রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, রাজা রামমোহন রায় বাংলা গদ্যকে নিমজ্জন দশা থেকে উদ্ধার করে শক্ত গ্রানাইট স্তরের ওপর স্থাপন করেছিলেন। বাংলা গদ্যের বিকাশে রামমোহনের অবদান আলোচনা করতে গেলে রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে এসে পড়ে। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন ওফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। উইলিয়াম কেরী, টমাস মার্সম্যান প্রমুখ মিশনারী এবং রাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার প্রভৃতি বাঙালী পণ্ডিতের তান্ত্রিক প্রচেষ্টায় আধুনিক বাংলা গদ্যের গোড়াপত্তন হয়। কিন্তু এদের রচনা রীতির মধ্যে কোনো সুনির্দিষ্ট আদর্শ ছিল না। দেশি, বিদেশী, প্রচলিত উপকথা, আখ্যায়িকা বা ঐতিহাসিক কাহিনীর অনুবাদ ও ভাবায়ুবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল বাংলা গদ্য। বিদেশি রাজশক্তির স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যেই নিছা ছাত্রপাঠ্য গ্রন্থ ও স্প্রীঞ্জান ধর্মের উপদেশমূলক গদ্য রচনার উক্ত দুই প্রতিষ্ঠান প্রচেষ্টায় ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়।
রামমোহন রায় প্রথম পাঠ্যপুস্তকের বাইরে প্রয়োজন নিরপেক্ষ, যুক্তিনিষ্ঠ, বিচারমূলক গদ্য রচনা প্রকাশ করেন। রামমোহন রায়ের যুগান্তকারী প্রতিভা চিহ্নিত রচনাকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিচার-বিতর্কমূলক প্রবন্ধের পর্যায়ভুক্ত করা যায়। ১৮১৬-১৮৪২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা গদ্য রচনার ক্ষেত্রে রামমোহনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব বিশেষভাবে অনুভূত হয়।
রামমোহনের রচনা মূলত বিতর্কমূলক রচনা। ইংরেজি, হিব্রু, কঙ্গলা, ল্যাটিন, আরবি, মারাঠি, হিন্দি, সংস্কৃত প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষায় সুপণ্ডিত ও শাস্ত্রবিশারদ রামমোহন বৈদান্তিক ছিলেন। তিনি তার ধর্ম ও তত্ত্বাসৃত প্রবন্ধের মাধ্যমে একেশ্বরবাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন। শাস্ত্র থেকে মুক্তি তর্কের সাহায্য নিয়ে তিনি হিন্দুধর্মের প্রমাণ প্রচলিত মূর্তিপূজার অসারতা প্রচার করেন। খ্রিস্টান ধর্ম সম্প্রদায়ের হিন্দু ধর্ম বিরোধী মতামতেরও কঠোর সমালোচনা করেন। তার সকল আলোচনায় ছিল যুক্তিভিত্তিক; এই সকল রচনায়ই যুক্তিবাদী ও গোতমপ্রত্যয়শীল রামমোহনের প্রেমময় ব্যক্তিত্ব অনুভব করা যায়। সেই কারণে সমসাময়িক অন্যান্য লেখকদের রচনা থেকে রামমোহনের রচনায় স্বাতন্ত্র্য নির্দেশ করতে অসুবিধা হয় না।
রামমোহনের রচনাগুলিকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়: ধর্ম ও তত্ত্বমূলক আলোচনা এবং সামাজিক আচার বা প্রথা বিষয়ক রচনা। রামমোহন রচিত প্রথম বাংলা গ্রন্থ যখন প্রকাশিত হয় তখন তার বয়স ছিল ৪১ বছর। জীবনের পরবর্তী ১৮টি বছর তিনি বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যকে শক্ত ভিতের ওপর স্থাপন করেছিলেন।
