বাংলা কাব্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান: আবেগের সঙ্গে ছন্দের সমন্বয়ে কাব্যের সৃষ্টি হয়। সুষম শব্দ বিন্যাস ও কল্পনামিশ্রিত ছন্দময় চিত্রিত শিল্পকর্মকে কবিতা বলা হয়। বাংলা কাব্যের ঐতিহ্য হাজার বছরের পুরনো। সপ্তম শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু করে অসংখ্য কবির হৃদয়ের ভাষা বহন করে বাংলা কাব্য আজকের রূপ ধারণ করেছে। সুদীর্ঘ ঐতিহ্যের অনুসরণ করে বাংলাদেশের কাব্য-সাহিত্য এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। কবি জসীমউদ্দীন বাংলার কবি ও কাব্য সম্পর্কে বলেছেন:
“কবি আর কাব্য
পাঠক আর সুধীবৃন্দ
করেছে শ্রাব্য
বিশাল জগৎ— কবি আর কাব্য
সুষমামণ্ডিত অন্বয় গড়েছে দিব্য।”
বাংলা কাব্যের জগতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবির্ভাব এক বিস্ময়কর ঘটনা। বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি জাতির পক্ষে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় ঘটনা। শুধু বাংলা নয়, পৃথিবীর ভাব, অনুভূতি ও রস সৃষ্টির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের অবদান অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে উজ্জ্বল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য-সৃষ্টি দেশ, কাল ও পাত্রের সংকীর্ণ গণ্ডি অতিক্রম করে বিশ্বসাহিত্যের সভায় এক অপরূপ সৌন্দর্যে বিকশিত হয়েছে। তিনি কেবল একজন শ্রেষ্ঠ কবি নয়, ভাষা-সাধক, চিন্তাবিদ ও দার্শনিক হিসেবেও প্রসিদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন মানবতার সাধক।
বাংলা কাব্যের ইতিহাস: বাংলাদেশের কাব্য-সাহিত্যের ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। এই দীর্ঘ ইতিহাস তিন ভাগে বিভক্ত: প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক। প্রাচীনকালের কবিতার একমাত্র নিদর্শন হলো চর্যাপদ, যা বৌদ্ধধর্মীয় সহজিয়াপন্থিদের জীবনদর্শন বর্ণনা করে। মধ্যযুগের প্রারম্ভিক দেড়-দুইশ বছর, অর্থাৎ তেরো ও চৌদ্দ শতকে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং লেখ্য ভাষা হিসেবে বাংলা পূর্ণরূপে গড়ে না ওঠার কারণে বাঙালির কাব্যচর্চা অনেকটা থেমে গিয়েছিল। তবে চৌদ্দ শতকের শেষার্ধে, ১৩৫০-এর পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের কাব্য রচিত হয়েছে। মধ্যযুগের অমূল্য অবদান হিসেবে রয়েছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য, মঙ্গলকাব্য, গাথাকাব্য, জীবনীকাব্য, রোমান্টিক কাব্য এবং রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক গীতিকাব্য প্রভৃতি। উনিশ শতকের প্রথম দিকে আধুনিক কালের শুরু। আধুনিক যুগে রচিত কবিতাগুলি পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাব গ্রহণ করেছে। আধুনিক বাংলা কাব্যসাহিত্য জীবনধর্মে উজ্জীবিত এবং এতে মানুষের সুখ-দুঃখ সার্থকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
আধুনিক বাংলা কাব্যে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব: বাংলা কাব্য-সাহিত্যে বাঙালি মনীষার এক অভূতপূর্ব প্রকাশ হলো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার বিচিত্র ভাব, ভাষা ও বিষয়বস্তুর গভীরতার জন্য তিনি যেমন অনবদ্য, তেমনি সত্য, সুন্দর ও কল্যাণ এই ত্রয়ী বিশ্বজনীন ধারণার ওপরই তার সমগ্র সৃষ্টিকর্ম প্রতিষ্ঠিত। যুগসন্ধিক্ষণের কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১১-১৮৫১) তার কবিতায় মধ্যযুগীয় পয়ারমাত্রার মধ্যে আধুনিকতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। কিন্তু বাংলা কাব্য-সাহিত্যে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে মহাকবি মাইকেল মধুসূদনের হাত দিয়ে। তিনি মেঘনাদবধ কাব্যের মাধ্যমে বাংলা কাব্যে পাশ্চাত্যের অনুকরণে মহাকাব্য রচনার ধারা প্রবর্তন করেন। বিহারীলাল চক্রবর্তী আধুনিক বাংলা কাব্যে ইউরোপীয় রোমান্টিক বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিহারীলাল চক্রবর্তী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাংলা কবিতায় নতুন উচ্চতা লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ তার রোমান্টিক বৈশিষ্ট্যের আলোকেই স্বকীয় ভাবনাপ্রসূত দর্শনের সমন্বয়ে গভীর জীবনচেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ভাবনা একাধারে ‘জীবনদেবতার’ রহস্যে আচ্ছন্ন এবং দৈনন্দিন জীবন ও পারিপার্শ্বিক আবেগ-অনুভূতির সমৃদ্ধ। এর ফলে রবীন্দ্রনাথ বাংলা কাব্যে একটি স্বতন্ত্র ও সমৃদ্ধ সম্মোহন ক্ষেত্র তৈরি করেন, যার ফলে তার সমকালেই নবীন কবিদের উদ্ভব ঘটে, উল্লেখযোগ্য হলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যতীন্দ্রমোহন বাগচী প্রমুখ।
রবীন্দ্রনাথের কাব্যচর্চা: ঠাকুর পরিবারের সৃষ্টিশীল পরিবেশেই রবীন্দ্রনাথের কাব্যচর্চা শুরু হয়। বড়দের প্রেরণায় কাদম্বরী দেবী তাকে উৎসাহ দিতেন। ‘হিন্দুমেলা’ ও ‘বিদ্বজ্জন সভায়’ তিনি কবিতা পাঠ করেন। ১৩ বছর বয়সে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার প্রথম কবিতা। এ সময় তার কবিপ্রাণে সৃষ্টির প্রেরণা জাগে, ফলে তিনি লিখেন ‘বনফুল’। তার পরের সময়ে প্রকাশিত হয় ‘কবি-কাহিনী’। ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত তার রচিত কবিতার সম্ভার নিয়ে বের হয় ‘শৈশব সংগতি’। এ ছিল রবীন্দ্রনাথের উত্তর কালের প্রস্তুতি পর্ব।
বাংলা কাব্য-সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের সংযোজন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিভা বিচিত্র ও বহুমুখী হলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি একজন কবি। তার কাব্যগ্রন্থ ‘কবি-কাহিনী’ (১৮৭৮), ‘বনফুল’ (১৮৮০) ও ‘ভগ্নহৃদয়’ (১৮৮১) এ বিহারীলালের প্রভাব সুস্পষ্ট। ‘সন্ধ্যাসংগীত’ (১৮৮২) কাব্যগ্রন্থ থেকে প্রকাশিত হতে থাকে কবি রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব বাণী। এই পর্বের কাব্যগ্রন্থসমূহ—‘সন্ধ্যাসংগীত’, ‘প্রভাতসংগীত’ (১৮৮৩), ‘ছবি ও গান’ (১৮৮৪)—এর মূল বিষয়বস্তু ছিল মানবহৃদয়ের বিষন্নতা, আনন্দ, মর্ত্যপ্রীতি ও মানবপ্রেম। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত ‘মানসী’ এবং পরবর্তীকালে প্রকাশিত ‘সোনার তরী’ (১৮৯৪), ‘চিত্রা’ (১৮৯৬), ‘চৈতালি’ (১৮৯৬), ‘কল্পনা’ (১৯০০) ও ‘ক্ষণিকা’ (১৯০০) কাব্যগ্রন্থে ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের প্রেম ও সৌন্দর্য সম্পর্কিত রোমান্টিক ভাবনা। ১৯০১ সালে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার পর রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আধ্যাত্মিক চিন্তার প্রাধান্য দেখা যায়। এই চিন্তাধারা ‘নৈবেদ্য’ (১৯০১), ‘খেয়া’ (১৯০৬), ‘গীতাঞ্জলি’ (১৯১০), ‘গীতামাল্য’ (১৯১৪) ও ‘গীতালি’ (১৯১৪) কাব্যগ্রন্থে প্রকাশ পায়। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে রবীন্দ্রনাথ অধ্যাত্মলোকের পরিবর্তে মর্ত্যলোকের দিকে ধাবিত হন, যার ফলস্বরূপ প্রকাশিত হয় ‘বলাকা’ (১৯১৬)। পরবর্তীতে ‘পলাতক’ (১৯১৮) কাব্যে গল্প কবিতার আকারে তিনি নারীজীবনের সামসময়িক সমস্যাগুলি তুলে ধরেন। এরপর ‘পূরবী’ (১৯২৫) ও ‘মহুয়া’ (১৯২৯) কাব্যে কবি আবার প্রেমের আশ্রয়ে ফিরে আসেন। জীবনের শেষ দশকে কবিতার আঙ্গিক ও বিষয়বস্তু নিয়ে কিছু নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। প্রথমে প্রকাশিত হয় ‘পুনশ্চ’ (১৯৩২), ‘শেষ সপ্তক’ (১৯৩৫), ‘পত্রপুট’ (১৯৩৬) ও ‘শ্যামলী’ (১৯৩৬) নামে চারটি গদ্যকাব্য। জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে প্রকাশিত হয় ‘রোগশয্যা’ (১৯৪০), ‘আরোগ্য’ (১৯৪১), ‘জন্মদিনে’ (১৯৪১) ও ‘শেষ লেখা’ (১৯৪১) (মৃত্যুর পরে প্রকাশিত) কাব্যে মৃত্যু ও মর্ত্যপ্রীতির একটি নতুন আঙ্গিকে প্রকাশ ঘটান। কবির শেষ কবিতা ‘তোমার সৃষ্টির পথ’ মৃত্যুর আট দিন আগে মৌখিকভাবে রচনা করেছিলেন।
‘মানসী’ কাব্যে প্রেমের স্বরূপ:
‘মানসী’ কাব্যে রবীন্দ্রনাথ প্রেমের স্বরূপকে নতুনভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। এখানে প্রেমকে দেহের সীমার বাইরে, এক অনন্ত ও অপার্থিব সৌন্দর্য হিসেবে তুলে ধরেছেন। ‘নিষ্ফল কামনা’ কবিতায় প্রেমের কল্পিত রূপ সম্পূর্ণভাবে উদ্ঘাটিত হয়েছে। কবির প্রেমের প্রতিফলন তার কবিতায় এক অতুলনীয় অমৃত, স্বর্গের রহস্যের মত।
‘সোনার তরী’ কাব্যে প্রকৃতি ও মানবের প্রতি প্রেম:
‘সোনার তরী’ কাব্যে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিণত ও পরিবর্তিত করেছেন। কবি এই কাব্যে পদ্মাপাড়ের পল্লিপ্রকৃতির গভীর সংযোগ ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সোনার তরী’ কাব্য বাংলা কাব্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক কাব্য সংকলন হিসেবে বিবেচিত। কবি তার কবিতায় জীবন ও কীর্তির ক্ষণস্থায়ী অস্তিত্বের কথা বলেছেন, যা তাঁর কবিতার গভীরতা ও সৌন্দর্যকে প্রকাশ করেছে।
রবীন্দ্র কাব্যের বৈশিষ্ট্য:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্য প্রতিভার বৈশিষ্ট্য নানা দিক থেকে প্রণিধানযোগ্য। তার কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য হলো:
- বিশ্বমুখিতা ও সর্বজনীনতা: রবীন্দ্রনাথের কাব্যদেশ, জাতি ও যুগের সীমানার বাইরে বিশ্বজনীন ভাবনা ও আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তার কাব্য যেমন বিশ্বজনীন সত্যের অনুসন্ধান করেছে, তেমনি দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কারের প্রতি তার এক ধরনের নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তিনি সর্বজনীন আদর্শ ও নীতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ সংস্কারকেই গ্রহণ করেছেন।
- বিচ্ছিন্নতা থেকে পরিপূর্ণতার দিকে: রবীন্দ্রনাথের কবিতায় খণ্ড ও বিচ্ছিন্নতার পরিবর্তে পরিপূর্ণতা ও অখণ্ডতার প্রতি প্রবণতা দেখা যায়। তিনি চিরন্তন সত্য ও আদর্শের অনুসরণ করেছেন, যা যুগের সমস্যার মধ্য দিয়ে যুগাতীত অবস্থায় উন্নীত হয়েছে।
- যুগের প্রভাব: যদিও যুগের প্রভাব তার কবিতায় অনুভূতির রূপান্তর ঘটিয়েছে, তবুও তার কাব্যসৃষ্টি যুগের সীমাবদ্ধতায় আটকে থাকেনি। বরং তার কবিতা সর্বকালের ও সর্বমানবের সমস্যাকে রূপান্তরিত করেছে।
কাব্য সাধনা ও নোবেল পুরস্কার লাভ:
১. প্রথম কাব্যগ্রন্থের সৃষ্টি: ১৮৮২ সালে কলকাতা ১০নং সদর স্ট্রিটে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ ‘নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি রচনা করেন, যা তার সৃষ্টির পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে।
২. বাংলাদেশের প্রভাব: ১৮৮৩ সালের দিকে তিনি কুষ্টিয়া ও শাহাজাদপুরে জমিদারি দেখাশুনার দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। এখানকার পল্লিপ্রকৃতি ও মানুষের সাথে মিশে তার সৃষ্টিকর্ম নতুন সমৃদ্ধি লাভ করে। এই সময়েই তিনি ‘মানসী’, ‘সোনার তরী’, ‘চিত্রা’ প্রভৃতি বিখ্যাত কাব্য রচনা করেন।
৩. নোবেল পুরস্কার: ১৯১১ সালের ৭ মে রবীন্দ্রনাথের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ তাকে সংবর্ধনা দেয়। ১৯১৩ সালে ইংরেজ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস-এর ভূমিকা দিয়ে তার অনুবাদকৃত ‘গীতাঞ্জলি’ প্রকাশিত হলে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
৪. নাইট উপাধি প্রত্যাখ্যান: ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজদের দেওয়া নাইট উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিশীলতা বাংলা কাব্য-সাহিত্যে এক অপরিসীম অবদান রেখেছে। তাঁর সাহিত্যজগৎ এতটাই সমৃদ্ধ যে, তাকে বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্য অসম্পূর্ণ থাকবে। বাংলা কাব্যের সব ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথের পদচিহ্ন বিরাজমান। তাঁর কবিতায় প্রকৃতি, প্রেম, আধ্যাত্মিক ভাবনা, মৃত্যুচেতনা, জীবন দেবতা ইত্যাদি বিষয় শিল্পিত মনের তুলিতে অঙ্কিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের অবদান বাংলা কাব্যে অপরিসীম ও অনস্বীকার্য।