বাংলা নাটক রচনায় মাইকেল মধুসূধন দত্তের অবদান: বাংলা সাহিত্যে মধুসূদন দত্তের আবির্ভাব আকস্মিক এবং প্রথমে নাট্যকার রূপে। মান্দ্রাজে অবস্থানকালে ইংরেজিতে Rizia নাটক রচনার মধ্যে দিয়ে তাঁর নাট্যসাহিত্যে প্রবেশ। ১৮৫৮ সালে পাইকপাড়া, ডামিদার সিংহদে, বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চে রামনারায়ণ তর্করত্ন অনূদিত ‘রত্নাবলী’ অভিনয়ে আমন্ত্রিত হয়ে বাংলা নাটকের দৈন্যদশা প্রত্যক্ষ করে হতাশাগ্রস্থ হয়ে বাংলা নাটক রচনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। একে একে রচনা করেন:
পৌরানিক নাটক: ১) শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯)
ঐতিহাসিক নাটক: ২) পদ্মাবতী (১৮৬০)
রূপক নাটক: ৩) কৃষ্ণকুমারী (১৮৬০)
প্রহসন: ৪) মাথা কানন ৫) বিষ না ধনুর্বন্ধন (অসমাপ্ত) ৬) একেই কি বলে সভ্যতা (১৮৬০) ৭) বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ (১৮৬০)
মধুসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকের কাহিনী মহাভারতের শর্মিষ্ঠা-দেবযানী-যযাতি গল্প থেকে গৃহীত। যদিও নাটকের নাম শর্মিষ্ঠার নামে, শর্মিষ্ঠার চরিত্র মোটেই সজীব নয়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও বাস্তবতার দিক থেকে নাটকের নায়িকা দেবযানী চরিত্র অধিকতর জীবন্ত হয়েছে। দেবযানীর পাশাপাশি শুক্রাচার্য চরিত্রটি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কাহিনীর কোথাও কোথাও কালিদাসের শকুন্তলা‘র প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা যায়। আধুনিক নাটকের প্রথম সার্থক সূচনা দেখা গেলেও নাটকে কিছু ত্রুটি লক্ষণীয়। মধুসূদন নাটকে পাশ্চাত্য রীতি গ্রহণের পক্ষপাতী হলেও সংস্কৃত রীতির প্রভাবমুক্ত হতে ব্যর্থ হয়েছেন, যার ফলে নাটকের গতিবেগ আবেগ দ্বারা মন্থর হয়েছে। সংঘাতের চেয়ে বিবৃতি এখানে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। অতিনাটকীয়তা ও যাত্রা ধরনের বাগাড়ম্বরের ফলে অনেক জায়গায় নাটকীয় রস ক্ষুণ্ন হয়েছে। নাটক প্রসঙ্গে রাজেন্দ্রলাল মিত্র লিখেছেন: “তথাপি আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস আছে, যে সকল বাংলা নাটক এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে তন্মধ্যে ‘শর্মিষ্ঠা’কে সর্বশ্রেষ্ঠ বলিবেন সন্দেহ নাই।”
মধুসূদন গ্রীক পুরাণের প্রসিদ্ধ গল্প ‘Apple of Discord’ অবলম্বনে দেশীয় ছাঁচে পাশ্চাত্য গল্পকে সাফল্যের সঙ্গে সংযোজন করেছেন। এই নাটকে শচী হয়েছেন জুনো, মুরালা-প্যালাস, রতি-ভিনাস, ইন্দ্রনীল-প্যারিস এবং পদ্মাবতী হয়েছেন হেলেন। এখানে সংস্কৃত নাট্য প্রভাব এখনও বিদ্যমান। আলঙ্কারিক বাকরীতি ও নানা মুদ্রাদোষ এখানে রয়ে গেছে। তবে, মধুসূদন অমিত্রা ক্ষর ছন্দ প্রয়োগ করে কাব্যে ছন্দোগত বিপ্লবের সূচনা করেছেন। রামগতি ন্যায়-রত্নের মতে, পদ্মাবতীর উপর শকুন্তলা‘র স্পষ্ট প্রভাব বিদ্যমান। পদ্মাবতীর সঙ্গে ইন্দ্রনীলের মিলন ও বিচ্ছেদ এবং অবশেষে অঙ্গিরার আশ্রামে তাদের পুনর্মিলন সব ঘটনায় শকুন্তলা‘র সাদৃশ্য বর্তমান। নাটক রচনা করতে জাত প্রাজ্ঞ মধুসূদন উপলব্ধি করেন: “No real improvement in the Bengali Drama could be expected until Blank Verse was introduced into it.”