সৈয়দ মুজতবা আলী বাংলা সাহিত্যের অন্যতম স্বনামধন্য লেখক। তাঁর লেখার মধ্যে রম্যরচনা, ভ্রমণকাহিনী, প্রবন্ধ, ছোটগল্প ও উপন্যাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। তাঁর সাহিত্য জীবনবোধ, রসবোধ এবং গভীর দার্শনিক চিন্তায় ভরপুর, যা পাঠককে মুগ্ধ করে। তিনি বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির উপর দখল রাখতেন, যা তাঁর লেখার মধ্যে বৈচিত্র্য আনতে সহায়ক হয়েছে। মুজতবা আলীর সাহিত্যকর্মে হাস্যরসের পাশাপাশি গভীর সামাজিক সচেতনতা ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে ওঠে।
সৈয়দ মুজতবা আলীর সাহিত্য রচনার বৈশিষ্ট্যসমূহ:
১. ভ্রমণবৃত্তান্তের জাদু: তাঁর অন্যতম বিখ্যাত রচনা “দেশে বিদেশে”—যেখানে তিনি কাবুলের জীবন ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছেন। ভ্রমণকাহিনীতে স্থানীয় মানুষের জীবন, ইতিহাস ও সংস্কৃতি সবকিছুই তুলে ধরতে পারদর্শী ছিলেন তিনি।
২. ভাষার সরলতা ও মাধুর্য: মুজতবা আলীর লেখা সহজবোধ্য ও প্রাঞ্জল, যা যেকোনো পাঠকের জন্য আকর্ষণীয়। ভাষার প্রবাহময়তা ও শব্দের নির্বাচন অসাধারণ।
৩. বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধ: রম্যরচনায় তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধ লক্ষণীয়। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি হালকা মেজাজে রম্য রচনা লিখেছেন, যা পাঠকদের হাসাতে ও ভাবাতে সক্ষম।
৪. সাহিত্যে বহুভাষিক প্রভাব: মুজতবা আলী একাধিক ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। বাংলা, উর্দু, ফারসি, আরবি, জার্মান, ফরাসি ও ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষার মিশ্রণ তাঁর লেখায় স্পষ্ট।
৫. মন্তব্যধর্মী উপস্থাপনা: তাঁর রচনাগুলিতে প্রায়শই সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি বা সমস্যা সম্পর্কে মন্তব্য করেন, যা সহজভাবে তুলে ধরলেও গভীর প্রভাব ফেলে।
৬. অভিজ্ঞতাজাত সত্য: মুজতবা আলীর লেখার অনেকটাই তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে। তাঁর ভ্রমণ, ভাষা শিক্ষা এবং জীবনযাত্রার অভিজ্ঞতা সবই তাঁর রচনায় সরাসরি প্রভাব ফেলেছে।
৭. আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি: তিনি বহু দেশে ভ্রমণ করেছেন এবং সেইসব দেশের মানুষের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে লেখার মাধ্যমে এক বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছেন।
৮. পাঠককে সরাসরি সংযুক্ত করার ক্ষমতা: মুজতবা আলীর লেখায় এমন একটি সহজাত গুণ ছিল যা পাঠককে সরাসরি সংযুক্ত করে। তাঁর গল্প বলার ক্ষমতা এতই জীবন্ত যে পাঠক সহজেই তাঁর সাথে ভ্রমণ করতে পারে।
৯. সংস্কৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা: বিভিন্ন সংস্কৃতি সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তাঁর লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি নিজেও বিভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী ছিলেন এবং এটি তাঁর রচনায় স্পষ্ট।
১০. সংবেদনশীলতা ও মানবিকতা: সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনায় মানবিকতা ও সংবেদনশীলতা প্রবল। তিনি সাধারণ মানুষের জীবন, কষ্ট ও আনন্দের কথা অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে প্রকাশ করেছেন।
১১. অসংকোচ সমাজচিন্তা: সমাজের বিভিন্ন সমস্যা ও সংকট নিয়ে তিনি নির্ভীকভাবে লেখালেখি করেছেন। তাঁর লেখায় সামাজিক বিষয়গুলো কখনও রম্যভাবে, কখনও গভীরতায় উঠে এসেছে।
১২. দর্শন ও চিন্তার গভীরতা: শুধু হালকা রম্যরচনা নয়, তাঁর রচনায় দার্শনিক চিন্তা ও গভীর জীবনবোধ প্রকাশিত হয়, যা পাঠকদের গভীরভাবে ভাবায়।
১৩. উপমার দক্ষতা: তাঁর লেখার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল নিখুঁত উপমা ব্যবহার। সাধারণত তাঁর লেখা সরাসরি সহজ হলেও উপমার মাধ্যমে আরও অর্থবহ হয়ে ওঠে।
১৪. আনন্দময় লেখনী: মুজতবা আলীর লেখায় আনন্দ ও জীবনপ্রেম ধরা পড়ে, যা পাঠকের মনে তৃপ্তি এনে দেয়।
১৫. ইতিহাস ও সংস্কৃতির মিলন: তাঁর লেখায় ইতিহাস ও সংস্কৃতির মিলন ঘটে, যা পাঠককে শিক্ষিত করার পাশাপাশি মনোরঞ্জনও করে।
১৬. আন্তর্জাতিক বিষয়বস্তু: সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখায় আন্তর্জাতিক বিষয়গুলোও দেখা যায়, যেমন বিদেশি জীবনধারা, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং বৈশ্বিক ঐতিহ্য।
১৭. গবেষণাধর্মী রচনা: মুজতবা আলী কেবল সাহিত্যিক ছিলেন না, একজন গবেষকও ছিলেন। তাঁর অনেক রচনায় গবেষণামূলক চিন্তার প্রভাব দেখা যায়।
১৮. ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ: তাঁর লেখায় বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা ও প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে।
১৯. চরিত্রচিত্রণের নিপুণতা: তাঁর চরিত্রচিত্রণ অত্যন্ত জীবন্ত এবং প্রায়শই প্রতিটি চরিত্রকে সহজে পাঠকের মনে গেঁথে যায়।
২০. হাস্যরসের মাধ্যমে সমালোচনা: মুজতবা আলী প্রায়শই হাস্যরসের মাধ্যমে তীব্র সামাজিক সমালোচনা করেছেন।
২১. প্রকৃতি ও পরিবেশের বর্ণনা: প্রকৃতির প্রতি তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণ ছিল এবং এটি তাঁর লেখার মধ্যে প্রাঞ্জলভাবে ধরা পড়েছে।
২২. রাজনৈতিক সচেতনতা: তাঁর অনেক রচনায় তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সচেতন মন্তব্য পাওয়া যায়।
২৩. আবেগের ব্যবহার: তাঁর লেখায় আবেগের সূক্ষ্ম ও শৈল্পিক ব্যবহার লক্ষণীয়।
২৪. সাংস্কৃতিক রসায়ন: বিভিন্ন সংস্কৃতির মেলবন্ধন দেখা যায় তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্ত ও প্রবন্ধগুলিতে।
২৫. নিখুঁত ব্যঙ্গ: তাঁর লেখা ব্যঙ্গাত্মক হলেও কখনো তিক্ত বা কঠোর হয়ে ওঠেনি, বরং সূক্ষ্মভাবে হাস্যরসের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
২৬. চলচ্চিত্রীয় কল্পনা: মুজতবা আলীর লেখা এতটাই চিত্রময় যে পাঠকের কল্পনায় ছবি আঁকা হয়ে যায়।
২৭. বিপরীতধর্মী মতামত: তাঁর লেখায় প্রায়শই প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ও রাজনৈতিক মতামতের বিপরীতে নতুন চিন্তা ও দর্শনের প্রকাশ ঘটে।
২৮. সংস্কৃতির সেতুবন্ধন: মুজতবা আলীর লেখায় বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি ও ভাষার মাঝে সেতুবন্ধন তৈরির একটি প্রবল প্রবণতা ছিল।
২৯. প্রজ্ঞার মিশ্রণ: তিনি অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান লেখক ছিলেন এবং তাঁর রচনায় সেই প্রজ্ঞার মিশ্রণ সর্বদাই স্পষ্ট।
৩০. সংগীতের প্রতি ভালোবাসা: সংগীতের প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল এবং এটি তাঁর লেখার ভাষায়ও পরিলক্ষিত হয়।
সৈয়দ মুজতবা আলীর সাহিত্য রচনার বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য তাঁকে বাংলা সাহিত্যের একজন অনন্য লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর লেখার ভাষা, রসবোধ, সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান এবং বহুভাষিক দক্ষতা তাঁকে সর্বজনবিদিত করেছেন। তাঁর রচনায় সবসময় আনন্দ, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ ঘটে, যা তাঁকে বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছে।