বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, বাংলার নবজাগরনের অন্যতম প্রধান পুরুষ। ১৮৩৮ সালের ২৭ জুন চব্বিশ পরগণা জেলারর কাঁঠালপাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় | বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর পেশাগত জীবনে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তা তার চিন্তা ও কর্মে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাই তিনি সরকারি চাকরি করলেও সরকারি চাকুরি জীবী হিসাবে নন, বরং একজন লেখক ও হিন্দু পুনরুত্থানবাদী চিন্তাবিদ হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত | বাংলা সাহিত্যের বিকাশে বঙ্কিমচন্দ্রের ভূমিকা গরুত্বপূর্ণ । বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের যে অবদান বর্তমানে তাই আমি এই পত্রে তুলে ধরবো।
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন| তাঁর অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিভার স্পর্শে জাতি নবচেতনায় জাগ্রত হয়, সাহিত্যও সংস্কৃতি জগতে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে। সাহিত্যে বৈচিত্র আসে | জাতীয় মন্ত্রের উদগাতা সাহিত্য সম্রাট ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র |
বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন খুব মেধাবী ছাত্র। বঙ্কিমচন্দ্রের পিতা যাদবচন্দ্র প্রথমদিকে ছিলেন ব্রিটিশ উপনিবেশিক সরকারের একজন কর্মকর্তা, পরে তিনি হুগলি জেলার কালেক্টর হন। বঙ্কিমচন্দ্র বি.এ পাস করার পর পিতার পদাঙ্ক অনুসরন করে নির্বাহী চাকরিতে (সাব- অর্ডিনেট এক্সিকিটিভ সার্ভিস) এ যোগ দেন এবং পরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর এর পদে চাকরি করেন। ৩০ বছরের ও বেশি সময় ধরে বঙ্কিম চাকরিতে নিযুক্ত থাকেন, এবং শেষে ১৮৯১ সালের সেপ্টেম্বরে অবসর গ্রহণ করেন| এই সময় তিনি ব্রিটিশ সরকার রায়বাহাদুর এবং ১৮৯৪ সালে কম্প্যানিয়ন অফ দ্য মোস্ট এমিনেন্ট অর্ডার অফ দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার খেতাব লাভ করেন। শুধু সরকারি কর্মকর্তাই নয় বরং লেখক এবং বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণের অন্যতম মুখ হিসাবেই তিনি অধিক প্রখ্যাত । মাত্র ১১ বছর বয়সে ১৮৪৯ সালে বঙ্কিমচন্দ্রের বিয়ে হয়, কিন্তু ১৮৫৯ সালে তাঁর প্রথম পত্নীর মৃত্যু হয়। তারপর ১৮৬০ সালে চৌধুরী বংশের কন্যা রাজলক্ষী দেবীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এর পর রাজলক্ষী দেবীর সঙ্গে তাঁর সংসার জীবন কাটে। সরকারি চাকরির সঙ্গে সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যের আঙিনায় ছিল আনাগোনা | মধুসূদনের মতো প্রথম বয়সে বঙ্কিমচন্দ্র ও ইংরেজির মোহে বিভ্রান্ত হয়, তারফল সরুপ আমরা তার প্রথম উপন্যাস ইংরেজিতে পেয়ে থাকি। কিন্তু শেষে তাঁর মোহ ভঙ্গ হয় | বঙ্কিমচন্দ্রই বাংলা ভাষাকে প্রথম সত্যিকারের মর্যাদা দিয়েছিলেন।
তাঁর রচনা ‘বঙ্কিমী শৈলী বা বঙ্কিমী রীতি’ নামে পরিচিত। তিনি ছদ্মনাম হিসাবে ‘কমলাকান্ত’ নাম বেছে নিয়েছিলেন । তাকে বাংলা উপন্যাসের জনক বলা হয়। এছাড়াও তিনি বাংলা সাহিত্যের সম্রাট হিসেবে পরিচিত। শেষ জীবনে বঙ্কিমচন্দ্রের শারিরিক অবস্থা তেমন একটা ভালো কাটে নি। ১৮৯৪ সালের মার্চ মাসে তাঁর বহুমূত্র রোগ হয়। এবং এই রোগেই ঐ একই সালের ৬ই এপ্রিল তাঁর মৃত্যু হয়।
বঙ্কিমচন্দ্র ও তাঁর সাহিত্য : বঙ্কিমচন্দ্র অল্প বয়সেই লেখালেখি শুরু করেন। সমগ্র জীবনে বঙ্কিমচন্দ্র ৪২ বছরের সাহিত্য সাধনা করেন। ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে শেষজীবন পর্যন্ত ব্যাপ্ত ছিল এই ৪২ বছর। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩৮ টি । বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর মেধা ও বুদ্ধিমত্তায় যেমন তিনি পেশাগত জীবনে সাফল্য লাভ করেছিলেন, সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রেও তেমনি খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার শীর্ষদেশ স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছিলেন | একই সঙ্গে উপন্যাস, প্রবন্ধ, এবং বিচিত্র ব্যক্তিগত রচনাধর্মী গ্রন্থ- নানা ধরনের সৃষ্টি সম্ভার তাঁর মতো বিরল প্রতিভাব স্বাক্ষর গ্রহন করেন। সাহিত্যসৃষ্টিতে তাঁর নিজস্ব শৈলী সমকালীন পর্বে এতটাই জনপ্রিয় হয়েছীল যে, পরবর্তীকালে বিখ্যাত হয়ে ওঠা অনেক লেখকই তাঁদের সাহিত্য জীবনের প্রথমপর্বে বঙ্কিমচন্দ্রের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন |
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত ‘সংবাদ প্রভাকর’- এ কিছু গদ্য এবং পদ্য রচনা দিয়েই বঙ্কিম চন্দ্রের সাহিত্য সাধনায় হাতে খড়ি। ১৮৬৪ সালে তিনি ‘Rajmohan’s wife’ নামে ইংরেজিতে একটি উপন্যাস লেখেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁর সাহিত্যজীবন শুরু হয় ১৮৬৫ সালে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাস প্রকাশের মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় উপন্যাস ‘কপালকুন্ডলা’ প্রকাশিত হয় ১৮৬৬ সালে। তিন বছর পরে প্রকাশিত হয় তৃতীয় উপন্যাস ‘মৃণালিনী’ । এরপর তাঁর উপন্যাস রচনায় সাময়িক বিরতি দেখা যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রায় সব উপন্যাসই ইংরেজি, জার্মান, হিন্দি, কানাড়া, তেলেগু প্রভৃতি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। ইংরেজি বাংলা মিলিয়ে তাঁর উপন্যাস সংখ্যা মোট ১৫ টি। তাঁর এই সব উপন্যাসের কাহিনী বিন্যাস, চরিত্র চিত্রণ, বিষয় ভাবনা বাংলা সাহিত্যে শুধু নয়, ভারতীয় উপন্যাস সাহিত্যের আদর্শ হয়ে আছে। তাঁর উপন্যাস গুলির নাট্যরূপ হয়েছে মঞ্চে, হয়েছে চলচ্চিত্র | ভাষা ও উপন্যাসের কাঠামো তৈরির বিষয়ে তিনি ছিলেন পথপদর্শক। রাষ্ট্রীয়,
ধর্মীয়, সামাজিক ও শিক্ষামূলক উন্নতির সব রকম প্রয়াসে অবিরাম লেখে গেছেন তিনি | ঐতিহাসিক, রোমান্টিক পারিবারিক- এই তিন ধারায় উতসারিত বঙ্কিমচন্দ্রের আখ্যান গুলি সমসাময়িক ও পরবর্তী সাহিত্য ও জীবনের ওপর অপরিসীম প্রভাব বিস্তার করেছে। উপন্যাস ছাড়া উল্লেখযোগ্য অনেক প্রবন্ধও বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন । তিনি বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের একজন দ্রুপদী শিল্পী ছিলেন। তিনি বিবিধ প্রসঙ্গ অবলম্বন করে প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাঁর প্রবন্ধের মধ্যে দিয়ে তাঁর বহুদর্শী অভিজ্ঞতার ফলশ্রুতি গভীর ধ্যান ও ধারণার তীক্ষ্ণ সৃষ্টি এবং গবেষণা ও রশ বোধের সম্মুখ পরিচয় লাভ করা যায়। বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের একজন প্রজ্ঞাবান শীর্ষস্থানীয় প্রবন্ধ লেখক | প্রবন্ধ ধর্মের সর্বক্ষণিক তার রচনায় পুরীস্ফূর্তি লাভ করেছে । বঙ্কিমচন্দ্র সুপন্ডিত চিন্তাশীল মনীষী ব্যক্তি। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্য গভির ভাবে অনুশীলন করেছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের পান্ডিত্য চিন্তাশীলতা ও সাহিত্যিক মূল্যায়নের স্বকীয়তার সাক্ষর তার প্রবন্ধের সর্বত্র লক্ষ্য করা যায় |
বাংলা সাময়িকী সাহিত্যের প্রসারে ও বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান অসামান্য। তাঁর সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার মাধ্যমে একটি নতুন লেখকগোষ্টির আবির্ভাব ঘটে জাতীয়তার তথা জাতীয় সাহিত্যের প্রথম অঙ্কুর তাঁর এই ‘বঙ্গদর্শনে আত্মপ্রকাশ করে। এই জাতীয় সাহিত্যের কর্ণধার বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্যের উদ্দেশ্যবাদের সফল শিল্পী হিসাবে নিদর্শন হয়ে আছে। তাঁর এই উদ্দেশ্যমূলক সাহিত্য আজও কালোত্তীর্ণ ও শ্বাশ্বত হয়ে আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। সাহিত্য রচনার শেষ দিকে বঙ্কিমচন্দ্র সৃজনশীল সাহিত্য চর্চার চেয়ে হিন্দু ধর্মের প্রকৃত স্বরুপ উদঘাটনের প্রতিই বেশী মনোযোগ দেন। বাংলা সাহিত্যের সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একজন খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক হিসেবে পরিচিত হলেও পরিণত বয়স পর্যন্ত কবিতা ও তিনি লিখেছেন। সাহিত্য জীবনের শেষদিকে বঙ্কিমচন্দ্র সৃজনশীল সাহিত্যচর্চার চেয়ে হিন্দু ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ উদ্ঘাটনের প্রতিই বেশী মনোযোগ দেন। এছাড়া চমকপ্রদ ছিল তাঁর সাহিত্য জীবন, তিনি ছিলেন একনিষ্ট দেশ প্রেমিক | তাঁর লেখা ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস দেশবাসীকে গভীরভাবে স্বদেশিকতায় প্রেরণা দিয়েছিল। তাঁরই লেখা বন্দেমাতরম গান আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে পরিণত হয়েছে।
বঙ্কিম সাহিত্যের গ্রন্থ তালিকা উপন্যাস
- Rajmohan’s wife (১৮৬৪)
- দুর্গশনন্দিনী (১৮৬৫)
- কপালকুন্ডলা (১৮৬৬)
- মৃণালিনী (১৮৬৯)
- বিষবৃক্ষ (১৮৭৩)
- ইন্দিরা (১৮৭৩)
- যুগলাঙ্গুরীয় (১৮৭৪)
- চন্দ্রশেখর (১৮৭৫)
- রাধারানী (১৮৮৬)
- রজনী (১৮৭৭)
- কৃষ্ণকান্তের উইল (১৮৭৮)
- রাজসিংহ (১৮৭২)
- আনন্দমঠ (১৮৮২)
- দেশী চোধুরানী (১৮৮৪)
- সীতারাম (১৮৮৭)
প্রবন্ধ গ্রন্থ
- লোকরহস্য (১৮৭৪)
- বিজ্ঞানরহস্য (১৮৭৫)
- কমলাকান্তের দপ্তর (১৮৭৫)
- বিবিধ সমালোচনা (১৮৭৬)
- সাম্য (১৮৭৯)
- কৃষ্ণচরিত্র (১৮৮৬)
- বিবিধ প্রবন্ধ (১ম খন্ড ১৮৮৭, ২খন্ড ১৮৯২)
- ধর্মতত্ত্ব অনুশীলন (১৮৮৮)
- শ্রীমদ্ভগবদগীতা (১৯০২)
সম্পাদনা
• বঙ্গদর্শন পত্রিকা (১৮৭২-১৮৭৬)
সত্য ও ধর্মই হল বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য সাধনার একমাত্র লক্ষ্য। আমরা দেখতে পাই একদিকে তিনি সৃষ্টি করেছেন| অন্যদিকে তিনি সিহিত্যের আঙিনার অবাঞ্ছিত জঞ্জাল পরিষ্কার করেছেন। আমাদের জীবনের ত্রুটি বিচ্যুতি ও অসঙ্গতির প্রতি তিনি দৃষ্টিপাত করেছেন এবং অপসারনের পথ নির্দেশ করেছেন তার সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে। মানুষের হিতসাধনের জন্যই তাঁর এই সারস্বত সাহিত্য সাধনা।