Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

বাংলা নাটক রচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান ও সার্থকতা মূল্যায়ন কর

বাংলা নাটক রচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব। তিনি শুধু বাংলা সাহিত্যেই নয়, বিশ্ব সাহিত্যের আঙিনায়ও এক বিশাল স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের আধুনিক নবজাগরণের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে, যা বাংলা সাহিত্যকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য প্রতিভা সর্বত্রই বিদ্যমান, আর তাঁর এই প্রভাব নাট্যসাহিত্যেও স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।

বাংলা নাট্যসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ও অবদান

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাট্যসাহিত্যে অবদান অসাধারণ। তাঁর নাটকগুলি বাংলা নাটকের গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তিনি কেবলমাত্র নাটকের কাহিনিতে মনোনিবেশ করেননি, বরং নাটকের রূপ, গঠন, এবং তার ভেতরের ভাবধারা নিয়ে নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তাঁর নাটকগুলি বিভিন্ন ধরণের আঙ্গিক ও শৈলীতে রচিত, যা বাংলা নাট্য সাহিত্যে এক অনন্য বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছে।

রবীন্দ্রনাথের নাটকের বৈশিষ্ট্য

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক বাংলা সাহিত্যে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাঁর নাটকগুলির বৈশিষ্ট্যগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, তিনি বাংলা নাট্য সাহিত্যকে একটি নতুন ধারা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন। নিচে রবীন্দ্রনাথের নাটকের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরা হলো:

১. কাব্যময়তা

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মূলত একজন কবি, এবং তাঁর এই কবিসত্তা তাঁর নাটকের প্রতিটি পরতে পরতে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর নাটকগুলোতে কাব্যের ঋজুতা এবং ভাষার সৌন্দর্য স্পষ্টভাবে বিদ্যমান। তাঁর নাটকের সংলাপ, চরিত্রের অভিব্যক্তি, এবং ঘটনাপ্রবাহ সবই কাব্যময়তার ছোঁয়ায় সমৃদ্ধ।

২. সংকেত ও রূপকের ব্যবহার

রবীন্দ্রনাথের নাটকে দৃশ্যমান ঘটনা থেকে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে রূপক এবং সংকেতের মাধ্যমে ভাব প্রকাশ। এই বৈশিষ্ট্য তাঁর নাটককে গভীর তাৎপর্যময় এবং বহুমাত্রিক করে তুলেছে। উদাহরণস্বরূপ, ‘ডাকঘর’ নাটকে মৃত্যু এবং স্বাধীনতার মধ্যে যে রূপক সংযোগ তুলে ধরা হয়েছে, তা তাঁর এই কৌশলের অন্যতম নিদর্শন।

৩. দর্শন ও ভাবের সংঘাত

রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলিতে বহির্বিশ্বের ঘটনার দ্বন্দ্ব অপেক্ষা, চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং দর্শনগত ভাবনার প্রকাশকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁর নাটকের মধ্যে এক ধরনের গভীর বোধ এবং মানসিক দ্বন্দ্বের প্রতিফলন দেখা যায়, যা নাটকগুলিকে একটি বিশেষ মাত্রা দিয়েছে।

৪. সঙ্গীত ও নৃত্যের সমন্বয়

রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য এবং নৃত্যনাট্যগুলিতে সঙ্গীত ও নৃত্যের সম্মিলন নাট্যকলায় নতুন এক মাত্রা যোগ করেছে। ‘নটীর পূজা’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘চণ্ডালিকা’, এবং ‘শ্যামা’ এই নাটকগুলোতে তিনি সঙ্গীত ও নৃত্যের মাধ্যমে নাটকের আবেগ ও ভাবকে আরও প্রবলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

৫. চারিত্রিক জটিলতা ও গভীরতা

রবীন্দ্রনাথের নাটকের চরিত্রগুলো সাধারণত খুব জটিল এবং গভীরভাবে নির্মিত। তারা কেবলমাত্র বহির্বিশ্বের কোনো প্রতিফলন নয়, বরং মানসিক ও আত্মিক দ্বন্দ্বের প্রতীক। এই চরিত্রগুলো মানব মনের গভীর স্তরগুলোকে উন্মোচন করে, যা নাটকের গভীরতা বৃদ্ধি করে।

