Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta
Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

বাংলা চিত্রকলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান ও সার্থকতা মূল্যায়ন কর

বাংলা চিত্রকলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেবল একজন কবি এবং সাহিত্যিক হিসেবেই পরিচিত নন, বরং তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। কাব্য, সাহিত্য, নাটক, অভিনয়, সঙ্গীত, এবং চিত্রাঙ্কনের মতো নানা শাখায় তার অবদান ছিল অনস্বীকার্য। তাঁর প্রজ্ঞা ও প্রতিভার গভীরতা তার শিল্পকর্মের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের শিল্পকর্মে যে ঐশ্বর্য এবং গভীরতা রয়েছে, তা শুধুমাত্র তার সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং তার চিত্রকর্মেও সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের প্রায় প্রতিটি মুহূর্ত বিশ্বমানবতার সেবায় নিবেদিত ছিল। ১৯১৩ সালে, সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভের মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হন। এই পুরস্কারটি তিনি লাভ করেছিলেন তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘গীতাঞ্জলী’র জন্য। ১৯৪১ সালের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ইংরেজি) তার মৃত্যুর দিন। তাঁর জীবনের সমাপ্তি হলেও, তাঁর শিল্পকর্ম ও সৃজনশীলতা আজও মানুষের মনের গভীরে অমলিনভাবে বিরাজমান।

চিত্রকলায় রবীন্দ্রনাথ:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিত্রকলার জগতে একটি উল্লেখযোগ্য নাম। তার আঁকা ছবির সঠিক সংখ্যা জানা কঠিন, তবে গবেষকদের মতে, সাহিত্য পাণ্ডুলিপির কাটাকুটিতে সৃষ্ট ছবিগুলির বাইরে তার আঁকা ছবির সংখ্যা প্রায় ২,০০০-এর কাছাকাছি হতে পারে। রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা আধুনিক চিত্রকলার এক অনন্য মুক্তপীঠ। কাব্য-সাহিত্যের মতোই, তার চিত্রকলা শৈলীরও অতি সাবলীল প্রবাহমানতা বিদ্যমান। তাঁর ছবিগুলিতে বিষয়গত ভাবনার চেয়ে ভাবগত ভাবনার স্পষ্টতা বেশি লক্ষ্যণীয়। এর ফলে, তার চিত্রকর্ম বহুমাত্রিকতা লাভ করেছে।

চিত্রাঙ্কনের শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ প্রাকৃতিক বিষয় এবং বস্তুর হুবহু চিত্রণ পরিহার করে স্মৃতিনির্ভর কাল্পনিক চিত্র আঁকায় আগ্রহ প্রকাশ করেন। যদিও তার চিত্রকলা কিছুটা ইউরোপীয় ‘ইজম’-এর প্রভাবে প্রভাবিত মনে হতে পারে, তবুও তা ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে বিরোধিতা করেনি। তাঁর চিত্রে প্রাণীর শরীরের অস্বাভাবিক আকৃতি, যেমন পা লম্বা, মাথা ছোটো কিংবা এক প্রাণীর ঘাড়ে অন্য প্রাণীর মাথার সংযোগ, মিরো কিংবা সালভেদর দালি বা ক্যানভিনস্কির ছবির সাথে তুলনীয়। রবীন্দ্রনাথের অঙ্কনশৈলীতে সূক্ষ্ম সমাপনী ছোপের চিহ্ন নেই, তিনি প্রায়ই হঠাৎ করেই ছবি শুরু ও শেষ করেছেন।

প্রাথমিক পর্যায় ও পরিণতি:

রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্কনের প্রাথমিক পর্ব কিছুটা শ্লথগতিতে শুরু হলেও, পরিণত বয়সে তিনি একের পর এক ছবি আঁকেন। এ সময়ের আঁকা প্রাকৃতিক দৃশ্য, দেহাবয়ব ইত্যাদিতে আয়তনিক ভর ও পরিপ্রেক্ষিতের অনুসন্ধান লক্ষ্য করা যায়। তবে, রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা ইউরোপীয় ‘কম্পোজিশন’ ধর্মীতার পরিচয় বহন করে না। এক অদ্ভূত সরলতা ও ঋজুতা তার চিত্রকর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সরলরেখার প্রাচুর্য্যের পাশাপাশি বৃত্ত, ত্রিভূজ, ও হাইপ্যারাবলিক রূপের অতিরিক্ত ব্যবহার তার চিত্রকর্মকে জটিলতা না বাড়িয়েই প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ‘Nude’ ছবিগুলিতে সংযত রূপের প্রকাশ লক্ষণীয়, যা পাশ্চাত্যের অঙ্কনশৈলী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

