বাংলা ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান: বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা যেমন গান, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ ও উপন্যাসের মধ্যে ছোটো গল্পও একটি বিশেষ শাখা । ছোট গল্পে পরিবেশ বর্ণনা, প্লট, চরিত্র, সংলাপ ইত্যাদি যখন মানুষের জীবনের কাহিনীকে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলে তার মধ্যে থেকে ভার অর্থ বা ভাষ্য প্রকাশ করা হয় । জীবনের এই বাস্তবতা ছোটো গল্পের মাধ্যমে পাঠকের কাছে বাস্তব বলে প্রতীয়মান হয় ।
বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের আবির্ভাব ঘটে 1874 সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে, তাঁর প্রথম ছোটো গল্প ‘ভিখারিনী’ 1874 সালে ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তবে এটি কিন্তু সাহিত্যের আঙিনায় সার্থক ছোটো গল্পের মর্যাদা পাইনি, এর পর 1999 সালে ‘হিতবাদী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘দেনা পাওনা’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটো গল্পের মান্যতা দেওয়া হয়। অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটো গল্পকার হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ছোটো গল্পের আবির্ভাব বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কালের ঘটনা, সৃজন গদ্য সাহিত্যের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় শিল্পরূপ । ছোটো গল্প বা short stories যাকে সহজ করে বলা যেতে পারে সংক্ষিপ্ত গদ্য আক্ষায়িকা । যদিও ছোটো গল্প রচনার বা শোনার অভ্যাস অতি প্রাচীন স্বতন্ত্র সাহিত্য রূপে স্বীকৃতি পেয়েছে । বাংলা সাহিত্যের ছোটো গল্পের পথিকৃত ও শ্রেষ্ঠ শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের তুচ্ছ জীবনের ভিতরে স্বতন্ত্র বেদনার যে গোপনে প্রবাহ তাকে সামান্য অন্তদৃস্টিতেও কাব্যসৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোটো গল্পগুলিতে । বাংলা ভাষায় ছোট গল্প ইতিমধ্যে শাতায়ু কিংবা তারও বেশি বয়সী । “বঙ্গ দর্শন” থেকে শুরু করে ‘হিতবাদি’, ‘ভারতী’, ‘সাধনা’, ‘সবুজপত্র’, ‘বিচিত্রা’, ‘সাহিত্য প্রবাসী’, ‘কল্লোল’, ‘কালিকলম’ ইত্যাদি সাহিত্য তথা সাময়িক পথের ভূমিকাতে ভরপুর আবাদ হয়েছে বাংলা ছোটো গল্পের ।
কবি পরিচিতি
বাংলা সাহিত্য জগতের শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 1268 সালের 25 সে বৈশাখ (07 may 1961) কলকাতার জোড়াসাঁকোর অভিজাত ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন । জমিদার মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর স্ত্রী সারদা সুন্দরী দেবীর অষ্টম সন্তান হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।
ছোটো গল্পের স্বরূপ ও সংজ্ঞা
ছোটো গল্প সম্পর্কের বিভিন্ন কবি সাহিত্যিক সমালোচকরা নিজের নিজের চিন্তা ধারা বা মতবাদ প্রকাশ করেছেন । যেমন-
Brander Mathews লিখেছেন
“The short story fulfils the three units of the French classical drama; it shows on action, in on place, one the day. A short story deals with a single character, a single event, a single emotion or the series of emotions called fourth by a single situation. ”
অধ্যাপক উজ্জ্বল মজুমদার জানিয়েছেন, ছোটো গল্প হলো এমন এক কাহিনী, যা কোনো ঘটনা, পরিবেশ বা মানসিকতাকে নির্ভর করে একটি ভাবগত ঐক্যের ভাবগত গভীর প্রতীতি ক্রমশ নাটকীয় শীর্ষদেশ স্পর্শ করে পাঠকের মনোভূমিতে ছাড়িয়ে পড়ে ।
ছোটো গল্প সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ বা সংজ্ঞা প্রকাশ হলেও একুশ শতকে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে সংজ্ঞা দিয়েছিলেন, পাঠক বা সমালোচকরা সেই সংজ্ঞারই অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন ।
1894 সালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘সোনারতরী’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘বর্ষবাসন’ কবিতায় তিনি সুন্দর ভাবে ছোটো গল্পের সংজ্ঞা দিয়েছেন-
“ছোটো প্ৰাণ ছোটো ব্যথা/ছোটো ছোটো দুঃখ কথা
নিতান্তই সহজ সরল ।
সহস্র বিস্তৃতি রাশি/ প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু-চারিটি অশ্রু জল ॥
নাহি বর্ণনার ছোটা, ঘটনার ঘনঘটা
নাহি তত্ব নাহি উপদেশ ।
অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে ।
শেষ হয়েও হইলো না শেষ ॥
জগতের শাত শত। অসমাপ্ত কথা যতো
আকালের বিচ্ছিন্ন মুকুল ।
অজ্ঞাত জীবন গুলা/ অখ্যাত কীর্তির ধুলা, কত ভাব, কত ভুয়ভুল ॥
সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা
বাংলা সাহিত্যে এমন কোনো শাখা নেই, যেখানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা নেই । একাধারে তিনি যেমন কবি, অন্যদিকে তিনি গল্পকারও বটে । ছোটো গল্পের ক্ষেত্রে পাঠক সমাজের কাছে তাঁর ভূমিকা অপরিসীম । গল্প, উপন্যাস, নাটক, গান, প্রবন্ধ, কবিতা এমন সমস্ত ক্ষেত্রেই তিনি নিজের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন । তাই তো রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলা হয়-
“তোমার পায়ের পাতা, সবখানেই পাতা কোথায় রাখিব প্রণাম”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একশোরও বেশি ছোটো গল্প লিখেছিলেন । তাঁর এই গল্পগুলোকে টিনটি পর্বে বিরক্ত করা হয়েছে –
1791 সাল থেকে 1901 সাল পর্যন্ত লেখা গল্পগুলোরকে “হইতবাদী” ও “সাধনা” পত্রিকার যুগ বলা হয়।
1914 সাল থেকে 1930 সাল পর্যন্ত লেখা গল্পগুলোরকে “ভারতী” ও “সবুজপত্র” পত্রিকার যুগ বলে চিহ্নিত করা হয় ।
1930 সাল থেকে 1940 সাল পর্যন্ত লেখা গল্পগুলোরকে “তিনসঙ্গীর” যুগ বলা হয় ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই তিন পর্বের গল্পের মধ্যে সমাজের তিনটি দিককে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন
প্রথম পর্বের গল্পের মধ্যে আছে বিচিত্র অনুভূতি, রোমান্টিকতা ও নিঃসর্গপ্রতি ।
দ্বিতীয় পর্বের গল্পগুলির মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে যুক্তি, মনন, নারীর অধিকার ও বুদ্ধিবাদ।
সর্বশেষ তৃতীয় পর্বের গল্পগুলোর
প্রাধান্য পেয়েছে মনন অনুভূতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটোগল্প লেখার প্রেরণা
সমস্ত সার্থক মানুষের সার্থকতার পিছনে অবশ্যই কারো না কারো ভূমিকা থাকে । আমাদের প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম
নয় । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বৌদি অর্থাৎ কাদম্বিনী দেবীই ছিলেন তাঁর প্রেরণাদাত্রি বা অধিষ্ঠাত্রী দেবী৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা প্রিন্স দারকানাথ ঠাকুর ছিলেন জমিদার । তাই জমিদারি কাজ কর্ম দেখা সোনার জন্য প্রায়সই তাকে বিভিন্ন জায়গায়, গ্রামে গর্জে, মাঠে ঘাটে, যেতে হয়েছিল ।
আর এই জমিদারি কাজ কর্মের জন্য তাঁকে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে মেলা মেশা, ওঠা বসা, কথা বার্তা বলতে হয়েছে, প্রত্যক্ষ ভাবে দেখছেন গ্রামের সাধারণ পরিবারের মানুষদেরকে । প্রত্যক্ষ করেছেন কৃষকের শিশুদের আচার আচরণ, কাজ কর্ম, খেলা ধুলো। এই সমস্ত ঘটনাগুলো যেনো কবির মনে দাগ কেটে যায় । ছোটোগল্প লেখার প্রেরণা প্রসঙ্গে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন-
“শিলাইদহে পদ্মার বলোট ছিলাম আমি একা ।
বোট ভাসিয়ে চলে যেতুম পদ্মার থেকে পাবনার কোলের ইচ্ছামতিতে, ইচ্ছামতি থেকে বিড়াল হুড়ো সাগরে, চলন বিলে, আনাইয়ে, নগর নদীতে, যমুনা পেরিয়ে সোজাদপুরে ….. আমার গল্প লেখার ফসল ফলেছে আমার গ্রাম থেকে গ্রামান্তরের পথে
ফেরা এই অভিজ্ঞতার ভূমিকায় ।
প্রত্যক্ষ দর্শনের মাধ্যমেই যেহেতু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে গল্প লেখার প্রেরণা জন্মেছিল, তাই তাঁর বেশিরভাগ গল্পের ক্ষেত্রেই বাস্তব জীবনের চিত্র ফুটে উঠেতে দেখা যায়। তাঁর লেখা গল্পগুলো পাঠ করে মনে হয় যেনো বাস্তবে চরিত্রগুলো হয়তো বা চেনা বা দেখা ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটিতে যদি আমরা আলোকপাত করি সেখানে দেখব বারো তেরো বৎসরের এক বালিকা রতনকে I এই বালিকাকে কিন্তু লেখক প্রত্যক্ষ ভবে দেখছেন । বাস্তবের এই রতনকে কেন্দ্র করে তাতে কল্পনার মিশ্রণ ঘটিয়ে সুন্দর করে ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটাকে উপস্থাপন করেছেন পাঠক সমাজকে ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটো গল্প সম্পর্কে প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় ‘রবীন্দ্র জীবনী’ গ্রন্থে বলেছেন-
” এই সব গল্পের নায়ক নায়িকারা…….. কবির চোখে দেখা মানুষ, কানে শোনা তাদের বাণী । উত্তর বঙ্গের জমিদারিতে ও নদীপথে বড়াবর সময় বিচিত্র লোকের সংস্পর্শে তাঁকে আসতে হয়৷ যে সব সমস্যা নিয়ে গল্প সৃষ্ট, তাহর অনেকটাই
সেই সব মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সংগ্রাম কাহিনী, দুঃখের ইতিহাস ।”
বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা অপরিসীম । তিনি তার একান্ত প্রচেষ্টায় খুব সুন্দর করে বাংলা ছোটোগল্পকে পাঠক সমাজের সামনে উপস্থাপন করেছেন পরবর্তী কালে আরো অনেকেই রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ বা অনুকরণ করেছেন, অনেকে আবার নিজেদের প্রচেষ্টায়ও পাঠকের সামনে ছোটো গল্প উপস্থাপন করেছেন । তবে বাংলার প্রথম শ্রেষ্ঠ ও সার্থক ছোটোগল্পকার হলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।
Sources: Subash Mondal, Dr. Gouri Bepari and Dr. Parbati Bepari
সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ
অস্তিত্ববাদ অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা