গবেষক যখন ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে একটি সুশৃঙ্খল কর্মপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে, তখন তাকে গবেষণা পদ্ধতি বলে। গবেষণা কোনো বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন কাজ বা প্রক্রিয়াহীন কোনো কর্ম নয়। দীর্ঘদিনের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত কতগুলো পদ্ধতি অনুসরণ করে গবেষণা সম্পন্ন করতে হয়। সুশৃঙ্খল পদ্ধতি অনুসরণ করার কারণেই গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান গ্রহণযোগ্যতা পায় এবং গবেষকও তাঁর গবেষাকর্মের জন্য সম্মানজনক স্বীকৃতি লাভ করতে পারেন ।
গবেষণার প্রকৃতি, গবেষণার বিষয়, গবেষণার ক্ষেত্র, গবেষণায় প্রাপ্ত সুযোগ প্রভৃতির উপর ভিত্তি করে প্রতিটি গবেষণায় এক বা একাধিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। গবেষণার পদ্ধতিগুলো হলো:
১. পাঠ/ আধেয় বিশ্লেষণ পদ্ধতি;
২. বর্ণনামূলক পদ্ধতি;
৩. ঐতিহাসিক পদ্ধতি;
৪. তুলনামূলক পদ্ধতি;
৫. দালিলিক পদ্ধতি;
৬. পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি;
৭. কেস স্টাডি বা ঘটনা সমীক্ষা ও
৮. ফিল্ড স্টাডি বা ক্ষেত্র সমীক্ষা।
নিম্নে গবেষণার বিভিন্ন পদ্ধতিগুলো আলোচনা করা হলো:
১. পাঠ/ আধেয় বিশ্লেষণ পদ্ধতি: যে গবেষণা পদ্ধতিতে কোনো রচনার পাঠ (Text) বিশ্লেষণ করে গবেষণা সম্পন্ন করা হয় তাকে পাঠ বিশ্লেষণ পদ্ধতি বলা যেতে পারে। সাহিত্য-গবেষণার ক্ষেত্রে এটি বহুল ব্যবহৃত গবেষণা পদ্ধতি। সাধারণত গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ প্রভৃতি আঙ্গিকের সাহিত্য নিয়ে পরিচালিত গবেষণায় এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়।
২. বর্ণনামূলক পদ্ধতি: বর্ণনামূলক পদ্ধতির মূল ভিত্তি বর্ণনা। গবেষণায় যখন গবেষণার অন্তর্গত কোনো বিষয়কে বর্ণনার মাধ্যমে বিকশিত করে গবেষকের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ দিতে হয় তখন বর্ণনামূলক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। বর্ণনা প্রদানের ক্ষেত্রে ভাষারীতি, বাক্যগঠন, শব্দ ব্যবহার প্রভৃতিতে নিজস্বতা ও শুদ্ধতা রক্ষা করা প্রয়োজন।
৩. ঐতিহাসিক পদ্ধতি: ঐতিহাসিক ঘটনাক্রম, ঐতিহাসিক উপকরণ, বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল প্রভৃতির ভিত্তেতে অনুসৃত পদ্ধতিকে ঐতিহাসিক পদ্ধতি বলা যেতে পারে। ইতিহাসের কোনো তথ্য উল্লেখ করার সময় নির্ভুল তথ্য সন্নিবেশন করা প্রয়োজন।
৪. তুলনামূলক পদ্ধতি: তুলনাকে ভিত্তি করে যে পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয় তাই মূলত তুলনামূলক পদ্ধতি । সাহিত্যের ক্ষেত্রে এক সাহিত্যের সঙ্গে আরেক সাহিত্যের তুলনা হতে পারে। যেমন উপন্যাস নিয়ে যদি গবেষণা হয়, তবে এক উপন্যাসের সঙ্গে আরেক উপন্যাসের তুলনা কিংবা অন্য সাহিত্য আঙ্গিকে প্রকাশিত অন্য কোনো সাহিত্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হতে পারে।
৫. দালিলিক পদ্ধতি: কোনো কোনো গবেষণায়, বিশেষত ইতিহাসের গবেষণায় প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য বিষয়ক গবেষণায় বিভিন্ন ধরনের দলিলকে অবলম্বন করে গবেষণা পরিচালিত হয়। এই দলিলকে ভিত্তি করে সম্পাদিত গবেষণাকে দালিলিক পদ্ধতি বলে।
৬. পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি: গবেষকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অর্জিত তথ্যের ভিত্তিতে পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি কার্যকর হয়। সমাজ বিজ্ঞানের গবেষণায় এই পদ্ধতি প্রয়োগের ব্যাপকতর সুযোগ রয়েছে। সাহিত্য-গবেষণায় এই সুযোগ একেবারে কম নয়। কোনো সাহিত্যিকের জীবনাচরণ, কর্ম, জীবনধারা প্রভৃতি নিয়ে গবেষণা করা হলে এই পদ্ধতি প্রয়োগের অনেক সুযোগ রয়েছে। আবেগকে অতিক্রম করে গবেষকের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ও বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণের ভিত্তিতে পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি’ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
৭. কেস স্টাডি বা ঘটনা সমীক্ষা: অনেক গবেষণায় কোনো এক বা একাধিক বিষয় বা ঘটনাকে অবলম্বন করে গবেষণা পরিচালনা করা হতে পারে। এই সকল এক বা একাধিক ঘটনাকে কেস বা ঘটনা হিসেবে ধারণ করে পরিচালিত গবেষণাকে কেস স্টাডি বা ঘটনা সমীক্ষা বলা হয়।
৮. ফিল্ড স্টাডি বা ক্ষেত্র সমীক্ষা: কোনো গবেষণায় সুনির্দিষ্ট কোনো এলাকাকে নির্বাচন করে তা অধ্যয়নের মাধ্যমে সেই এলাকা সম্পর্কে সাধারণ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার প্রয়াস থেকেই ক্ষেত্র সমীক্ষা বা ফিল্ড স্টাডি পদ্ধতির জন্ম । সাধারণত সমাজ বিজ্ঞানের গবেষণায় এই পদ্ধতির ব্যাপক প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। যেমন ধরা যাক বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে । এক্ষেত্রে গবেষণার ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশের কয়েকটি গ্রামের মানুষের জীবন ও সংস্কৃতির উপর তথ্য সংগ্রহ করে গবেষণার বিষয়ের উপর অভিমত ব্যক্ত করা যেতে পারে। সাহিত্য-গবেষণাতেও এই পদ্ধতি ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।