অস্তিত্ববাদ
অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা কোন বিশেষ সত্তার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। আর অস্তিত্ববাদ মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় অতি-বাস্তব সমস্যা নিয়ে আলোচনা, ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতা ও মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করার এক বলিষ্ঠ দার্শনিক প্রচেষ্টা।
অস্তিত্ববাদের পটভূমি
দুইটি মহাযুদ্ধে ব্যক্তি-মানুষের নির্মমভাবে নিষ্পেষিত হওয়া, মানবতাবাদ, ভ্রাতৃত্ববোধ সহ সব ধরনের আদর্শবাদের অপমৃত্যু অর্থাৎ, বিশ্বযুদ্ধ দুটির বিভাষিকাময় তাণ্ডবলীলা অস্তিত্ববাদী দার্শনিকদের মনে নিদারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। যার ফলস্বরূপ তাঁরা যে বিপ্লবী দর্শনের ঘোষণা করেন, সে দর্শন মূল্য দেয় ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতা ও মর্যাদাকে ব্যক্তিসত্তা ও মূল্যবোধকে।
প্রথম মহাযুদ্ধাত্তর যুগে জার্মানি ও ফরাসি দেশে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধত্তর সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশে বিপর্যস্ত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই চিন্তার উদ্ভব ও বিকাশ লক্ষ করা যায়।
অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য
১) দর্শনের অস্তিত্ববাদী শাখার প্রায় সকল দার্শনিকরাই ব্যক্তিসত্তার পূর্বে সাধারণ সত্তাকে স্বীকার করার বিরোধী। অর্থাৎ, তাঁদের মতে, ব্যক্তিসত্তা সার্বিক সত্তার পূর্বগামী।
২) নৈতিকতা বা সমাতিক দৃষ্টিভঙ্গি ক্ষেত্রে অস্তিত্ববাদীরা আত্মীয়তায় আত্মকেন্দ্রিক।
৩) পাশ্চাত্য দর্শনে প্লেটো, এরিস্টটলসহ অনেক দার্শনিক মনে করতো যে সবকিছুর মধ্যে একটি এসেন্স বা সার রয়েছে। এটি এমন একটা কিছু যা মৌলিক, যাকে আর ভাঙা যায় না। যেমন:
কারো নাম যদি সৌরভ হয়, এসেন্সিয়ালিস্টারা মনে করবে এমন একটা কিছু আছে যার পরিচয় হলো সৌরভ এবং যা পরবর্তী সময়ে বিকশিত হয়েও মূল এসেন্স একই থাকবে। কিন্তু অস্তিত্ববাদীরা পাশ্চাত্য দর্শনের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যকে ভেঙে ফেলে। অর্থাৎ, তারা সামষ্টিক এসেন্সের ধারণাকে অস্বীকার করে। কেননা প্রতিনিয়ত আমাদেরকে নানা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সে হিসেবে কোন চিন্তার একটা নির্যাস। থাকবে তা সম্ভব নয়।
৪) অস্তিত্ববাদী দর্শনে ব্যক্তির ভয়, অস্তিত্বের সংকটে পড়ার মুহূর্তের অনুভূতিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। কেননা সেই মুহূর্তেই ব্যক্তি প্রবলভাবে অস্তিত্বশীল হয়ে ওঠে।
৫) জ্ঞান তত্ত্বে অস্তিত্ববাদীরা প্রজ্ঞা বিরোধী। হেগেলীয় ভাববাদকে তাঁরা পরিহার করে চলেন। কেননা সেখানে ব্যক্তি অপেক্ষা পরম ব্রহ্মের মূল্য অধিক।
যে বিষয়টি আমাদের অস্তিত্ববাদী চিন্তা বোঝার ক্ষেত্রে আগ্রহ সৃষ্টি করে এবং উপলব্ধিকে পরিষ্কার করে সেটা হলো ল্যাটিন শব্দ “Cogito ergo sum”. যার মূলকথা হলো আমার চিন্তা আছে বলেই আমি আছি। আমার অস্তিত্ব আছে। আমার চিন্তা আমাকে নির্ণয় করে। আর আধুনিক দর্শনের জনক রেনে দেকার্তের একটি বিখ্যাত সূত্র হচ্ছে ‘আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমি আছি।”
রামেন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ভারতীয় দর্শন’ – এ ‘Cogito’ কে ‘আত্মতত্ত্ব’ বলেছেন।
অস্তিত্ববাদী দার্শনিক : আর যে সকল দার্শনিকের হাত ধরে অস্তিত্ববাদী দর্শনের প্রকাশ ও ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে তাঁদের মধ্যে সোরেন কিয়ের্কেগার্দ (১৮১৩-১৮৫৩), জ্যাঁ পল সার্ত্রে (১৯০৫-১৯৮০), ফ্রঞ্জ কাফকা, আলবেয়ার ক্যামু, দস্তয়ভস্কি, মার্টিন হাইডেগার, ফ্রেডরিখ শীটশে (১৮৪৪-১৯০০), কার্ল জাসপার্স, মার্সেল প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
অস্তিত্ববাদী দার্শনিকদের সাধারণত আস্তিক ও নাস্তিক এ দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়।তবে আস্তিক বা নাস্তিক যে দৃষ্টিকোণ থেকেই তাঁদের চিন্তাকে বিচার করা হোক না কেন, এর মধ্যে একটা বিষয়ে ঐক্য লক্ষ করা যায়। সেটা হলো এ ধারার দার্শনিকেরা মনে করে, ব্যক্তিসত্তা সার্বিক সত্তার অগ্রগামী।
কিয়ের্কেগার্দ:
অস্তিত্ববাদের ধারায় আস্তিক দলের একজন বলিষ্ঠ প্রতিনিধি হচ্ছেন সোরেন কিয়ের্কেগার্দ। তাঁকে ‘অস্তিত্ববাদ’ শব্দটির উদ্ভাবক এবং আধুনিক অস্তিত্ববাদী দর্শনের জনক ও বলা হয়।
কিয়ের্কেগার্দ অতীতের দার্শনিক ভাবধারার মূল্যায়ন করে বুঝতে পেরেছিলেন যে উনিশ শতকে চিন্তায় প্লেটো, এরিস্টটলের যে প্রভাব রয়েছে, সে দর্শনের পুনরুজ্জীবদের কোন সম্ভাবনা নেই।
বাস্তববাদের জায়গায় ভাববাদ, মানবতাবাদের স্থলে নৈর্ব্যক্তিক অনুধ্যানবাদ তখন দর্শনকে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল।
এজন্যই তিনি হেগেলের ভাববাদী দার্শনিক ভাবধারার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় আপসহীন সংগ্রামের ঘোষণা দিয়েছেন।
এখানে, উল্লেখ্য যে, ‘কমিউনিস্ট মেনুফেস্টো’ আর কিয়ের্কেগার্দের ‘ওয়ার্কস অব লাভ (Works of love) একই সময়ের রচনা। মার্কস ও কিয়ের্কগার্দ উভয়েরই অভিমত সময়কালীন শিল্পকেন্দ্রিক সমাজ ব্যক্তিমানুষের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করেছ, মানুষকে প্রায় যন্ত্রে পরিণত করেছে। উৎপাদ নীতি ও ভোগশীতি দ্বারা যে সমাজ পরিচালিত সে সমাজের কাছ থেকে ব্যক্তির মর্যাদা আশা করা যায় না।
তবে তারা একই আদর্শের সমর্থক হলেও তাদের প্রয়োগক্ষেত্র ছিল ভিন্ন। যেমন মার্কস এমন এক আদর্শ সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছেন যেখানে মানুষের চাহিদা ও বৈষয়িক সম্ভাবনার মধ্যে কোন ফাঁক থাকবে না। তাঁর মতে, আদর্শ ও সমাজব্যবস্থার প্রবর্তনের মাধ্যমেই সমাজের সকল অশুভ-অন্যায়ের অবসান ঘটানো সম্ভব। অন্যদিকে কিয়ের্কেগার্দ বলেছেন, ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে কিংবা উপেক্ষা করে আদর্শ সমাজের কথা ভাবাই যায় না।
অন্যদিকে, কিয়ের্কেগার্দ দার্শনিক দেকার্তের ‘আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমি আছি।’ এই উক্তিটির সমালোচনা করে বলেন ‘যেহেতু আমরা অস্তিত্ব আছে সেহেতু আমি চিন্তা করি। প্রথমে আমার অস্তিত্ব, পরে চিন্তা (I must exist in order to think) দেকার্ত প্রথমে ‘আমি’র অস্তিত্ব স্বীকার করেননি। এখানেই কিয়ের্কেগার্দ দেকার্তের আদি সূত্রের ভুল দেখিয়েছেন।
কিয়ের্কেগার্দ বলেন, “মানুষের গোটা জীবনটাই একটা সংগ্রাম। এ সংগ্রামে জয়ী হতে হলে ব্যক্তিকে করতে হবে শিরলস প্রচেষ্টা, নির্বাচন করতে হবে সঠিক কর্মপন্থা এবং থাকতে হবে সদাসচেতন। কিয়ের্কেগার্দের ভাষায় “আমরা যাকে খাঁটি চিন্তা বলি তা প্রকৃত সত্য নয়, সম্ভাব্য।” চিন্তামাত্রই ব্যক্তিনির্ভর। নৈর্ব্যক্তিক চিন্তা বলে কিছু নেই। আমরা যাকে নৈর্ব্যক্তিক চিন্তা বলি, পরোক্ষভাবে হলেও তা অস্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত।”
উদাহরণস্বরূপ, গণিতের স্বভাব বিমূর্ত কারণ, কোন বিশেষ অস্তিত্বের সঙ্গে এর কোশ সংযোগ নেই। কিন্তুও কিয়ের্কেগার্দের মতে, আমাদের এই প্রচলিত ধারণা ভ্রান্ত। গণিতের সৃষ্টি ও বিবর্তনের মূলেও রয়েছে অস্তিত্ববান মানুষ, কেননা গণিত তো আর অলৌকিকভাবে সৃষ্টি হয়নি। এ যুক্তিতেই কিয়েকগার্দ বলেন, অস্তিত্ব অন্তঃসারের অগ্রর্তী (Existence precedes essence).
কিয়ের্কেগার্দ তাঁর রচনায় মানুষের জীবনের তিনটি স্তরের উল্লেখ করেন। যথা:
১) ভোগীয় বা সৌন্দর্যানুভূতির স্তর (Aesthetic stage):
এই স্তরে মানুষ স্বভাবতই ইন্দ্রিয় কামনার পথে ডুবে থাকে / ভোগ-বিলাসে মগ্ন থাকে। যুক্তিহীন জীবনে প্রভুত্ব করে সমাজ বা অজশ্যের প্রতি তার কোন দায়িত্ব বা নৈতিক মূল্যবোধ থাকে না। ভোগের জন্য মুহূর্ত থেকে মুহূর্তে ছুটে বেড়ায়।
কিয়ের্কেগার্দের মতে, এ জীবন কোনো জীবনই নয়, এ ধরনের অস্তিত্ব অর্থহীন।
২) নৈতিক স্তর (Ethical stage):
এটা হলো মানবিকতার স্তর। কামশাকে ত্যাগ করে মানুষ হিসেবে করণীয় কাজকে মেনে নেয় এবং সমাজের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখে চলে।
শৈতিক জীবশের সমর্থশের কিয়ের্কেগার্দ শাশা যুক্তি প্রদর্শন করলেও এ স্তরটিকে প্রকৃত অস্তিত্বের জন্য যথেষ্ট বলে মনে করেন না। কেননা নৈতিক ব্যক্তিকে সার্বকরতা মানতে গিয়ে উভয় সংকটে পড়তে হয়।
কারণ সমাজকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে তাকে তাকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বর্জন করতে হয়। আবার অন্যদিকে, নিজের স্বতন্ত্র্যকে প্রকাশ করলেও, যথার্থ অস্তিত্বকে প্রকাশ করতে যা করা উচিত, তা সে করছে না বলে অভুযুক্ত হয়। যেদিকেই যায় না কেন পাপ থেকে তার রক্ষা নেই । তাঁর ‘Fear and Trembling’ গ্রন্থেও এ বিষয়টি লক্ষ করা যায়।
৩) ধর্মীয় স্তর (Religious Stage):
এ স্তরে মানুষ অস্তিত্বের অর্থকে আবিষ্কার করে ঈশ্বরের নিকট মাথা উঁচু করে, কোমর শকত করে দাঁড়াতে শেখে।
কিয়ের্কেগার্দের তিনটি স্তর সম্পর্কিত মতবাদ একটি সাধারণ পূর্ব ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। তা হলো মানুষ শুধু দৈহিক বা আত্মিক নয়, বরং এ দুটোর সমন্বয়।
আর এ দুইয়ের সামর্থ্য ঘটে তৃতীয় উপাদান আত্মজ্ঞ দ্বারা। এবং বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব মানুষের নিজের। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা এবং স্বাধীনভাবে মানুষ এটা সম্ভব করে।
হাইডেগার:
অস্তিত্ব অন্তঃসারের অগ্রবর্তী – অস্তিত্ববাদের এই মূল সূত্রের এক চমৎকার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় মার্টিন হাইডেগার (১৮৮৯-১৯৭৬) – এর দর্শনে। তাঁর দর্শনের কেন্দ্রীয় সমস্যা সত্তার সমস্যা। সত্তাকে তিশি দেখতে চেয়েছেন মানুষের জীবন ও অস্তিত্বের প্রতিফলন হিসেবে। তার দৃষ্টিতে প্রকৃত সত্তা মানে স্বকীয় সত্তা। প্রথমেই তিনি ব্যাখ্যা করেন ডেসাইদের অর্থ। ডেসাইদ কথাটির দ্বারা তিনি স্পষ্টতই মালব অস্তিত্বের রূপ বা ধরনকে বুঝিয়েছেন। তিনি ব্যক্তি মানুষকে তার নিজের সঙ্গে, পরিবেশের সঙ্গে এবং অন্যান্য মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করেন। ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্ব সসীম ও দৈশিক, নিজের সসীমত্ব সম্পর্কে মানুষের যে চেতনা, তাতেই নিহিত তার অস্তিত্বের মূল বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন নির্বাচনের মধ্য দিয়েই মানুষ অস্তিত্বশীল, আর এজন্যই তার সত্তা থেকে যায় সম্পূর্ণরূপে অনির্দিষ্ট। প্রাণী যেমন, নিষ্প্রাণ বস্তু ও তেমনি টিকে আছে। কারণ, তারা উভয়েই দেশ ও কালে অবস্থান করছে। এ দুয়ের কোনোটিই অস্তিত্বশীল নয়। শুধু মানুষই অস্তিত্বশীল, কারণ একমাত্র মানুষেরই তার নিজ অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতনতা রয়েছে। অস্তিত্বশীল হওয়া বা যথার্থ সত্তা হিসেবে থাকার অর্থই হচ্ছে নিজের সম্পর্কে চিন্তা করা এবং নিজের সঙ্গে জড়িত হওয়া। প্রামাণিক সত্তা মানেই আত্মসত্তা। আর এ সত্তার অর্থ শুধু চেতনসম্পন্ন হওয়াই লয়, বরং দায়িত্বশীল স্বাধীন সিদ্ধান্ত দেওয়ার উপযুক্ত হওয়া।
“মানুষের গোটা অস্তিত্বটাই এক মর্মান্তিক উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ ও ভীতির দ্বারা তাড়িত। এ উদ্বেগ ও ভীতি দ্বারা মানুষ তার অপ্রামাণিক অস্তিত্ব অতিক্রম করে প্রামাণিক অস্তিত্ব সম্পর্কে চেতনা লাভ করে। উদ্বেগ ব্যক্তিকে মানবীয় আবেগের গভীরতম পর্যায়ে নিয়ে যায়। উদ্বেগকে ভীতির সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে শা। ভীতি মানে বাঘ, ভল্লুক, বন্দুক প্রভৃতি কোন বিশেষ কিছুর ভীতি এবং এজন্যই এর মূলে সবসময় একটি সুনির্দিষ্টতা থাকে। কিন্তু উদ্বেগের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ভিন্নতর। উদ্বেগ মাঝে একটি অনির্দিষ্ট অনুভূতি, এমন অনুভূতি যা কোশ নির্দিষ্ট বস্তুসম্পর্কিত নয়, জগতের কোন কিছু নয়, বরং জগতে থাকার ব্যাপারটিই মানুষের মনে উদ্বেগ সৃষ্টি করে।” (দার্শনিক সমস্যা ও সমকাল ; ২০০৪; পৃষ্ঠা: ১) উদ্বেগের সৃষ্টি হয় মৃত্যুর অনিবার্যতা সম্পর্কে চেতনা থেকে। মানুষ জানে যে তার মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবী। সে শুধু জীবনের শেষেই একবার মরে না, সারা জীবনই সে মরণের সম্ভাবনা ধারণ করে থাকে। মৃত্যু সুনিশ্চিত, যদিও এর দিনক্ষণ অনির্দিষ্ট। মৃত্যুর কথা ভাবতে গিয়ে পরম শূন্যতার সম্মুখীন হন। এ শূন্যতা নিছক অস্তিত্বের অনুপস্থিতিই নয়, বরং এক নিরেট বাস্তবতা অন্যান্য অস্তিত্ববাদীর ন্যায় হাইডেগার ব্যক্তি- স্বাধীনতার ওপর জোর দেশ। তাঁর মতে মানুষ চলমান অস্তিত্বের অধিকারী, আর তাই তাকে কোন স্থির সংজ্ঞা দ্বারা করা চলে না, পছন্দ -অপছন্দ নির্বাচন ও নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে ব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বাধীন, সে নিজেই তার ভাগ্যবিধাতা। তবে এই স্বাধীনতা অবাধ নয়। যেমন- মানুষ বিশেষ একটি জাতি বা গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে জন্মায় এবং এই জাতি বা গোষ্ঠীর আইনকানুন ও বিধি-নিষেধের প্রতি অনুগত থাকে। এটা মানুষের ব্যক্তিগত নির্বাচন বা স্বাধীন ইচ্ছার ফল নয়, বরং পূর্ব নির্দিষ্ট নিয়তির বিধান। হাইডেগার এর নাম দিয়েছেন অদৃষ্ট। এই দুই বিরোধী ধারণার সমন্বয় সাধন হাইডেগারের অস্তিত্ব- বাদের এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক- এবং নির্ধারিত অদৃষ্ট। তিশি এই দুই বিরোধী উগ্র মুক্ত স্বাধীনতা মতবাদের সমন্বয়ে গঠিত এক মধ্যপথের সমর্থন করেন। তাঁর এ সমন্বয়ধর্মী নৈতিক মধ্যপথ অচল অসার গতানুগতিকতা ও রক্ষণশীলতার বিরোধী এবং সার্থক প্রগতি ও অগ্রগতির বাহক। তাঁর মতে, নৈতিক বিধান নিশ্চল বা শাশ্বত নয়, চলমান ও গতিশীল।
মালবমল ও সমাজের পরিবর্তনশীল নতুন অবস্থার দিকে লক্ষ্য রেখে সময়োপযোগী নির্দেশ প্রদানই নৈতিক অনুশাসনের মূল লক্ষ্য। শীতিবিদ্যার পরিভাষায় এ মতেরই শাম সৃজদী নৈতিকতা।
জেসপার্স :
হাইডেগারের শামের সঙ্গে যাঁর নাম বিশেষভাবে যুক্ত তিনি হলেন জার্মানির অপর এক বিশিষ্ট দার্শনিক কাল জেসপার্স (১৮৮৩- ১৯৬৯)। জেসপার্সের হাতে অস্তিত্ববাদ সর্বাধিক প্রাঞ্জল, চিত্তাকর্ষক ও সুশৃঙ্খল রূপলাভ করে। তাঁর দার্শনিক অভিযান এবং মানব সমস্যার দিতে চান এক সার্থক সমাধান।
প্রথমে চিকিৎসায় তিশি মানসিক পীড়ায় আক্রান্ত মানুষের তিনি চিকিৎসায় আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু তাতে তিনি মানব সত্তার রহস্য উদঘাটনের কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত এ পেশা ত্যাগ করে প্রামাণিক সত্তার স্বরূপ অনুসন্ধানে ব্রতী হন। তাঁর মতে, সত্তা নিজেকে তথাস্ত সত্তা (being there), আত্মস্থ সত্তা (being-in-oneself) এবং স্বকীয় সত্তা (being-in-itself)- এ তিনরূপে অভিব্যক্ত করে থাকে। এ তিন প্রকার সত্তার স্বরূপ ও পারস্পরিক সম্বন্ধ সম্পর্কে যথার্থকে জ্ঞান লাভই হওয়া উচিত যথার্থ দার্শনিকের লক্ষ্য।
প্রথমেই আসে জাগতিক সত্তার কথা। এ জগতের অসংখ্য গুলো নিয়েই পরিচালিত হয় বিজ্ঞানের যাবতীয় গবেষণা ও পরীক্ষানিরীক্ষা। সুতরাং, জগতের সত্তা অস্বীকার করার কোন মুক্তিসংগত কারণ নই। এই অভিজ্ঞতা গম্য জাগতিক সত্তার নামই জেসপার্স দিয়েছেন তথাস্ত সত্তা। একদিকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জাগতিক সত্তাকে যেমন অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অন্যদিকে, আবার মানুষের জ্ঞানের চরম লক্ষ্যও বলা যায় না। কারণ অভিজ্ঞতার জগতের ঊর্ধ্বে মানুষ অনুভব করে এক ব্যাপকতর সত্তার অস্তিত্ব এবং উৎসুক হয়ে ওঠে সেই সত্তাকে জানতে।
বিজ্ঞানের স্তর অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ উপনীত হয় দাশের পর্যায়ে। এ পর্যায়ে তার পক্ষে জ্ঞানের একত্ববিধান ও স্বর্কীয় সত্তা অনুসন্ধানের পথ সুগম হয়। কারণ, একমাত্র সার্থক দর্শনের মাধ্যমে প্রামাণিক আত্মসত্তা ও পরম স্বর্কীয়সত্তা আবিষ্কার সম্ভব। জেসপার্স বলেন, স্বকীয় সত্তার সন্ধান পেতে হলে দার্শনিককে বিজ্ঞাশের সংকীর্ণ গণ্ডিভুক্ত তথাস্থ সত্তার জগৎ অতিক্রম করতে হবে। আর এ জন্য অতিক্রান্তের মাধ্যমেই দার্শনিক উপনীত হয় আত্মস্থ সত্তার জগতে। সহজ অভিজ্ঞতার জগৎ (তথাস্থ সত্তা) অতিক্রান্ত এবং আত্মা সত্তা প্রাপ্তির পর দার্শনিক উপনীত হল বিচিত্র অভিজ্ঞতার সমন্বয় বিধায়ক স্বকীয় সত্তার পর্যায়ে। জেসপার্স বলেন, প্রত্যেককেই আজ এ কথা উপলব্ধি করা উচিত যে, সে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও অফুরন্ত শক্তির অধিকারী। এই স্বাধীনতার যথার্থ প্রয়োগের ওপরই প্রাণিজগতের মানুষের উচ্চতর মর্যাদা নির্ভরশীল। অন্যান্য প্রাণীর ন্যায় শুধু মানুষই অস্তিত্ববান নয়, অস্তিত্ব সচেতন ও বটে।
মার্সেল :
আমাদের আলোচশার পরবর্তী দার্শনিক জেবরিল মার্সেল (১৮৭৭-১৯৭৩) । তার প্রথমদিকের রচনাবলিতে হেপেল, ব্র্যাডলি, রয়েস প্রমুখে ভাববাদীদের প্রভাব থাকলেও তিনি ক্রমশ ভাববাদ ছেড়ে অস্তিত্ববাদের দিকে অগ্রসর হয়। কিয়ার্কেগার্ডের ন্যায়, তিনিও হেগলীয় ভাববাদ প্রত্যাখান করেন, ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং মানুষের সাথে সম্পর্কিত একজন অতিবর্তী ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপন করেন।
বিষয় ও বিষয়ী, চিন্তা ও সত্তা, বুদ্ধি ও ইচ্ছা, দেহ ও আত্মা, আমি ও তুমি, ব্যক্তি ও ঈশ্বর প্রভৃতি বিষয় নিয়ে প্রাচীন গতানুগতিক দর্শনকে সংক্রমিত করেছে, মার্সেল তাঁর দর্শনে সেগুলো নিরসদের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তাঁর মতে দেহ-মদের সম্বন্ধ এমন একটি রহস্য যার সমাধান করতে হলে প্রয়োজন সাক্ষাৎ অনুভূতির। দেহের সঙ্গে মলের যেমন সংযোগ ঘটে, তেমনি “আমি”-র সঙ্গে ‘তুমি’-র সম্বন্ধ হয়। আমাদের অস্তিত্বের প্রতীতির সঙ্গে এমন একটা বিশ্বাস জড়িত, যার ফলে আমরা ধরে সেই যে, আমার প্রত্যক্ষভাবে অনুভূত বিষয়ের বাইরেও একটি সত্তা বিদ্যমান আছে। এ ধরনের বাহ্য সত্তার অস্তিত্ব আমরা স্বীকার করি বিশ্বাসের ভিত্তিতে। মার্সেলের দৃষ্টিতে একজন অস্তিত্ববাদীর কাছে জগতের
সবচেয়ে বড় রহস্য হচ্ছে আত্মসত্তার সাথে ঈশ্বর নামক এক অতিবর্তী সত্তার সংযোগ। মানুষ তার স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং ঈশ্বরে অতিবর্তী অস্তিত্ব আরোপ পরিহারের মাধ্যমেই এই অতিক্রমণ অর্জন করে। মার্সেলের ধর্মীয় অস্তিত্ববাদকে কখনো কখনো খ্রিষ্টীয় বা ক্যাথলিক অস্তিত্ববাদ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কিন্তু তিনি নিজে এই আখ্যায়ন গ্রহণ করতে সম্মত দল। কারণ, সত্তার অস্তিত্ববাদী অংশগ্রহণকে তিনি যেকোনো ধর্মীয় নির্দেশের পূর্ববর্তী ব্যাপার বলে মনে করেন।
জাঁ পল সার্ত্রে (১৯০৫-১৯৮০) :
‘অস্তিত্ববাদী’ দর্শনে সার্ত্রে এক বলিষ্ঠ নাম ‘অস্তিত্ববাদ’ নামে এই তত্ত্বগত জ্ঞানকাণ্ড দার্শনিক ভিত্তি সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠা করেন ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ পল সার্ত্রে তাঁর দুটি রচনা ‘Being and Nothingness’ (১৯৪৩) এবং ‘Fraternalism and Humanism’ (১৯৪৬) এর মধ্যামে।
সার্ত্রে নীটশের নাস্তিক্যবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, এবং শীটশের এই সুরটিকে আরও বলিষ্ঠ করেছিলেন।
তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে মূল্য দিয়েছেন মানুষকে, তাঁর ব্যক্তিত্বকে, স্বাধীনতাকে, মর্যাদা ও মূল্যবোধকে ।
১) তাঁর চিন্তায় ঈশ্বরের অস্তিত্বহীনতা: নাস্তিকতা সার্ত্রের অস্তিত্ববাদী চিন্তার একটি অপরিহার্য পরিণাম। শাস্তিকতার মধ্যেই সার্ত্রের মানুষের স্বাধীনতাকে খুঁজে পেয়েছেন। তিনি মনে করেন, ঈশ্বরের অস্তিত্বকে যদি স্বীকার করা হয় – যে ঈশ্বর স্পিনোজা বা লাইবনিজের ধারণাঙ্গুসারে মানুষের সৃষ্টিকর্তা এবং যার দ্বারা মানুষ অপরিহার্যভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় – তাহলে মানুষের স্বাধীনতা হয় সীমিত। আর সার্ত্রের এই ধারণার মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্বহীনতার প্রমাণের চেয়ে আস্তিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মনোভাব বেশি স্পষ্ট।
অর্থাৎ, তিনি এমন এক পৃথিবী বা সমাজের কথা চিন্তা করেছেন যা হবে ঈশ্বরবিহীন, অস্তিত্ববাদী ও মানবতাভিত্তিক। মানুষ নিজেই সে সমাজ সৃষ্টি করবে, সেখানে ঈশ্বরের কোন স্থান নেই, ভূমিকা নেই।
২) অস্তিত্ব সত্তার পূর্বগামী: জ্যাঁ পল সার্ত্রের ‘Existentialism and Humanism’ গ্রন্থের প্রধান উক্তিই হলো ‘অস্তিত্ব সত্তার পূর্বগামী।
অর্থাৎ, প্রথমে মানুষের অস্তিত্ব, পরে তাঁর সার্বিক সত্তা। আত্মগত প্রচেষ্টায় সে যেভাবে নিজেকে তৈরি করে, সে সেভাবেই তৈরি হয়। মানুষ যা হওয়ার ইচ্ছে করে, সে তাই। পূর্ব থেকে তার স্বভাব নির্ধারিত হয়ে থাকে না। ঈশ্বর থাকলে এ নির্ধারণের প্রশ্ন আসত।
৩) অস্তিত্ববাদে স্বাধীনতার ধারণা ও মানবতাবোধ: সার্চের অস্তিত্ববাদী দর্শনে স্বাধীনতার ধারণা একটি একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে, সে সঙ্গে মানবতাবাদও। সার্ত্রের মতে- ‘Freedom is the human reality’. অর্থাৎ, তাঁর কাছে মানব সত্তা ও স্বাধীনতা সমার্থক।
মানুষ অফুরন্ত স্বাধীনতার অধিকারী হলেও এ স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে, সে খেয়ালখুশি মতো তা প্রয়োগ করবে। তার সবকিছুর দায় ভার তাকেই বহন করতে হয়।
আর প্রতিটি মানুষ যেহেতু সমগ্র মানব পরিস্থিতির সঙ্গে জড়িত সেহেতু মানুষ নিজের জন্য কিছু নির্বাচন করতে গিয়ে গোটা মানবজাতিকে জড়িত করে ফেলে, কিন্তু তবুও নির্বাচন তাকেই বহন করতে হয়।
যেমন: সে বিয়ে করবে শাকি কুমার থাকবে এর মধ্যে একটিকে তাকে নির্বাচন করতেই হবে। এ দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়, কর্মপন্থা নির্বাচনে ব্যক্তি কোশ বর্হি শক্তি দ্বারা পরিচালিত হয় না। বলে তার কৃতকর্মের দায় তাকেই বহন করতে হয়।
যথার্থ স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্ববোধও অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত থাকে। সে যখন নির্বাচন করে তখন সবার মঙ্গলের জন্য নির্বাচন করে।
শূন্যবাদ সম্পর্কে সার্ত্রের ধারণা : সার্ত্রে তাঁর ‘Being and Nothingness’ গ্রন্থে শূন্যতা নিয়ে আলোচনা করেন।
সার্ত্রের কাছে মৃত্যুর পরবর্তী জীবন অর্থহীন। মানুষ নির্জনে বসে চিন্তা করার মৃত্যুর ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে। কারণ ব্যক্তি তাঁর মনের আয়নায় এক বিরাট শূন্যতার ছবি দেখতে পায়। মানুষ ভাবে যে অর সামনে বোধ হয় আর কোন কিছু নেই। আছে শুধু শূন্যতা। এই পরিপ্রেক্ষিতে সার্ত্রে ‘নিজের জন্য অস্তিত্ব’ (Being-for-itself).
এবং ‘নিজেরাই অস্তিত্ব’ (Being in themselves) এর মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেন। তাঁর মতে প্রথমটি সচেতন ব্যক্তি এবং দ্বিতীয়টা হচ্ছে অচেতন বস্তুর জন্য প্রযোজ্য। এই দুইয়ের মধ্যে যে পার্থক্য তাকে তিনি ‘শূন্যতা’ বলেছেন। আবার সচেতন ব্যক্তির নিজের মধ্যেও শূন্যতা থাকতে পারে। ব্যক্তির মধ্যে অনেক কিছুর অভাব বা সম্ভাবনা থাকে। ব্যক্তি তার নিরলস কর্ম ও চিন্তার দ্বারা এই শূলতা পূরণ করতে সচেষ্ট হয়। শূন্যতার এই সমস্ত অর্থের মধ্যে মৃত্যুর পর ‘শূন্য’ অবস্থার কথাই ব্যক্তির নিকট অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই ফাঁকা বা শূন্য অবস্থার কথা ভেবে ব্যক্তির পক্ষে মদের শক্তি হারালো স্বাভাবিক। ব্যক্তির কোশ স্থায়ী কর্ম নেই। তাই ব্যক্তি একান্তই শূন্য।
সার্ত্রের ‘in Camera’ নাটকেও এ তত্ত্বের প্রয়োগ লক্ষ করা যায়।
বাংলা সাহিত্যে অস্তিত্ববাদের প্রভাব :
বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্যায়ে অস্তিত্ব সম্পর্কে মানুষের যে জীবন জিজ্ঞাসা, তার মধ্যে যে শঙ্কা, হতাশা, অন্তর্দ্বন্দ্ব, সংকট ইত্যাদি দেখা যায়, সে বিষয়টি পাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় অঞ্চলের সাহিত্যতিকদেরও প্রভাবিত করে। পাশ্চাত্য সাহিত্যে প্রথম অস্তিত্ববাদের প্রয়োগ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে ফিওদর দস্তয়ভস্কির রচনায়। তাঁর রচিত ‘শোটস ফ্রম আন্ডার গ্রাউন্ড’, ‘দা ব্রাদারস কারমাজাভ, ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট, দ্যা ইডিয়েট’ ইত্যাদি। আলবেয়ার ক্যমুর দ্যা মিথ অব সিসিফাস’ ‘দ্যা আউটসাইডার’ ইত্যাদি রচনায় অস্তিত্বের সংকট ও ইত্যাদি রচনায় জগৎ জীবনের নিহিত অর্থশূণ্যতার কথা আছে। কাফকা অস্তিত্ববাদ তত্ত্বকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। তাঁর অধিকাংশ কাজগুলো যেমন- ‘দ্যা মেটারসফোসিস’, ‘দ্যা ট্রায়াল’ ইত্যাদি। ‘দ্যা মেটামরফোসিস গঞ্জের শায়ক গ্রেগর পোকায় রূপান্তরিত হওয়া রক ভয় ও দুঃখ, স্বপ্ন তাড়িত প্রহেলিকা অস্তিত্ববাদেরই ইঙ্গিত বহন করেন।
আর এই অস্তিত্ববাদী দর্শনের ছোঁয়া পাশ্চাত্য সাহিত্যিকদের পাশাপাশি অনেক বাংলা সাহিত্যিকদের মধ্যেও দেখা যায়।
বাংলা সাহিত্যে এ মতবাদের আদর্শ যাদের লেখনিতে ফুটে উঠেছে তাঁরা হলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, জীবনানন্দ দাশ, বিমল কর, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রমুখ।
বুদ্ধদেব বসুর ‘শেষ পাণ্ডুলিপি’ জীবনানন্দের ‘বোধ; কবিতায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ-র ‘কাঁদো নদী কাঁদো’, ‘লালসালু’, ‘চাঁদের অমাবস্যা’ ইত্যাদি।
‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসে লেখন শায়ক চরিত্র আরেফ আলির জীবনের অস্তিত্ব সংকট, আত্ম জিজ্ঞাসা, অন্তর্দ্বন্দ্ব, হতাশা, ক্ষোভ এবং সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এর দায়ভার বহন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে অস্তিত্ববান হয়ে ওঠার প্রয়াস লক্ষ করা যায়।
বস্তুত, মানুষের অস্তিত্ব ও আত্মমর্যাদা সৃষ্টি করাই ছিল অস্তিত্ববাদের মূল উদ্দেশ্য। অস্তিত্ববাদ এক প্রকারের মানবতাবাদ। এটি মানবতাবাদ এই জন্য যে মানুষের জগতে মানুষ ব্যতীত আর কোন বিধানকর্তা নেই। সমস্যার সম্মুখীন হলে তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। মানুষ স্বাধীন তাই সব কিছুর মধ্যে মানুষের এই উপলব্ধি হয় যে, হতাশার মধ্যে যে তাকে প্রচেষ্টার দ্বারা, একটি নতুন সমাজ বা অবস্থা তৈরি করতে হবে। অস্তিত্ববাদকে আশাবাদ ও মানবতাবাদ নামে অভিহিত করা যেতে পারে। এ দর্শন অনুভূতি, উপলব্ধি, কর্ম ও বাস্তবের দর্শন।
তথ্যসূত্র:
১) নীরকুমার চাকমা; অস্তিত্ববাদ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা; ১৯৯৭; পৃষ্ঠা- ৩৫, ৩৭, ৯২
২) ড. আমিনুল ইসলাম; দার্শনিক সমস্যা ও সমকাল; ২০০৪; পৃষ্ঠা- ১১০-১১২
৩) আমিনুল ইসলাম; দর্শন ভাবনা সমস্যা ও সম্ভাবনা; ২০০৯; পৃষ্ঠা – ২৬৯ – ২৭৩
৪) অণুবাদ: অধ্যাপক মো. বজলুল করিম; অস্তিত্ববাদ ও মানবতাবাদ, ২০০৯; পৃষ্ঠা- ৭৮-৮০
Keywords: অস্তিত্ববাদ মানে কি, অস্তিত্ববাদ pdf, জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য কি কি, অস্তিত্ববাদের মূল কথা কি, অস্তিত্ববাদ দর্শন pdf, অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞা, অস্তিত্ববাদের জনক কে, অস্তিত্ববাদী দার্শনিক, অস্তিত্ববাদ ও মানবতাবাদ pdf, অস্তিত্ববাদী উপন্যাস কোনটি, অস্তিত্ববাদ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা, অস্তিত্ববাদ অর্থ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, দর্শনের বৈশিষ্ট্য,