বাংলা নাটক রচনায় দীনবন্ধু মিত্রের অবদান: শেক্সপিয়র তাঁর পূর্বতন নাট্যকার ক্রিস্টোফার মারলোর বহু নাটক থেকে উপাদান সংগ্রহ করে এলিজাবেথীয় যুগের শ্রেষ্ঠ নাট্যকারে পরিণত হয়েছিলেন। তেমনই দীনবন্ধু মিত্র এবং মধুসূদন দত্তও বিভিন্ন নাট্য উপাদান গ্রহণ করে মাইকেল মধুসূদন যুগের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। বাংলাদেশে সাহিত্যের মাধ্যমে যারা হাস্যরসধারা প্রবাহিত করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে দীনবন্ধু মিত্র অন্যতম। এ প্রসঙ্গে তিনি শেক্সপিয়রের প্রথম যুগের নাটক ‘The Merry Wives of Windsor’ এবং ‘Comedy of Errors’ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ‘বাংলা নাটকের ইতিহাস’ গ্রন্থে ডঃ অজিত কুমার ঘোষ বলেছেন:
“আমাদের অসঙ্গত, অসংলগ্ন, বিভ্রান্ত, বিপর্যস্ত জীবনে যেখানে যতটুকু হাস্যরসের টুকরা পড়ে আছে, তাহাই তাহার সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে ধৃত হইয়া নাটকের মধ্যে প্রকাশিত হইতেছে।”
দীনবন্ধু মিত্রের নাটকে ব্যঙ্গ আছে, আঘাত আছে, কিন্তু ব্যঙ্গের তীক্ষ্ণতা এবং আঘাতের নির্মমতা সর্বত্রই সুস্নিগ্ধ হাস্যরসের অনাবিল প্রবাহে ভারসাম্য রক্ষা করেছে।
দীনবন্ধু মিত্রের নাট্যকৃতি:
- নীলদর্পণ (1860)
- নবীন তপস্বিনী (1863)
- লীলাবতী (1867)
- কমলে কামিনী (1873)
গদ্য স্কেচ:
- সধবার একাদশী (1866)
- বিয়ে পাগলা বুড়ো (1866)
- জামাই বারিক (1872)
দীনবন্ধু মিত্র রসসৃষ্টির উদ্দেশ্যে নয়, বরং একটি মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি রচনা করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের বন্ধু দীনবন্ধুর দৃষ্টিপটে সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ছিল রক্ষিত। ডাক ও তার বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারী হিসেবে তিনি যশোর, খুলনা, নদীয়া প্রভৃতি অঞ্চলের গ্রামাঞ্চলে পরিভ্রমণ করেছিলেন। ফলে তিনি প্রজাসাধারণের উপর নীলকরদের অত্যাচারের ফল প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। প্রথম সংস্করণের ‘নীলদর্পণে’ নাট্যকার তাঁর নিজের নাম প্রকাশ করেননি। কেবল লেখা ছিল— “নীলকর বিষধর-দংশনে কাতর ভাজা নিকর-ক্ষেমং করেন— কেনচিং-পথিকে নাডি-প্রনীতম।”
এখন প্রশ্ন, এই উদ্দেশ্যমূলক রচনার সাহিত্য মূল্য কতটা? বাংলার নবীন লেখকদের উপদেশ প্রদানকালে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন— যদি বুঝে থাক লেখ, দেশের হিতসাধন করবে, অর্থাৎ সৌন্দর্য সৃষ্টি করবে, তাহলে লেখ। ‘নীলদর্পণ’ সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন যে সমাজসংস্কার নাটকের উদ্দেশ্য হলেও—
“কাব্যাংশে তাহা উৎকৃষ্ট। তাহার কারণ এই যে, গ্রন্থকারের মোহময়ী সহানুভূতি সকলই মাধুর্যমণ্ডিত করিয়া তুলিয়াছে।”
‘নীলদর্পণ’ করুণ পরিণতি নাটক। সাধারণভাবে বিয়োগান্ত নাটককে ট্র্যাজেডি বলা হয়। কিন্তু বিয়োগান্ত নাটক মানেই যে তা সার্থক ট্র্যাজেডি হবে, এমনটি নয়। অ্যারিস্টটলের ‘Poetics’ গ্রন্থ অনুযায়ী, ট্র্যাজেডির মূল সুর হবে ঘটনাপ্রবাহের অনুকৃতি (imitation of an action)। ট্র্যাজেডির নায়ক উচ্চবংশীয় হবেন, সাধারণ মানুষের থেকে তার অধিক গুণাবলী থাকবে। তিনি যেমন অবিমিশ্র ভালো লোক হবেন না, তেমনিই অবিমিশ্র মন্দলোকও হবেন না। প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে তার সংগ্রাম হবে আপসহীন। তার পতন ঘটবে তার বিচারের ভুলের কারণে। পরবর্তীতে শেক্সপিয়র ট্র্যাজেডির মধ্যে নতুনত্ব যোগ করে বলেছিলেন, “Character is destiny,” অর্থাৎ ট্র্যাজেডির নায়কের চরিত্রের মধ্যেই থাকে তার পতনের বীজ।