৬. বহুমাত্রিকতা

রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলো একাধিক স্তরে উপস্থাপিত হয়েছে, যেখানে প্রতিটি নাটকই একাধিক ভাবনা ও বিষয়ে আলো ফেলেছে। উদাহরণস্বরূপ, ‘রক্তকরবী’ নাটকে শ্রমজীবী মানুষের শোষণ ও নিপীড়নের চিত্র ফুটে উঠেছে, যা সামাজিক এবং রাজনৈতিক ভাবনার মিশ্রণ।

৭. অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের প্রাধান্য

রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলিতে বাইরের ঘটনার পরিবর্তে চরিত্রের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং তার উপলব্ধির উপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। এটি তাঁর নাট্যকলাকে একটি গভীর মনস্তাত্ত্বিক মাত্রা দিয়েছে, যা চরিত্রগুলোর মনোজগতের গভীরতার অনুসন্ধান করে।

৮. সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতিফলন

রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলিতে সমকালীন সমাজ ও সংস্কৃতির নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে। ‘বিসর্জন’, ‘ডাকঘর’, ‘মুক্তধারা’ প্রভৃতি নাটকে সমাজের বিভিন্ন সমস্যার পাশাপাশি মানবিক সম্পর্কের জটিলতা এবং সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের প্রতিফলন দেখা যায়।

৯. গভীর আধ্যাত্মিকতা ও মানবতাবাদ

রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলিতে আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া এবং মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট। তাঁর রচনা সব সময়ে মানুষের মনুষ্যত্ব, আত্মার মুক্তি এবং আধ্যাত্মিক অন্বেষাকে গুরুত্ব দিয়েছে।

১০. কালের সমন্বয়

রবীন্দ্রনাথের নাটকে সময়ের গতিধারা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটেরও সমন্বয় দেখা যায়। তিনি তাঁর নাটকের মাধ্যমে সমকালীন সমাজের নানা দিক নিয়ে ভাবনা প্রকাশ করেছেন, যা কালের প্রেক্ষাপটে নতুনভাবে মূল্যায়নযোগ্য।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাট্য রচনার এই বৈশিষ্ট্যগুলি বাংলা নাট্যসাহিত্যের জন্য এক অনন্য অবদান, যা শুধু তাঁর সময়েই নয়, পরবর্তী কালের নাট্যকারদের কাছেও অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে।

রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলোকে প্রধানত কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যায়, প্রতিটি বিভাগে তাঁর সৃষ্টিশীলতা এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

রবীন্দ্রনাথের নাটকের শ্রেণীবিভাগ

১. গীতিনাট্য:

  • ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ (১৮৮১): এই নাটকে দস্যু রত্নাকরের বাল্মীকি হয়ে ওঠার কাহিনি রূপায়িত হয়েছে। এটি রবীন্দ্রনাথের প্রথম গীতিনাট্য, যেখানে সংগীত এবং নাট্যকলার সম্মিলন ঘটেছে।
  • ‘কালমৃগয়া’ (১৮৮২) এবং ‘মায়ার খেলা’ (১৮৮৮): গীতিনাট্যের এই ধারাগুলোতে সংগীতের সঙ্গে নাট্যকলার অভিনব সমন্বয় ঘটানো হয়েছে।

২. কাব্যনাট্য:

  • ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ (১৮৮৪), ‘রাজা ও রানী’ (১৮৮৯) এবং ‘বিসর্জন’ (১৮৯০): এই নাটকগুলিতে কাব্যের সূক্ষ্মতা এবং নাট্যরীতির মিশ্রণ দেখা যায়, যেখানে গল্পের পাশাপাশি চরিত্রের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ফুটে উঠেছে।

৩. নাট্যকাব্য:

  • ‘বিদায় অভিশাপ’ (১৮৯২), ‘গান্ধারীর আবেদন’ (১৯০০) এবং ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’ (১৯০০): নাট্যকাব্যগুলিতে কাব্যিক ভাষা ও গভীর ভাবধারার মিশ্রণে নাটকের শৈলী রূপায়িত হয়েছে।

৪. প্রহসন:

  • ‘গোড়ায় গলদ’ (১৮৯২), ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ (১৮৯৭) এবং ‘ব্যঙ্গকৌতুক’ (১৯০৭): প্রহসনধর্মী নাটকগুলিতে রবীন্দ্রনাথের ব্যঙ্গাত্মক রস এবং সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরার প্রয়াস স্পষ্ট।

৫. রূপক-সাংকেতিক নাটক:

  • ‘শারদোৎসব’ (১৯০৮), ‘অচলায়তন’ (১৯১২) এবং ‘ডাকঘর’ (১৯১২): রূপক-সাংকেতিক নাটকগুলিতে সমাজের নানান দিকের প্রতি সংকেত ও প্রতীকের মাধ্যমে গভীর বার্তা দেওয়া হয়েছে।

৬. সামাজিক নাটক:

  • ‘শোধবোধ’ (১৯২৬) এবং ‘বাঁশরী’ (১৯৩৩): সামাজিক নাটকগুলোতে সমকালীন সমাজের সমস্যা এবং মানবিক সম্পর্কের জটিলতা প্রাধান্য পেয়েছে।

৭. নৃত্যনাট্য:

  • ‘নটীর পূজা’ (১৯২৬), ‘চিত্রাঙ্গদা’ (১৯৩৬), ‘চণ্ডালিকা’ (১৯৩৮) এবং ‘শ্যামা’ (১৯৩৯): রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যগুলিতে নৃত্য ও সঙ্গীতের অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটে, যা তাঁর নাট্যকলার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

রবীন্দ্রনাথের নাটকের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য

১. কাব্যময়তা: রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মূলত কবি, তাই তাঁর নাটকেও কাব্যের ছোঁয়া স্পষ্ট। তাঁর নাটকগুলি কাব্যিক ভাষায় রচিত, যা পাঠক ও দর্শকের মনে গভীর প্রভাব ফেলে।

২. সংকেত ও রূপকের ব্যবহার: রবীন্দ্রনাথের নাটকে দৃশ্যমান ঘটনার পরিবর্তে রূপক এবং সংকেতের মাধ্যমে গভীর ভাব প্রকাশিত হয়েছে। এই বৈশিষ্ট্য তাঁর নাটকের মূল আকর্ষণ।

৩. দর্শন ও ভাবের সংঘাত: নাটকের মধ্যে বহির্ঘটনার দ্বন্দ্ব নেই, বরং চরিত্রের অভ্যন্তরীণ ভাবের সংঘাত ও তত্ত্বের প্রকাশ স্পষ্ট। তিনি জীবনের গভীরতর সত্যকে নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।

৪. নাটকের শৈলীতে বৈচিত্র্য: রবীন্দ্রনাথের নাটকের শৈলীতে বৈচিত্র্য রয়েছে। তিনি একাধিক আঙ্গিকে নাটক রচনা করেছেন—গীতিনাট্য, কাব্যনাট্য, রূপক নাট্য ইত্যাদি, যা বাংলা নাট্যসাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

রবীন্দ্রনাথের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নাটকের সংক্ষিপ্ত পরিচয়

‘রাজা ও রানী’ (১৮৮৯): এই নাটকে কবিতার মাধ্যমে রাজা বিক্রমদেব ও রানী সুমিত্রার মধ্যে সম্পর্কের সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এটি রবীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যনাট্য যা সমালোচকদের দ্বারা অত্যন্ত প্রশংসিত।

‘বিসর্জন’ (১৮৯০): ট্র্যাজেডি নাটক, যা ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের প্রথম অংশের উপর ভিত্তি করে রচিত। গোবিন্দমাণিক্য ও রঘুপতি চরিত্রের মাধ্যমে সামাজিক ও ধর্মীয় দ্বন্দ্বের প্রতিফলন ঘটেছে।

‘ডাকঘর’ (১৯১২): রূপক নাটক, যেখানে মৃত্যু এবং স্বাধীনতার মধ্যে সূক্ষ্ম সংযোগ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এটি বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

‘রক্তকরবী’ (১৯২৬): এই রূপক নাটকে নন্দিনী চরিত্রের মাধ্যমে শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বার্তা তুলে ধরা হয়েছে। এটি রবীন্দ্রনাথের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটকগুলি বাংলা সাহিত্যকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তাঁর নাটকের মাধ্যমে তিনি সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, এবং মানুষের মনোজগতের জটিলতা ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর নাট্যকলার মধ্যে যে বৈচিত্র্য, কাব্যময়তা এবং গভীরতা রয়েছে, তা বাংলা নাট্যসাহিত্যের জন্য এক অসামান্য অবদান হিসেবে বিবেচিত হয়। রবীন্দ্রনাথের নাট্যসৃষ্টি কেবল বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য নয়, সারা বিশ্বের সাহিত্যপ্রেমীদের জন্যও মূল্যবান।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

