাকে না, তবুও বার্ধক্যে উপনীত হয়ে তাকে চরম যন্ত্রণা পেতে হচ্ছে। তার স্ত্রী, সাতপুত্র, নাতিরা একে একে বীরের শিকার হওয়ায় সে আজ নির্বংশ হতে চলেছে। তাই ভালুকের মনে প্রশ্ন জেগেছে যে, সে নিরীহ জীব, কারও কোন ক্ষতি চায় নি, তবুও তার এরূপ অবস্থা কেন—

“উই চারা খাই পশু নামেতে ভালুক। নেউগী চৌধুরী নহি না করি তালুক।।”

শরভ-করভ-কোক-বরাহ সকলেরই ভালুকের মতই অভিযোগ যে, তারা নিরিহ পশু হওয়া সত্বেও কেন তাদের প্রতি এই অত্যচার। শরভ-করভেরা দ্রুত ধাবিত হতে জানলেও কালকেতুর কাছে সে ক্ষমতা তুচ্ছ। বরাহকেও মৃত্যুশোক সহ্য করতে হয়েছে। কালকেতুর হাত থেকে সে স্বামী, শাশুড়ী, ননদ এমনকি কোলের সন্তানকেও রক্ষা করতে পারে নি। নানা জাতীয় সুদৃশ্য হরিণেরই সমূহ বিপদ। তাই কাতর কণ্ঠে তারা বলে-

“কেন হেন জন্ম বিধি কৈল পাপ বংশে।

হরিণ ভূবন বৈরী আপনার মাংসে।।”

সজারুর জ্বালা আরও বেশি। গর্তে লুকিয়ে সে যে পরিত্রাণ পাবে তার কোন উপায় নেই— সুচতুর কালকেতু গর্তে জল ঢেলে সজারুকে বাইরে টেনে আনে। এইভাবে তাকে স্ত্রী, পুত্র, কন্যাকে হারাতে হয়েছে-

“গাড়ের ভিতরে থাকি লুকি ভালে জানি।

কি করি উপায় বীর তথি দেয় পানি।।”

যে মর্কট রামচন্দ্রের কৃপালাভে ধন্য হয়েছিল, কালকেতুর হাত থেকে তারও নিস্তার নেই। আর বিশাল দেহী হস্তিনী তার ধুলি ধুসরিত কলেবরে তার কমললোচন শিশুপুত্রের কথা স্মরণ করে কেঁদে ভাসায়। তার বিশাল শরীরই তার সবথেকে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এইজন্য সে দুঃখ করে বলে

“বড় নাম বড় গ্রাম বড় কলেবর। লুকাইতে ঠাই নাই অরণ্য ভিতর।”

এভাবে একত্রে সব পশু দেবী চন্ডীর দেউলে তাদের নিদারুন দুঃখের কথা নিবেদন করে। এতে ভক্ত বৎসল দেবী চন্ডী পশুদের উপেক্ষা করতে পারেন না এবং তাদের দর্শন দেন। দেবীকে কাছে পশুরা আরও একবার দেবী চন্ডীকে তাদের দুঃখের কথা জানায়। পশুরাজ সিংহের আক্ষেপই বেশি—

“আরণ্যের সেবক হইয়া সর্বত্রতে তরি।

তোমার সেবক হইয়া সবংশতে মরি।।”

দেবী সমস্ত কথা শোনেন এবং পশুকুলকে বরাভয় দান করে বলেন যে, তারা যেন ভয় না করে নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করে।

এভাবে মুকুন্দ চক্রবর্তী তার চন্ডীমঙ্গল কাব্যে বনের পশুদের দুঃখ যন্ত্রণার বর্ণনা দিয়ে শেষপর্যন্ত তাদের বেঁচে থাকার উপায় বেড় করেছেন। ‘গ্রন্থোৎপত্তির কারণ’ অংশে মুকুন্দ চক্রবর্তী সমকালীন সমাজব্যবস্থার যে চিত্র এঁকেছেন, এখানে তারই বাস্তব বর্ণনা এসেছে। কালকেতু যেন ডিহিদার মামুদ শরীফের ছায়া অবলম্বনে পরিকল্পিত; আর পশুকুলের মধ্যে অত্যাচারিত প্রজাদের ছায়া লক্ষ্য করা যায়। ভালুকের উক্তির মধ্যে কবির পরিচিত গোপীনাথ নিয়োগী স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। বহিঃশত্রুর আক্রমণে একটি অঞ্চলের লোকজীবন কিভাবে ওলোট পালোট হয়ে যায়, তার প্রমাণ এই পশুদের দুরবস্থা। মুকুন্দ চক্রবর্তীর এই বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল। তিনি এই অভিজ্ঞতা পশুদের চরিত্র চিত্রণে কাজে লাগিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবে এই কাব্যে পশুরা নিছক বন্যপশু হয়ে থাকে নি; তারাও জীবন্ত, বাস্তব ও মানবিক হয়ে উঠেছে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

লােকসাহিত্য কাকে বলে?

লােকের মুখে মুখে প্রচলিত গাঁথা, কাহিনী, গান, ছড়া, প্রবাদ ইত্যাদি হলাে লােকসাহিত্য হলাে। লোকসাহিত্য মূলত বাককেন্দ্রিক। কেবল মৌখিক নয়, ঐতিহ্যবাহীও, অর্থাৎ লোকপরম্পরায় লোকসাহিত্য মুখে মুখে

Read More

সাহিত্য কী? বাংলা সাহিত্য কী? বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করো!

সাহিত্য: ‘সাহিত্য’ শব্দটি ‘সহিত’ শব্দ থেকে এসেছে। এখানে সহিত শব্দের অর্থ- হিত সহকারে বা মঙ্গলজনক অবস্থা। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য সম্পর্কে বলেন, “একের সহিত অন্যের মিলনের মাধ্যমই হলো

Read More

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১১ ফেব্রুয়ারি ১৮৮২ – ২৫ জুন ১৯২২) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ কবি, যাঁর কবিতা এবং ছড়ার জন্য তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। তাঁর জন্ম

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.