Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

বাংলা কবিতা রচনায় মাইকেল মধুসূধন দত্তের অবদান ও সার্থকতা মূল্যায়ন কর

বাংলা কবিতা রচনায় মাইকেল মধুসূধন দত্তের অবদান: প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে আধুনিকতা কাকে বলে বা আধুনিক শব্দের অর্থ কি? আমরা আসলে আধুনিক বলতে সাধারণত বুঝি সাম্প্রতিক, এখনকার, বর্তমান কাল, অধুনাতন অর্থাৎ নতুন বা নব্য। এক কথায় যে জিনিস বিষয় কিংবা বিশ্বাস ও চেতনাবোধ বর্তমানকালে বা সাম্প্রতিক সময়ে জীবনে সমাজে, মননে-চেতনায় উপলব্ধিতে বিশ্বাসে গ্রহণযোগ্য আসে বা হয় তাকেই আমরা মূলত আধুনিক অথবা আধুনিকতা বলি।

বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ, বাংলা কবিতায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের অমর কারিগর রূপকার মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত আমাদের বাংলা কবিতার ভূবনে প্রথম আধুনিক ও কালজয়ী কবি এবং আধুনিকতার প্রবর্তক। সেদিক থেকে তার সকল সৃজনশীল রচনা সময়ের দাবিতে, সমকালের আহ্বানে, আমাদের বিশ্বাস ও চেতনার মাঝে ব্যাপকতর গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের বিশাল সৃষ্টিশীলতার আকাশে বৈচিত্র্যময় প্রতিভার অধিকারী ক্ষণজন্মা কালজয়ী এই মহাপুরুষের হাত ধরেই বাংলা কবিতায় নবতর আধুনিকতা এসেছে। শুধু বাংলা কবিতায় বলি কেনো বাংলা সাহিত্যের যে আধুনিকতা তাও কবি মধুসূদনের এক অপার বিস্ময়কর সৃষ্টি। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।

কাজেই বাংলা কবিতায় যে আধুনিকতার রূপ, রস, গন্ধ, ছন্দ ও ভাব খুঁজে পাই তার ধারক ও বাহক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন। সমাজ-সভ্যতা, মানুষের যাপিতজীবন, ধর্ম ও বিশ্বাস প্রভৃতি বিষয়ের ওপর কবি মধুসূদনের যে চেতনা বিশ্বাস উপলব্ধিবোধ তা তিনি সুন্দর করে আধুনিকতার আদলে, রঙে ও ঢঙে বাংলা কবিতায় এবং সাহিত্যে সৃষ্ট করেছেন। আর তাই আধুনিক বাংলা কবিতার আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র অগ্রদূত হয়ে এবং প্রবতর্ক হিসেবে কবি মধুসূদন বাংলা সাহিত্যে অধিক সমাদৃত। এছাড়া তিনি যে আধুনিক বাংলা কাব্যের মহানাংক এবং একজন আধুনিক কবি তা আমাদের শিক্ষিত- বাঙালি বলতেই জানেন এবং মনে-প্রাণে মানেন। আমরা জানি কবি মধুসুদন যে সময়ে জন্মগ্রহণ করেন সে সময়ে বাংলা কবিতা অত্যন্ত জরাগ্রস্ত অবস্থার মধ্যদিয়ে কালাতিকাল পার করছিলো। বাংলা সাহিত্যাকাশে কবি মধুসূদনের আগমনে সেই জরাগ্রস্ত বাংলা কাব্য আধুনিকতার ছোয়ায় প্রাণ ফিরে পেলো ও নতুনের দোলায় উদ্ভাসিত হয়েছে। কবির নিরলস শ্রম এবং আপ্রাণ চেষ্টায় বাংলা কবিতা সাহিত্য আজ আধুনিকতায় অনেক অনেক সমৃদ্ধশালী লাভ করেছে। তিনি যেমন বাংলা কবিতায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের স্রষ্টা ও দিকপাল, তেমনি আধুনিক বাংলা কাব্যের রূপকার। কবি মধুসূদন বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে নজর দিয়েছেন কাব্যে তা আজ আধুনিকতার পরশে বিকশিত হয়ে ব্যাপক সমৃদ্ধি হয়েছে।