"সোজন বাদিয়ার ঘাট" কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

“সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

ভূমিকা: বাংলা কাব্যের ভুবনে বাংলাদেশের মানসকবি জসীম উদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) আবির্ভাব বিশ শতকের তৃতীয় দশকে। তিনি রবীন্দ্র-নজরুল ও তিরিশের কবিদের বলয় ও প্রভাব মুক্ত থেকে কবিতায় এক নতুন ও ব্যতিক্রম স্বর সৃষ্টি করেছেন। সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগরচেতনা, নাগরিক জীবন ও আচার-আচরণ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তুলে এনেছেন, জসীম উদদীন সেখানে তার কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কবির বিকল্প জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ উপন্যাসধর্মী রচনা। এ কাব্যে প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। নিম্নে … “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস ১. অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যে অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এ আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস, সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। “নমু পাড়ায় পূজা পরব, শঙ্ক কাঁসর বাজে, … মুসলমানের পাড়ায় বসে ঈদের মহোৎসবে,” ২. প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যেপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে মুসলমান চাষীর ছেলে সোজন আর হিন্দু নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠরতার আলেখ্য। গ্রামের হিন্দু বালিকা দুলীর সাথে মুসলমানের ছেলে সোজনের আবল্য বন্ধুত্ব। বন্ধু থেকে আস্তে আস্তে প্রেমে পরিণত হয়। কবিতায়- “নমুদের মেয়ে আর সোজনের ভারি ভাব দুইজনে, লতার সঙ্গে গাছের মিলন, গাছের লতার সনে।“ প্রেমের তুলনায় সমাজ অতিমাত্রায় কাব্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাব্যে সামাজিক অনুষঙ্গের উপস্থাপন করেছেন কবি। কবিতাতে তিনি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষকে আসার আহ্বান করেছেন। সমাজের মানুষের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, খেলাধুলা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায় কাব্যটিতে। দুলির মায়ের কণ্ঠে সমাজের রূঢ় রূপটি প্রকাশ পায়- “পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেত পাড়ায় যে ঠেকা ভার, চূণ নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!” ৩. জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রচনা: কবি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে। শহরজীবনে বসবাস করলেও তিনি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে গ্রামে কাজ করেছেন। ফলে তিনি মানুষের সাথে মিশতে পেরেছেন এবং তাঁর জীবনবোধ ও জীবন অভিজ্ঞতা হয়েছে সমৃদ্ধ। তাঁর জীবনপদ্ধতি ব্যতিক্রমধর্মী এবং বড় কবিতার ধারক হিসেবেই তিনি পরিচিত। ৪. উপন্যাসধর্মী রচনা: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” একটি উপন্যাসধর্মী রচনা। কাব্যের কবিতাগুলো জসীম উদদীন উপন্যাসের ঢংয়ে লিখেছেন। এ যেন লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক। ৫. মৌলিক রচনাধর্মী ও অনন্য: অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় সম্পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন কাহিনী নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রাম-বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। ৬. আধুনিকতা ও উদারনীতির বৈশিষ্ট্য: সময়কে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে স্বীকার করে নিয়ে লেখা আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাণিজগতের কল্যাণকামনা করে মানবিক হওয়াও আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। এসবের সংমিশ্রণে জসীম উদদীন কবিতায় অবয়ব দিয়েছেন। হিন্দু কিশোরী দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সুজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীমউদ্দীন লিখলেন- এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে . . . এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি। ৭. চরিত্র নির্মাণে দক্ষতা: ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে লেখক চরিত্রের আমদানি করেছেন, চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং চরিত্রের পরিণতি দেখিয়েছেন। চরিত্র যেন অনুভূতির মাধ্যমে কথা বলছে। তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভাষার ব্যবহারেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ৮. কাহিনী ও ভাষা বিন্যাসে পাণ্ডিত্য: কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ৯. ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ: আধুনিক কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীমউদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলঙ্কারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলঙ্কারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ।

Read More
কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলা: বাংলা সাহিত্যের একটি চরিত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়েন। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার

Read More

Keto Diet Recipes

Keto for Beginners: A Simple 7-Day Meal Plan The ketogenic (keto) diet has taken the health and wellness world by storm, promising weight loss, increased

Read More
শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক নাটক। এটি রচিত হয় ১৮৫৯ সালে। নাটকটি মহাভারতের কাহিনীকে উপজীব্য করে পাশ্চাত্য রীতিতে রচিত হয়। নাটকটির কাহিনী মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.