রবীন্দ্রনাথের চিত্রের বিষয়বস্তুতে ফুল, ফল, লতা, পাতার চিত্র ছাড়াও মানুষ ও জীবজন্তুর চিত্র রয়েছে। নারীর ডিম্বাকৃতি মুখাবয়ব তার একাধিক চিত্রে প্রাধান্য পেয়েছে। প্রাকৃতিক দৃশ্যরাজিতে রবীন্দ্রনাথের ছবিতে সাধারণত কোনো প্রচলিত প্রকরণের উপস্থিতি নেই। তিনি পেলিক্যান কালি, ক্রেয়ন, জলরঙ এবং মিশ্র মাধ্যম ব্যবহার করে চিত্র আঁকেছেন। ছবি আঁকার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাধ্যবাধকতাবিরোধী মতবাদের সমর্থক।

রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য নিম্নলিখিত প্রধান দিকগুলোতে বিভক্ত:

১. বহুমাত্রিকতা ও অপ্রথাগত রূপ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রকলা বৈশিষ্ট্যপূর্ণভাবে বহুমাত্রিকতা ও অপ্রথাগত রূপের অধিকারী। তাঁর চিত্রকর্মগুলিতে আপনি দেখতে পাবেন নানা ধরনের অস্বাভাবিক রূপ-রেখা এবং অদ্ভুত সংযোগ, যেমন এক প্রাণীর গায়ে অন্য প্রাণীর মাথার সংযোজন। এই রকম বৈশিষ্ট্যগুলো তাঁর চিত্রকর্মে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে যা প্রথাগত চিত্রকলা থেকে ভিন্ন।

২. চিত্রকলা শুরু ও বিকাশ

রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার সূত্রপাত তাঁর কবিতার পাণ্ডুলিপির কাটাকুটির মধ্যে থেকেই। শুরুতে তিনি প্রাকৃতিক দৃশ্য ও বস্তুর হুবহু চিত্র অঙ্কন থেকে বিরত থেকে স্মৃতিনির্ভর ও কাল্পনিক চিত্র আঁকতে শুরু করেন। এ সময়ের পরে তাঁর চিত্রকলা আরো উন্নত ও পরিণত হয়, যেখানে প্রাকৃতিক দৃশ্য, দেহাবয়ব ইত্যাদির সঙ্গে নতুনত্ব ও আয়তনিক ভর নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা লক্ষ্য করা যায়।

৩. রূপের বৈচিত্র্য ও সরলতা

রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলায় সরল রূপের প্রচুর ব্যবহার রয়েছে। বৃত্ত, ত্রিভূজ, হাইপ্যারাবলিক রূপের আধিক্য থাকলেও, এগুলো চিত্রকর্মকে জটিল করে তোলে না বরং একটি সরলতা বজায় রাখে। বিশেষ করে তাঁর ‘নুড’ ছবি গুলির মধ্যে সংযত রূপের প্রকাশ লক্ষ্যণীয়, যা পাশ্চাত্যের অঙ্কনশৈলী থেকে ভিন্ন।

৪. নতুন দৃষ্টিভঙ্গি

রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলায় পুরনো ধারার পরিবর্তে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতির প্রভাব স্পষ্ট। তাঁকে ইউরোপীয় ‘ইজম’ ভিত্তিক চিত্রের অনুসারী মনে করা হলেও, তাঁর কাজ ভারতীয় ঐতিহ্যকে বিকৃত করেনি। তার পরিবর্তে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিত্রকর্মে প্রাচীন ভারতীয় শিল্পের ঐতিহ্য ধরে রেখে নতুনত্ব ও আধুনিকতার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন।

৫. প্রকৃতির স্থায়িত্ব ও চিরন্তনতা

রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন যে চিত্রকলার স্থায়িত্ব সাহিত্য থেকে অনেক বেশি। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে প্রকৃতির রূপ, রঙ, ও রস কখনও পরিবর্তিত হয় না, তাই চিত্রকলা তার স্থায়িত্ব ও অমরত্বের চিহ্ন বহন করে। তাঁর কাছে চিত্রকলার মাধ্যমে প্রকৃতির স্থায়ী রূপকে ধারণ করাই ছিল মূল লক্ষ্য।

৬. অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

চিত্রকলার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ কেবলমাত্র আত্মপ্রকাশই করেননি বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়েও নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তাঁর চিত্রকর্মে একদিকে যেমন শিল্পের ভেতর আত্ম প্রকাশ রয়েছে, তেমনি সামাজিক প্রতিবাদ ও মুক্তির বার্তাও রয়েছে।

৭. সৃজনশীলতার অমৃত অভিসন্ধি

রবীন্দ্রনাথ চিত্রকলার মাধ্যমে অমরত্ব লাভের জন্য তার সৃষ্ট চিত্রকর্মের প্রতি গভীর মনোযোগ দিয়েছেন। তাঁর মতে, চিত্রকলার মাধ্যমে তিনি এমন কিছু সৃষ্টি করেছেন যা কালক্রমে সমৃদ্ধ ও মহিমান্বিত হতে পারে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রকলা নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে, এবং তার কাব্য ও সাহিত্যিক অবদানের মতোই তাঁর চিত্রকলা আজও নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও অন্বেষার সুযোগ সৃষ্টি করে।

চিত্রকলা ও তার অবদান:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে শুদ্ধ ছবির স্রষ্টা ও জনক। তার চিত্রকলা আনন্দের রূপেই প্রাধান্য পেয়েছে এবং ভারতীয় সনাতনী ঐতিহ্যের পরম্পরা তার চিত্রকলায় স্পষ্টভাবে বিদ্যমান। বাংলা চিত্রকলায় রবীন্দ্রনাথের অবদান ও সার্থকতা সমালোচনার বাইরে নয়। যদিও তার চিত্রকলা আজও যথার্থভাবে মূল্যায়িত হয়নি, তবে তিনি আমাদের সাহিত্য ও চিত্রকলার আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার মূল্যায়ন:

সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ বার্ধক্যে চিত্রকলা চর্চায় মনোনিবেশ করেছিলেন, যেটি তার প্রকৃতির প্রতি অমরতার ইচ্ছার প্রতিফলন ছিল। রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা নিয়ে যে সমালোচনা ছিল, তা ধীরে ধীরে মর্ডানিটির প্রথম ধাপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সোমেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের মতে, রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্ম আজও তার নিজস্ব সৃষ্টির আত্মাকে প্রকাশ করে এবং মর্ডানিটির প্রথম প্রকাশ।

রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলায় শিল্পী হিসাবে তার অভিজ্ঞতা ও সৃজনশীলতার গভীরতা ধরা পড়েছে। রবীন্দ্রনাথের মত যে শিল্পীদের সৃষ্টির মর্মবাণী উপলব্ধি করতে পারে, তারাই প্রকৃত চিত্রশিল্পী। রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা আমাদের সামনে এক অমৃতশক্তির প্রতীক হিসেবে উজ্জ্বল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রকলা, সাহিত্য, এবং অন্যান্য সৃজনশীল কাজগুলির মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তাঁর শিল্পকর্ম আজও আমাদের প্রেরণা দেয় এবং চিত্রকলায় তার অবদান চিরকাল অমলিন থাকবে। তিনি নিজের শিল্পকর্মের মাধ্যমে আমাদের সামনে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন যা সৃষ্টিশীলতার আসল essence-কে প্রকাশ করে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১১ ফেব্রুয়ারি ১৮৮২ – ২৫ জুন ১৯২২) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ কবি, যাঁর কবিতা এবং ছড়ার জন্য তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। তাঁর জন্ম

Read More

রাজিয়া খান এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

রাজিয়া খান (১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৬ – ২৮ ডিসেম্বর, ২০১১) প্রখ্যাত বাংলাদেশী সাহিত্যিক, যিনি শুধু লেখালেখির জগতে নয়, মঞ্চ নাটকেও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তার পুরো নাম

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.