কোনো সন্দেহ নেই নবীন মাধব নাটকের নায়ক। কিন্তু ট্র্যাজেডির নায়ক হিসেবে তার মধ্যে কোনো অভ্যন্তরীণ সংঘাত নেই। তার কোনো বিচারবিভ্রমের কারণে ‘নেমেসিস’ তাকে ধ্বংস করেছে, এমনটিও বলা যাবে না। ট্র্যাজেডির মূল হলো করুণা এবং ভয় (pity and fear), নবীন মাধবের জীবনের করুণ পরিণতির জন্য তার প্রতি আমাদের সহানুভূতি জন্মে, কিন্তু তিনি কোনো বিশ্ববিধান লঙ্ঘন করেননি যে তার প্রতি আমাদের ভয় উদ্রেক হবে। তাই তিনি যথার্থ ট্র্যাজেডির নায়ক হয়ে উঠতে পারেননি। বাস্তবিক অর্থে ট্র্যাজেডি নাটক লেখার উদ্দেশ্যে নাট্যকার লেখনী ধরেননি। বরং বাস্তব পরিস্থিতির ভয়াবহতা উদ্ঘাটনই ছিল নাট্যকারের উদ্দেশ্য। সে ব্যাপারে তিনি সফল হয়েছেন। যেমন স্টো রচিত ‘Uncle Tom’s Cabin’ বা ডিকেন্সের ‘Oliver Twist’ যেমন পাপ প্রতিষেধক সাহিত্য, ‘নীলদর্পণ’ তেমনই সেই গোত্রের সাহিত্য।
দীনবন্ধুর রোমান্স নাটক ‘নবীন তপস্বিনী’। এটি নাটক হিসেবে তেমন সার্থকতা পায়নি। রোমান্টিক এই নাটকে নাট্যকার পারদর্শিতার পরিচয় দিতে পারেননি। রমণীমোহন এবং বিদায় চরিত্র গঠনে ও সংলাপ ব্যবহারে নাট্যকার দক্ষতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। ‘লীলাবতী’ নাটকে নাগরিক জীবনের জটিলতা এবং দ্বন্দ্বময় কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। নাটকের নায়ক ললিত এবং নায়িকা লীলাবতীর প্রণয় এবং বিবাহ এ নাটকের উপজীব্য বিষয়। পাশাপাশি কিছু রঙিন চরিত্র (নদের চাঁদ কৌতুক) নাটককে প্রাণবন্ত করে তুলেছে।
দীনবন্ধু মিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক ‘কমলে কামিনী’। ঐতিহাসিক পরিবেশে, কাল্পনিক ঘটনার আশ্রয়ে এই নাটকের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। তবে অনেক স্থানে তরল হাস্যরস নাটকের গুরুত্ব হ্রাস করেছে।
প্রহসন রচনায় নাট্যকার দীনবন্ধু পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। কাহিনির অংশে ব্যঙ্গ অপেক্ষা ব্যক্তিচরিত্রের দুর্বলতার প্রতি তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গপ্রবণতা প্রকাশ পেয়েছে। ‘সধবার একাদশী’ নাটকে সেই যুগের কলকাতার উচ্চশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত যুবকদের মদাসক্তির লাম্পট্য এবং পরস্ত্রী হরণের মতো ভ্রষ্টচিত্র বর্ণিত হয়েছে। ধনীর আদুরে দুলালরা কিভাবে পাপের সিঁড়ি বেয়ে নিজেকে সর্বনাশের পথে টেনে নিয়েছে, তা এখানে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। ‘জামাই বারিক’ প্রহসনে ঘর জামাই প্রথাকে ব্যঙ্গবাণের মাধ্যমে বিদ্ধ করা হয়েছে। অভয়া এবং কামিনীর প্রণয় প্রসঙ্গে রোমান্টিকতা এবং তরঙ্গ রসের মিশ্রণে প্রহসনটিতে স্বাতন্ত্র্য এসেছে।
নাট্যকার দীনবন্ধুর সাহিত্যপ্রতিভা কেবল নাট্যভাগতে সীমাবদ্ধ নয়। ‘সুরধুনী’ এবং ‘দ্বাদশ কবিতা’ নামক দুটি কাব্য তিনি রচনা করেছেন। তবে কাব্য সাহিত্যের প্রতি তাঁর আসক্তি খুবই কম, তাই এই কাব্যদ্বয়ের তেমন বিস্তৃতি নেই।
দীনবন্ধুর নাট্যসৃষ্টি অবিকল শেক্সপিয়রের মতো, তবে সংকীর্ণতর ক্ষেত্রে। ম্যাথু আরনল্ড কীটসের কবিদৃষ্টির প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “He is with Shakespeare.” ঠিক একইভাবে দীনবন্ধু সম্পর্কে বলা যেতে পারে, “He is with Shakespeare,” যদিও শেক্সপিয়রের ট্র্যাজিক বোধ তাঁর ছিল না। জীবনরঙ্গমঞ্চের পর্দা দেখার ইচ্ছাও তাঁর হয়নি। যাহোক, বাংলা নাট্যমঞ্চের ক্রমবিকাশে তাঁর নাটকগুলির মূল্য কম নয়। গিরীশচন্দ্র ঘোষ তাঁর নাট্যপ্রতিভা সম্পর্কে বলেছেন:
“বঙ্গে রঙ্গালয় স্থাপনের জন্য মহাশয় কর্মক্ষেত্রে আসিয়া ছিলেন। মহাশয়ের নাটক যদি না থাকিত, এই সকল যুবক মিলিয়া ন্যাশনাল থিয়েটার স্থাপনের সাহস করিত না। সেই নিমিত্ত আপনাকে রঙ্গালয়ের স্রষ্টা বলিয়া নমস্কার করি।”
দীনবন্ধুর নাটকে সামাজিক অবক্ষয়, অসঙ্গতি, অনাচার এবং বিভেদময় সমাজচিত্র এমনভাবে ফুটে উঠেছে যে বাংলা নাটক ও রঙ্গমঞ্চের যে কোনো দিক আলোচনায় তাকে স্মরণ না করে আমরা পারি না।