বাংলা সাহিত্যে দীনবন্ধু মিত্রের অবদান: দীনবন্ধু মিত্র বাংলা সাহিত্য ও নাট্যকলার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে তিনি যেভাবে সাহিত্যে নবজাগরণ আনেন, তা বাংলা নাটকের বিকাশে এক মাইলফলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁর রচিত নাটক ও প্রহসনগুলিতে সমাজের নানা অসঙ্গতি ও অবক্ষয় নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে, যা একদিকে যেমন সমাজের ভেতরের বাস্তব চিত্র প্রকাশ করেছে, অন্যদিকে তেমনই সেই সময়ে নাট্যধারার ভিত মজবুত করেছে।
শেক্সপিয়র তাঁর পূর্বতন নাট্যকার ক্রিস্টোফার মারলোর বহু নাটক থেকে উপাদান সংগ্রহ করে এলিজাবেথীয় যুগের শ্রেষ্ঠ নাট্যকারে পরিণত হয়েছিলেন। তেমনই দীনবন্ধু মিত্র এবং মধুসূদন দত্তও বিভিন্ন নাট্য উপাদান গ্রহণ করে মাইকেল মধুসূদন যুগের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। বাংলাদেশে সাহিত্যের মাধ্যমে যারা হাস্যরসধারা প্রবাহিত করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে দীনবন্ধু মিত্র অন্যতম। এ প্রসঙ্গে তিনি শেক্সপিয়রের প্রথম যুগের নাটক ‘The Merry Wives of Windsor’ এবং ‘Comedy of Errors’ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ‘বাংলা নাটকের ইতিহাস’ গ্রন্থে ডঃ অজিত কুমার ঘোষ বলেছেন:
“আমাদের অসঙ্গত, অসংলগ্ন, বিভ্রান্ত, বিপর্যস্ত জীবনে যেখানে যতটুকু হাস্যরসের টুকরা পড়ে আছে, তাহাই তাহার সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে ধৃত হইয়া নাটকের মধ্যে প্রকাশিত হইতেছে।”
দীনবন্ধু মিত্রের নাটকে ব্যঙ্গ আছে, আঘাত আছে, কিন্তু ব্যঙ্গের তীক্ষ্ণতা এবং আঘাতের নির্মমতা সর্বত্রই সুস্নিগ্ধ হাস্যরসের অনাবিল প্রবাহে ভারসাম্য রক্ষা করেছে।
দীনবন্ধু মিত্রের নাট্যকৃতি:
- নীলদর্পণ (1860)
- নবীন তপস্বিনী (1863)
- লীলাবতী (1867)
- কমলে কামিনী (1873)
গদ্য স্কেচ:
- সধবার একাদশী (1866)
- বিয়ে পাগলা বুড়ো (1866)
- জামাই বারিক (1872)
বাংলা নাট্য সাহিত্যে দীনবন্ধুর অবদান
১. ‘নীলদর্পণ’: সমাজের প্রতিচ্ছবি ও আন্দোলনের প্রেরণা
দীনবন্ধু মিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘নীলদর্পণ’। ১৮৬০ সালে রচিত এই নাটকটি ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদকে তুলে ধরে। নাটকটি শুধুমাত্র নাট্যরসিকদেরই নয়, তৎকালীন রাজনৈতিক আন্দোলনেও প্রচুর প্রভাব ফেলেছিল। নাটকটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাথমিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কারণ এটি সমাজের ওপর শাসকের অত্যাচারের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছিল। ‘নীলদর্পণ’-এ দীনবন্ধু বাংলার সমাজব্যবস্থা ও সেই সময়ে সাধারণ মানুষের জীবনধারাকে যথার্থভাবে তুলে ধরেছেন।
২. হাস্যরস ও ব্যঙ্গের মাধ্যমে সামাজিক সমালোচনা
দীনবন্ধু মিত্র তাঁর রচনায় শেক্সপিয়রের মতোই ব্যঙ্গ ও হাস্যরসকে সামাজিক সমালোচনার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর প্রহসনগুলিতে তিনি সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতিকে ব্যঙ্গের মাধ্যমে সমালোচনা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, ‘সধবার একাদশী’ এবং ‘জামাই বারিক’ প্রহসনে তিনি বাংলার সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংস্কার ও সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ করেছেন।