এ কথা সত্যি যে, মাইকেল মধুসূদনের হাত ধরে আঠারো শতকে বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সেই যে অঙ্কুর বীজ বপন করা হয়েছে তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান কাল পর্যন্ত বাংলা কাব্যে আধুনিকতার প্রসার প্রচার ঘটেছে। আজ আমরাও একই সুরে বলতে চাই যে, বাংলা কবিতায় আধুনিকতা মহাকবি মাইকেলেরই সৃষ্টি, বাংলা সাহিত্যে যে আধুনিকতা তাও মাইকেলের সৃষ্টি এবং আরো স্পষ্ট করে বলতে হয় বাংলা কবিতায় আধুনিকতা আর মহাকবি মধুসূদন যেনো একে অপরের পরিপূরক। আমরা দেখতে পাই মাইকেলের বিভিন্ন রচনায় কি কবিতায় কি মহাকাব্যে, কি নাটকে, কি প্রহসনে সবখানে মানবতাবাদী চেতনা কল্যাণবোধের প্রবলভাবে প্রকাশ ঘটেছে। তিনি মহাকাব্য রচনা করে যে সফল ও স্বার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন, সেখানেও আধুনিকতা ও বিদ্রোহের প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর রচিত কাব্যগুলি হল –

  • তিলোত্তমা সম্ভব ১৮৬০
  • ব্রজাঙ্গনা কাব্য ১৮৬১
  • মেঘনাদবধ কাব্য ১৮৬১
  • বীরাঙ্গনা ১৮৬২
  • চতুর্দশপদী কবিতাবলী ১৮৬৫

কালপুরুষ মহাকবি মধুসূদন বাংলা কবিতায় আধুনিকতার যে ধারা প্রকাশ করেছেন তা মূলত মানবিকতা অর্থাৎ মানবতাবাদের বাস্তব প্রয়াস। এখানে তার অমর সৃষ্টি মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে মানবতাবাদের যে চেতনা প্রকাশ করেছেন সেখানে একটু লক্ষ্য করলে দেখতে পাওয়া যাবে যে, লংকার অধিপতি রাবণ চরিত্রে স্পষ্ট প্রকাশ ঘটিয়েছেন একান্ত মানবতাবাদের। এছাড়া শিল্পবোধের আলোকে ভয়ঙ্কর রাবণকে মানুষের কাছে সমাজের সামনে তিনি মানবিক দৃষ্টিতে দাঁড় করিয়েছেন। পুত্র হারানো যে কতোটা কষ্টের ও শোকের এবং একজন পিতার বিলাপ কতো বেশি এই কাব্যে তা মানবিকভাবে উঠে এসেছে।

পাশাপাশি তার ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যতে দেখতে পাই সেখানে পৌরানিক অনেক নারীকে কবি তাদের কুসংস্কার অন্ধত্ব গোড়ামি ও ধর্মীয় বেড়াজাল থেকে বের করে এনেছেন এবং তাদের কণ্ঠ থেকে আধুনিকতা ও প্রগতির ছোয়ায় মানবতার কথা উচ্চারণ করিয়েছেন। উক্ত ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের মাধ্যমে সমাজে পরিবারে নিষ্পেষিত, অবহেলিত ও নির্যাতিত নারীদের মুক্তির জন্য সাহসিকতার জয়গান গেয়েছেন।

এছাড়া ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্যে কবি মধুসূদন আধুনিকতার রঙে এক বিরহের চিত্রই এঁকেছেন। এখানে কৃষ্ণ বিরহে রাধিকার হৃদয়ে পাহাড়সম বেদনা, কষ্ট ও যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন। শুধু তাই নয় এই কাব্যে রাধাকে তিনি একজন মানবী হিসেবে তৈরি করেছেন। প্রেম চিরন্তন সত্য ও ধ্রুব সেটা এই কাব্যে কবি মধুসূদন তার আধুনিক ভাব, চিন্তা ও কাব্যচেতনার এক উজ্জ্বল নিদর্শনের বহিঃপ্রকাশ।

কবির অনবদ্য সৃষ্টি ‘তিলোত্তমাসম্ভম’ কাব্যও আধুনিকতার প্রকাশ। এমনকি তার কবিতায় আধুনিকতার অন্যতম দিক হিসেবে আমরা পেয়েছি স্বাধিকার আন্দোলনের চেতনাবোধ। আর সেটা ভালো করে কবি মধুসূদন তার কবিতার মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন আধুনিকতার পরশে। তার সনেট সংকলন ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’র পরতে পরতে আধুনিকতার ছোয়া স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দেশ মানুষ প্রকৃতি এবং নদ-নদীর ক্ষেত্রেও তিনি ভালোবাসা স্বাধিকার চেতনা মূল্যায়ন করেছেন। বর্তমান বাংলা কবিতায়ও তার স্পষ্ট চিত্ররূপ দেখা যায়। আজ আমাদের বলতে মোটেও দ্বিধা নেই কবি মধুসূদনের জন্যই বাংলা কবিতা আধুনিকতার পরশে বিশ্বসাহিত্যে এক উত্তমরূপে স্থান করে নিয়েছে। ফলে বিষয় ও শিল্পের দিক থেকে বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, কবি মধুসূদনের সমগ্র কাব্যশিল্পে মূলত আধুনিকতার প্রকাশ পেয়েছে। বাংলা কবিতায় আধুনিকতার যে রূপ তা কবির অবদান। কবি মধুসূদনের জন্যই বাংলা কবিতায় আধুনিকতার রঙে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে এবং ক্রমশ সমৃদ্ধ হচ্ছে।

আর তাই বাংলা কবিতায় আধুনিকতা নিয়ে কিছু বলতে গেলে প্রথমেই কবি মাইকেলের নামটিই উচ্চারিত হবে তাতে সন্দেহ নেই। যেমনটি ঘটেছে ইংরেজ কবি টিএস ইলিয়টের ক্ষেত্রে। বিশ্ব সাহিত্যে ইংরেজ কবি টি এস ইলিয়টের কবিতায় যেমন ইংরেজ কবিতায় নতুন ও আধুনিকতা এসেছে, তেমনি আমাদের বাংলা সাহিত্যের পথিকৃত যুগস্রষ্টা কবি মাইকেল মধুসূদনের কবিতায় প্রথমে আধুনিকতা এসেছে এবং বাংলা কবিতায় যে আধুনিকতা তা মাইকেলের অমর সৃষ্টিরই বহিঃপ্রকাশ।

মোদ্দাকথা কবি মধুসূদন অমিত্রাক্ষর ছন্দের চতুর্দশপদী পত্রকাব্য মহাকাব্য গীতি কবিতা রচনা করে বাংলা কবিতায় যে আধুনিকতার অবদান রেখেছেন ও অমূল্য স্মারক নির্মাণ করেছেন তা কবিকে সাহিত্য প্রেমিদের ও নতুন প্রজন্মদের কাছে চিরভাস্মর করে রাখবে। আর সেই কারণেই বাংলা কবিতায় আজ যে আধুনিকতার শিল্পরূপ ছন্দ তৈরি হয়েছে তার সম্পূর্ণ ভাগিদার মাইকেল মধুসূদন। কেননা, জীবন চিন্তা চেতনা ভাব মনন সমকাল শিল্প বিষয়ে তার বৈচিত্র্যময় সৃষ্টিশীল রচনা আধুনিকতার বাহক হিসেবে প্রতীয়মান। বাংলা কবিতায় আধুনিকতার রূপ নির্মাণ করে কবি তার সকল রচনাতে আধুনিকার ছাপ রেখেছেন। ফলে বাংলা কবিতায় আধুনিকতার উপস্থিতি জানতে বুঝতে হলে মধুসূদনের রচনা পাঠের বিকল্প নেই। তার অমরকৃতি রচনাসমগ্র আমাদের বারবার পাঠ করতে হবে। যেহেতু মাইকেল মধুসূদন তার চিন্তা চেতনা ভাব দর্শন ব্যক্তিত্ব স্বাতন্ত্র্যবোধ প্রকাশ করেছেন কবিতায় আধুনিকতার মধ্যদিয়ে।

আধুনিক বাংলা কবিতায় কবি মাইকেলের অবদান ভূমিকা যে কতো বেশি সে বিষয়ে পন্ডিত, সুলেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক ড. আহমদ শরীফ যথার্থই বলেছেন- ‘মধুসূদন ভাবে ভাষায় ছন্দে আঙ্গিকে যা কিছুই আনলেন তা এ দেশে নতুন বটে। তবে তাতে সমকালীনতা বা স্বাদেশিকতা ছিলো না, ছিলো আধুনিকতা। মধুসূদনের আধুনিকতার এ বৈশিষ্ট্যই তাকে আজো কালপ্রবাহে চিরঞ্জীব অমর অক্ষয় অপরাজেয় করে রেখেছে। এ কথা জোর করে বলা যেতে পারে যে, আমাদের বাংলা কবিতায় আধুনিকতার অপূর্ব নির্মাণ সৃষ্টি ও কারুকার্যময় করে তুলেছেন বাংলা কবিতার মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। কবি মধুসূদন বাংলা কবিতায় সৃষ্টিশীলতায় পূর্ণ নব দিগন্তের উন্মেষ সূচনা করেছেন। জয়তু আধুনিক বাংলা কবিতা, জয়তু কবি মধুসূদন। 

তথ্যসূত্র : দৈনিক জনতা

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

অস্তিত্ববাদ, অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞার্থ : অস্তিত্ববাদের পটভূমি, অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য গুলো লিখ?

অস্তিত্ববাদ, অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞার্থ : অস্তিত্ববাদের পটভূমি, অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য গুলো লিখ?

অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা কোন

Read More
ট্রাজেডি হিসেবে সফোক্লিসের 'ইডিপাস' নাটকের সার্থকতা বিচার! ইডিপাস নাটকের শিল্পমূল্য বিচার! ইডিপাস নাটকের গঠন কৌশল

ট্রাজেডি হিসেবে সফোক্লিসের ‘ইডিপাস’ নাটকের সার্থকতা বিচার! ইডিপাস নাটকের শিল্পমূল্য বিচার! ইডিপাস নাটকের গঠন কৌশল

গ্রিক ট্রাজেডি নাটক ‘ইডিপাস’ বাংলায় অনুবাদ করেন সৈয়দ আলী আহসান। গ্রিক ট্রাজেডি যে এতটা নির্মম এবং করুণরসাত্মক হয় তাঁর বাস্তব উদাহরণ ‘ইডিপাস’ নাটকটি। রক্তের সম্পর্কের

Read More
"সোজন বাদিয়ার ঘাট" কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

“সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

ভূমিকা: বাংলা কাব্যের ভুবনে বাংলাদেশের মানসকবি জসীম উদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) আবির্ভাব বিশ শতকের তৃতীয় দশকে। তিনি রবীন্দ্র-নজরুল ও তিরিশের কবিদের বলয় ও প্রভাব মুক্ত থেকে কবিতায় এক নতুন ও ব্যতিক্রম স্বর সৃষ্টি করেছেন। সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগরচেতনা, নাগরিক জীবন ও আচার-আচরণ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তুলে এনেছেন, জসীম উদদীন সেখানে তার কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কবির বিকল্প জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ উপন্যাসধর্মী রচনা। এ কাব্যে প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। নিম্নে … “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস ১. অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যে অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এ আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস, সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। “নমু পাড়ায় পূজা পরব, শঙ্ক কাঁসর বাজে, … মুসলমানের পাড়ায় বসে ঈদের মহোৎসবে,” ২. প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যেপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে মুসলমান চাষীর ছেলে সোজন আর হিন্দু নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠরতার আলেখ্য। গ্রামের হিন্দু বালিকা দুলীর সাথে মুসলমানের ছেলে সোজনের আবল্য বন্ধুত্ব। বন্ধু থেকে আস্তে আস্তে প্রেমে পরিণত হয়। কবিতায়- “নমুদের মেয়ে আর সোজনের ভারি ভাব দুইজনে, লতার সঙ্গে গাছের মিলন, গাছের লতার সনে।“ প্রেমের তুলনায় সমাজ অতিমাত্রায় কাব্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাব্যে সামাজিক অনুষঙ্গের উপস্থাপন করেছেন কবি। কবিতাতে তিনি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষকে আসার আহ্বান করেছেন। সমাজের মানুষের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, খেলাধুলা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায় কাব্যটিতে। দুলির মায়ের কণ্ঠে সমাজের রূঢ় রূপটি প্রকাশ পায়- “পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেত পাড়ায় যে ঠেকা ভার, চূণ নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!” ৩. জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রচনা: কবি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে। শহরজীবনে বসবাস করলেও তিনি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে গ্রামে কাজ করেছেন। ফলে তিনি মানুষের সাথে মিশতে পেরেছেন এবং তাঁর জীবনবোধ ও জীবন অভিজ্ঞতা হয়েছে সমৃদ্ধ। তাঁর জীবনপদ্ধতি ব্যতিক্রমধর্মী এবং বড় কবিতার ধারক হিসেবেই তিনি পরিচিত। ৪. উপন্যাসধর্মী রচনা: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” একটি উপন্যাসধর্মী রচনা। কাব্যের কবিতাগুলো জসীম উদদীন উপন্যাসের ঢংয়ে লিখেছেন। এ যেন লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক। ৫. মৌলিক রচনাধর্মী ও অনন্য: অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় সম্পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন কাহিনী নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রাম-বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। ৬. আধুনিকতা ও উদারনীতির বৈশিষ্ট্য: সময়কে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে স্বীকার করে নিয়ে লেখা আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাণিজগতের কল্যাণকামনা করে মানবিক হওয়াও আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। এসবের সংমিশ্রণে জসীম উদদীন কবিতায় অবয়ব দিয়েছেন। হিন্দু কিশোরী দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সুজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীমউদ্দীন লিখলেন- এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে . . . এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি। ৭. চরিত্র নির্মাণে দক্ষতা: ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে লেখক চরিত্রের আমদানি করেছেন, চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং চরিত্রের পরিণতি দেখিয়েছেন। চরিত্র যেন অনুভূতির মাধ্যমে কথা বলছে। তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভাষার ব্যবহারেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ৮. কাহিনী ও ভাষা বিন্যাসে পাণ্ডিত্য: কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ৯. ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ: আধুনিক কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীমউদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলঙ্কারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলঙ্কারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ।

Read More
কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলা: বাংলা সাহিত্যের একটি চরিত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়েন। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.