খ্রিস্টিয় পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত নিম্নবর্ণের হিন্দু দেবদেবীর মাহাত্ম প্রচার করে যে সকল কাব্য রচিত হয়েছিল বাংলা সাহিত্যে সেগুলি মঙ্গলকাব্য নামে পরিচিত। এই মঙ্গলকাব্যের বেশ কয়েকটি ধারা প্রচলিত ছিল যার মধ্যে একটি অন্যতম ধারা হল চন্ডীমঙ্গল কাব্যধারা। এই চন্ডীমঙ্গল কাব্যধারা আখেটিক খন্ড ও বণিক খণ্ড— এই দুই খন্ডে বিভক্ত। চন্ডীমঙ্গল কাব্যধারার বেশ কয়েকজন কবির আমরা পরিচয় পাই। যাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন কবিকঙ্কন মুকুন্দ চক্রবর্তী। কবিকঙ্কন মুকুন্দ চক্রবর্তীকে শুধু চন্ডীমঙ্গল কাব্যধারার নয়; সমগ্র মঙ্গলকাব্যের এমনকি সমগ্র মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবিত্বের শিরোপা দেওয়া হয়। তার এই শ্রেষ্ঠত্বের পিছনে যে সকল কারণ আছে তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ হল তাঁর সহজ, সরল, স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল চরিত্র সৃষ্টির ক্ষমতা। তাই মুকুন্দ চক্রবর্তী তাঁর কাব্যে কালকেতু বা ফুল্লরার মত সহজ সরল চরিত্র যেমন সৃষ্টি করেছেন, তেমনি মুরারী শীল বা ভাঁডুদত্তের মত কূট চরিত্রেরও ছবি আঁকাতে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন।
মুরারী শীল চরিত্র : চন্ডীমঙ্গল কাব্যের আমাদের আলোচ্য আখেটিক খন্ডে ব্যাধ কালকেতুর দেবী চন্ডীর কৃপায় রাজা হয়ে ওঠার কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। কালকেতু রাজা হওয়ার পথে যে সমস্ত চরিত্রের সম্মুখীন হন তাদের মধ্যে দু’জন হলেন মুরারী শীল এবং ভাঁড়ুদত্ত। এই দু’টি চরিত্রই ছিল খল প্রকৃতির— তারা কালকেতুকে ঠকানোর চেষ্টা করেছিল। মুরারী শীল ছিলেন বণিক, তিনি সোনা-রূপার ব্যবসা করতেন।
চন্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনিতে দেখা যায় দেবী চন্ডীর কৃপায় কালকেতু সাত ঘড়া ধন ও একটি আংটি পান। দেবী চন্ডী তাকে জানিয়ে দেন যে, সেই আংটির মূল্য সাত কোটি টাকা। এই আংটি বিক্রির উদ্দেশ্যে কালকেতু মুরারী শীলের বাড়িতে যান। কিন্তু চতুর মুরারী শীল ভাবে কালকেতু হয়ত তার কাছে মাংসের বাকি টাকা উদ্ধারের উদ্দেশ্যে এসেছে। এজন্য তিনি বাড়িতেই আত্মগোপন করেন এবং তার স্ত্রী কালকেতুকে জানান—
“ঘরেতে নাহিকো পোদ্দার।
প্রভাতে তোমার খুরা
গিয়াছে খাতক পাড়া
কালি দিব মাংসের উধার।।”
কিন্তু এরপর আড়ালে থেকে মুরারী শীল তার স্ত্রী ও কালকেতুর কথোপকথন থেকে জানতে পারেন যে, এখানে প্রাপ্তি যোগের সম্ভাবনা আছে। সুতরাং তিনি আর লুকিয়ে থাকতে পারেন না এবং খিড়কির দরজা দিয়ে কালকেতুর সামনে এসে হাজির হন। কালকেতু তাকে আংটিটি দিলে দেবী চন্ডীর স্বপ্নাদেশ স্বত্ত্বেও তিনি কালকেতুকে জানিয়ে দেন–
“সোনা রূপা নহে বাপা এ ব্যাঙ্গা পিতল।
ঘষিয়া মাজিয়া বাপু করিছ উজ্জ্বল।।”
কালকেতুকে এভাবে বিভ্রান্ত করে দিয়ে তিনি এর মূল্য নির্ধারণ করে বলেন
“রতি প্রতি হইল বীর দশ গণ্ডা দর।
দুই যে ধানের কড়ি পাঁচ গন্ডা ধর।।
অষ্টপণ পাঁচ গণ্ডা অঙ্গুরীর কড়ি
বাকি আর মাংসের ধারি যে দেড় বুড়ি।।”
কিন্তু দেবী চন্ডীর কাছে কালকেতু এর আসল মূল্য জেনে গেছিল, তাই এই মূল্যে তিনি কিছুতেই আংটি দিতে রাজী হন না এবং সেখান থেকে চলে যেতে চান। সম্পদ হাতছাড়া হচ্ছে দেখে মুরারী শীল কালকেতুকে বলেন—
“ধর্মকেতু ভায়া সনে কইনু লেনা দেনা।
তাহা হইতে ভাইপো হয়াছ সেয়ানা।।”
যাইহোক অবশেষে দেবী চন্ডী মুরারী শীলকে আংটির উচিৎ মূল্য দেবার নির্দেশ দিলে তিনি কালকেতুকে উচিৎ মূল্য দেন এবং কালকেতুকে জানান যে, তিনি এতক্ষণ তার সাথে পরিহাস করছিলেন।
এভাবে আলোচ্য কাব্যে মুরারী শীল স্বল্প স্থান জুড়ে অবস্থান করলেও মুকুন্দ চক্রবর্তী কাব্যে তাকে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে চিত্রিত করেছেন। ব্যবসায়ীদের মধ্যে খলতা, শঠতা, লোক ঠকানো শুধু যে আমাদের সমাজেই নেই; আমাদের অনেক আগে মুকুন্দ চক্রবর্তীর যুগেও ছিল তার প্রমান এই মুরারী শীল।