একেশ্বরবাদের পক্ষের রামমোহনের প্রথম রচনা “বৈদান্ত-গ্রন্থ” (১৮১৫) ও “বেদান্তসার” (১৮১৬), পুস্তিকা দুটি অনুবাদ হলেও গুরুত্বের দিক থেকে মৌলিক রচনায়ই সমান। বিশেষত “বেদান্তসার” প্রেমের ভূমিকায় সমকালীন বাংলা গদ্য ভাষার অনুষ্ঠানিকতার প্রসঙ্গ উল্লিখিত করে রামমোহন বাংলা বাক্য গঠন বিধির আদর্শ সম্পর্কের মূল্যবান মন্তব্য করেছেন। নিম্নলিখিত অন্যান্য গ্রন্থসমূহে রামমোহন প্রধানত ধর্ম বা তত্ত্ববিষয়ক আলোচনা করেছেন:
- “ভট্টাচার্যের সহিত বিচার” (১৮১৭)
- “গোস্বামীর সহিত বিচার” (১৮১৮)
- “কবিতাকারের সহিত বিচার” (১৮২০)
- “ব্রাহ্মন সেবধি ও ব্রাহ্মন মিশনারী সম্পাদনা” (১৮২১)
- “প্রতারণা প্রশ্নের উত্তর” (১৮২২)
- “ডাঃ পাদবি ও শীর্ষ সম্বাদ” (১৮২৩)
- “গুরুপাদুকা” (১৮২৩)
- “প্রণ ব্রাহ্মণপসনা” (১৮২৮) ইত্যাদি।
এগুলি ছাড়াও তিনি সংস্কৃত উপনিষদ যেমন “কেনোপনিষদ” (১৮১৬), “ঈশোপনিষদ” (১৮১৬), “কঠোপনিষদ” (১৮১৭), “মুণ্ডকোপনিষদ” (১৮১৯) ইত্যাদি অনুবাদ করেন।
অনুসরণ বিষয়ে প্রবর্তন ও নিবর্তন (১৮৯৮), সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক ও নিবর্তকের দ্বিতীয় সম্পাদ (১৮১৯), “সূভ্রমন্য শাস্ত্রীর সহিত বিচার” (১৮২০), “পণ্য প্রদান” (১৮২৩), “অঙ্কারদের সহিত মদ্যপান বিষয়ে বিচার” (১৮২৬), “জজ সহমরণ বিষণ্ণ” (১৮২৯)।
রামমোহন বাংলা ভাষার উন্নতির জন্য “গৌড়ীয় ব্যাকরণ” (১৮৩৩) রচনা করেন। এটি বাঙালীর লেখা প্রথম বাংলা ব্যাকরণ। অবশ্য এর পূর্বে তিনি ইংরেজদের বাংলা ভাষা শিক্ষার উদ্দেশ্যে “Bengali Grammar in English Language” (১৮২৬) রচনা করেন। তবে “গৌড়ীয় ব্যাকরণ” তাতে কৃত শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। চারটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত এই গ্রন্থে রামমোহন বর্ণ, স্বর উচ্চারণ পদ্ধতি, লিঙ্গ, প্রত্যয়, কারক, বিভক্তি, সমাস, ছন্দ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন।
সংবাদপত্র সম্পাদনা ও প্রকাশেও তিনি তৎপর ছিলেন। ১৮২১ খ্রিষ্টাব্দে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যৌথভাবে প্রকাশ করেন “সংবাদ কৌমুদী”। এছাড়া রামমোহন ইংরেজি ভাষায় “Brahminical Magazine” (১৮২১), বাংলা ভাষায় প্রথম “সেবাধ” এবং ফার্সি ভাষায় “মীরাতুল আকবর” (১৮২২) প্রকাশ করেন।
রামমোহনের গদ্য রচনা মূলত তর্কসাধ্য। তাঁর ভাষা বিতর্কের ভাষা। সেই ভাষার মধ্যে কিছু আবেগ বা ব্যঞ্জনা নেই। রামমোহন বাংলা গদ্যের মুক্তিতে চিন্তায় সজ্জিত করে আধুনিক মানের উপযোগী করে তুলেছিলেন। তিনি প্রথম দেশীয় রক্ষণশীল হিন্দু সম্প্রদায় ও বিদেশি খ্রিস্টান মিশনারীদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে প্রবৃত্ত হয়ে বাংলা ভাষায় বিবর্তনমূলক আলোচনার সূত্রপাত করেন। বাংলা ভাষায় যখন শৈশব অবস্থানে ছিল, রামমোহনকে নিজের প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন সময়ে ভাষা তৈরী করে নিতে হয়েছিল। তবুও, রামমোহনের গদ্যে রসের সঞ্চার হয়নি। সাহিত্যিক গদ্য তার ছিল কিন্তু কিছু ব্যবহারিক প্রয়োজনের প্রতি অতিরিক্ত লক্ষ্য রাখার জন্য, রামমোহন শেষ পর্যন্ত বিশুদ্ধ রসসৃষ্টিতে সমর্থ হননি।