‘সধবার একাদশী’ প্রহসনে তিনি উনিশ শতকের কলকাতার শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত যুবকদের মধ্যে প্রচলিত মদ্যপান, লাম্পট্য এবং পরস্ত্রীগমন প্রথার তীব্র সমালোচনা করেছেন। ‘জামাই বারিক’ প্রহসনে ঘর জামাই প্রথার বিরুদ্ধে তাঁর ব্যঙ্গের ধার এতটাই তীক্ষ্ণ ছিল যে, তা পাঠক ও দর্শকদের মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তাঁর এই নাট্যরচনাগুলি সমাজের ভেতরের দুর্বলতাগুলিকে উন্মোচিত করেছিল, যা পরে নাট্যধারায় গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
৩. বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার প্রবর্তন
দীনবন্ধু মিত্র বাংলা নাট্যসাহিত্যে পাশ্চাত্য ধারার সঙ্গে ভারতীয় সমাজের সমন্বয় সাধন করেছিলেন। শেক্সপিয়র থেকে প্রভাবিত হয়ে তিনি তাঁর নাটকগুলোতে পাশ্চাত্য নাট্যরীতির চমৎকার প্রয়োগ করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, ‘নবীন তপস্বিনী’ এবং ‘লীলাবতী’ নাটকে তিনি রোমান্টিকতার ছোঁয়ায় বাংলা নাটকে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। যদিও ‘নবীন তপস্বিনী’ নাটকটি রোমান্সধর্মী হলেও তাতে নাট্যকারের ক্ষমতার পরিচয় তেমনভাবে ফুটে ওঠেনি। কিন্তু, ‘লীলাবতী’ নাটকে তিনি নাগরিক জীবনের জটিলতা ও দ্বন্দ্বময় কাহিনীকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছিলেন।
৪. প্রহসন রচনায় নৈপুণ্য
দীনবন্ধু মিত্র প্রহসন রচনায় বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। তাঁর প্রহসনগুলি সমাজের নানা অসঙ্গতি ও মানুষের দুর্বলতাকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছে। ‘সধবার একাদশী’ এবং ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’ তাঁর দুটি উল্লেখযোগ্য প্রহসন, যেখানে তিনি সমাজের ভণ্ডামি, কুসংস্কার, এবং অনৈতিকতার বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ করেছেন। তাঁর প্রহসনগুলিতে ব্যবহৃত ব্যঙ্গ, রসিকতা, এবং চরিত্রচিত্রণে তাঁর অসাধারণ দক্ষতা প্রমাণিত হয়েছে।
দীনবন্ধু মিত্রের সার্থকতা
দীনবন্ধু মিত্রের সাহিত্যকর্ম শুধু বাংলা সাহিত্যেরই সমৃদ্ধি ঘটায়নি, বরং তা সামাজিক পরিবর্তনেরও সূচনা করেছিল। তাঁর লেখনীতে যেমন সাহিত্যিক সৌন্দর্য আছে, তেমনই আছে সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনা। শেক্সপিয়রের মতোই তিনি নাটকের মাধ্যমে সমাজের নানা অসঙ্গতিকে তুলে ধরেছিলেন। তবে, শেক্সপিয়রের ট্র্যাজিক বোধ এবং গভীর জীবনবোধ দীনবন্ধুর নাটকে দেখা না গেলেও, তাঁর নাটকগুলি বাংলা নাট্যধারার বিকাশে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল।
দীনবন্ধু মিত্রের নাটকগুলি যে সময়ে রচিত হয়েছিল, সেই সময়ে বাংলা নাট্যমঞ্চের অবস্থা বেশ নাজুক ছিল। তাঁর নাটকগুলি বাংলার রঙ্গমঞ্চের স্থিতি ও প্রগতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গিরীশচন্দ্র ঘোষ যেমন বলেছিলেন, যদি দীনবন্ধুর নাটক না থাকত, তবে বাংলা রঙ্গালয় স্থাপনের সাহস কেউ করত না।
দীনবন্ধু মিত্র বাংলা সাহিত্যে এবং নাট্যজগতে এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যকে শুধু সমৃদ্ধিই করেনি, বরং তা সমাজের নানা অসঙ্গতি ও অবিচারকে প্রকাশ করে সামাজিক আন্দোলনেরও পথ প্রশস্ত করেছে। তাঁর রচনা বাংলা নাট্যসাহিত্যের ভিত্তি মজবুত করেছে, যা আজও প্রাসঙ্গিক ও স্মরণীয়। দীনবন্ধু মিত্র তাই বাংলা নাটকের ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন।