উনবিংশ শতাব্দীতে নবজাগরণের বিপুল আলোড়নের তরঙ্গে বেলাগাম চেতনার নতুন আদর্শ ও গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্তের (১৮২৪-৭৩) বাংলা কাব্য ক্ষেত্রে আবির্ভাব। বাংলা কাব্যে আধুনিকতার সূচনা তার মাধ্যমেই হয়েছে। পাশ্চাত্য আদর্শে মহাকাব্য, পত্রকাব্য, গীতিকাব্য প্রভৃতি রচনা করে বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন। সমালোচক ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাই তার সম্পর্কে বলেছেন, “মধুসূদন ৭ বছরের মধ্যে ৭০ বছরের ইতিহাস এগিয়ে দিয়ে গেলেন।”
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, “আধুনিক বাংলা কাব্য শুরু হয়েছে মধুসূদন দত্ত থেকে। তিনি প্রথম ঢেউয়ের এবং সেই ভাঙনের ভূমিকা নিয়ে সাহসের সঙ্গে গড়নের কাজে লেগেছিলেন।”
বাংলা সাহিত্যের এক বিস্ময়কর প্রতিভা মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি আধুনিক যুগের প্রথম মহাকবি, প্রথম পত্রকাব্য রচয়িতা, প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক, প্রথম সনেটকার এবং প্রথম গীতিকবি বটে। বর্ণনীয় খ্যাতি অর্জনের জন্য প্রথমে ইংরেজিতে সাহিত্য রচনা করেন এবং লেখেন ‘The Captive Lady’ এবং ‘Visions of the Past’ নামক কাব্য (১৮৪৮-৪৯)। কিন্তু ইচ্ছিত যশ না পেয়ে বেথুন সাহেবের পরামর্শে এবং বন্ধু গৌরদাস বাচের অনুরোধে বাংলা ভাষায় কাব্য রচনায় প্রবৃত্ত হন। তিনি রচনা করেন:
i) তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য (১৮৬০),
ii) মেঘনাদবধ কাব্য (১৮৬১),
iii) ব্রজাঙ্গনা কাব্য (১৮৬১),
iv) বীরাঙ্গনা কাব্য (১৮৬২), এবং
v) চতুর্দশপদী কবিতাবলী (১৮৬৫)।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রথম কাব্য তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য (১৮৬৬) মহাভারতের আদি পর্বের উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত। কাব্যটির মূল বিষয় হল দেবতাদের দ্বারা সৃষ্টি তিলোত্তমার সৌন্দর্য নিয়ে দুই দৈত্য ভ্রাতা সুনন্দ ও উপসন্দের মধ্যে বিবাদ, যা শেষে তাদের নিহত হওয়ার মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। এই কাব্যের বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
i) বাংলা কাব্যে প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহার,
ii) বাংলা আখ্যান কাব্যের সূচনা, এবং
iii) অসুর চরিত্রের হৃদয়বিদারক চিত্রায়ণ যা আগে দেখা যায়নি।
মধুসূদনের দ্বিতীয় কাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ তার সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা। এটি রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ডে বর্ণিত মেঘনাদের মৃত্যু কাহিনী অবলম্বনে ৯টি সর্গে রচিত। কাব্যটির বৈশিষ্ট্য হলো:
i) গ্রীক মহাকাব্যের আদর্শে কাব্যটি পরিকল্পিত হলেও এটি কেবল সাহিত্যিক মহাকাব্য হিসেবে গড়ে উঠেছে,
ii) কাহিনীর বিন্যাস ও চরিত্রায়ণে তিনি হোমার, ভার্জিল, দান্তে, মিলটন প্রমুখকে অনুসরণ করলেও ব্যাস ও বাল্মীকির প্রভাব লক্ষণীয়,
iii) রাম-লক্ষ্মণের তুলনায় রাবণ-মেঘনাদকে মহিমান্বিত করেছেন এবং মেঘনাদের শোচনীয় পতনকে সহানুভূতির সঙ্গে চিত্রিত করেছেন, এবং
iv) কাব্যে করুন রসের প্রাধান্য এবং অমিত্রাক্ষর ছন্দের ধ্বনি মাধুর্য সুস্পষ্ট।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ একটি গীতিকাব্যধর্মী রচনা। এই কাব্যের মূল বিষয় রাধার বিলাপ এবং তার বিরহের উচ্চতা। কাব্যটির বিশেষত্ব হলো:
i) বাংলা সাহিত্যে প্রথম ode জাতীয় রচনা হিসেবে এর ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে, এবং
ii) রাধাকে মানবী রূপে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে কাব্যটির প্রভাব।
এই কাব্যটি পয়ার এবং ত্রিবেদী ছন্দের বৈচিত্র্যময় বিন্যাস ও অন্ত্যমিলের প্রবণতা দ্বারা অভিনবত্ব লাভ করেছে, যা পরম আস্বাদনীয় হয়ে উঠেছে।
প্রসিদ্ধ রোমক কবি ওভিদের Heraides বা Epistles of Heroides পত্রকাব্যের আদর্শে মধুসূদন দত্ত ভারতীয় পুরাণের উপাখ্যান নিয়ে পত্ররীতিতে রচনা করেছেন ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যখানি। ২১টি পত্ররচনার পরিকল্পনা থাকলেও, তিনি ১১টি সম্পূর্ণ এবং ৫টি অসম্পূর্ণ পত্রে কাব্যটি শেষ করেন। কাব্যের নামধারীরা উনিশ শতকের নবজাগরণ প্রসূত দৃঢ়তা নিয়ে বিরুদ্ধ শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রকাশ করেছেন, তাই কবি তাদের ‘বীরাঙ্গনা’ বলে অভিহিত করতে চেয়েছেন। এই কাব্যের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
- এর উৎস পৌরাণিক সাহিত্য থেকে, তবে মূল আদর্শ পাশ্চাত্যের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এবং উনবিংশ শতাব্দীর নারীজাগরণ।
- এই কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রয়োগে নাটকীয় ধর্ম ফুটে উঠেছে, তাই অনেকে একে নাটকীয় একোক্তি বলেছেন।
- তিলোত্তমায় যে অমিত্রাক্ষরের সূচনা, মেঘনাদবধ কাব্যে তার পূর্ণ বিকাশ এবং বীরাঙ্গনায় তার চরম পরিণতি দেখা যায়।
- কাব্যটির বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা, সমকালীন জীবনের প্রতিফলন, চরিত্রচিত্রণ, ভাষা-ছন্দ-অলংকারের কারুকার্য প্রশংসনীয়।
ফ্রান্সের ভাসাই নগরে অবস্থানকালে কবি পেত্রার্ক, মিলটন, এবং শেকসপিয়রের আদলে বাংলা সনেট রচনা করেন এবং ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ নামে প্রকাশ করেন। ১০৩টি সনেটের মধ্যে স্বদেশকথা, বাল্যস্মৃতি, নদ-নদী, দেব-দেউল, এবং কাব্য-কাহিনীর স্মৃতি প্রাধান্য পেয়েছে, যা কবি মধুসূদনের অন্তর্লীন আত্মা ও মর্মার্থ উন্মোচন করেছে। এই সনেট সংকলনের বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
বাংলা কাব্য সাহিত্যে মধুসূদন দত্তের অবদান:
- মধুসূদনের কাব্য আধুনিক যুগের বার্তাবহ; বাংলা কাব্যে নবজাগরণের যুগচেতনা এবং জীবনবোধ প্রতিফলিত হয়েছে তার লেখায়।
- মধুসূদন পাশ্চাত্য কবিদের আদর্শে কাব্যের বিভিন্ন রূপ ও রীতির সূচনা করেছেন। তিনি বাংলা মহাকাব্য, গীতিকাব্য, পত্রকাব্য, এবং সনেটের প্রথম উদ্ভাবক।
- মধুসূদন বাংলা কাব্যকে পয়ার ছন্দের বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়ে অমিত্রাক্ষর ছন্দের সার্থক প্রয়োগে বাংলা ভাষাকে আধুনিক বাণী বহনে সক্ষম করেছেন।
- তার কাব্যের নায়ক-নায়িকারা পৌরাণিক চরিত্র হলেও আধুনিক যুগের ভাবধারায় উদ্ভাসিত।
- ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, স্বাধীনচিত্ততা, নারীপ্রগতি প্রভৃতি চিন্তাভাবনা তার কাব্যকে আধুনিকতার আলোকে উজ্জ্বল করে তুলেছে।
সবশেষে বলা যায়, মধুসূদন বাংলা কাব্যে পুরাণকাহিনী ও চরিত্রকে নবযুগের নতুন জীবনবোধের আলোকে, ছন্দের মুক্তি, উপযুক্ত শব্দচয়ন এবং শিল্পবোধের মাধ্যমে কাব্যের নতুন যুগের সূচনা করেছেন। এই সৃষ্টির ক্ষেত্রটি ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এভাবে মূল্যায়ন করেছেন:
“তিনি কলম্বাসের ন্যায় দুস্তর সমুদ্রপথ অতিক্রম করে নতুন মহাদেশের আবিষ্কার না করিলে সেই নবসৃষ্ট ভূমিখণ্ডে নানা বিচিত্র ছাঁদের উপনিবেশ পরম্পরা এত দ্রুত গতিতে গড়ে উঠত না।” (বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা)