অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা কোন বিশেষ সত্তার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। আর অস্তিত্ববাদ মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় অতি-বাস্তব সমস্যা নিয়ে আলোচনা, ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতা ও মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করার এক বলিষ্ঠ দার্শনিক প্রচেষ্টা।
অস্তিত্ববাদের পটভূমি
দুইটি মহাযুদ্ধে ব্যক্তি-মানুষের নির্মমভাবে নিষ্পেষিত হওয়া, মানবতাবাদ, ভ্রাতৃত্ববোধ সহ সব ধরনের আদর্শবাদের অপমৃত্যু অর্থাৎ, বিশ্বযুদ্ধ দুটির বিভাষিকাময় তাণ্ডবলীলা অস্তিত্ববাদী দার্শনিকদের মনে নিদারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। যার ফলস্বরূপ তাঁরা যে বিপ্লবী দর্শনের ঘোষণা করেন, সে দর্শন মূল্য দেয় ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতা ও মর্যাদাকে ব্যক্তিসত্তা ও মূল্যবোধকে।
প্রথম মহাযুদ্ধাত্তর যুগে জার্মানি ও ফরাসি দেশে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধত্তর সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশে বিপর্যস্ত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই চিন্তার উদ্ভব ও বিকাশ লক্ষ করা যায়।
অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য
১) দর্শনের অস্তিত্ববাদী শাখার প্রায় সকল দার্শনিকরাই ব্যক্তিসত্তার পূর্বে সাধারণ সত্তাকে স্বীকার করার বিরোধী। অর্থাৎ, তাঁদের মতে, ব্যক্তিসত্তা সার্বিক সত্তার পূর্বগামী।
২) নৈতিকতা বা সমাতিক দৃষ্টিভঙ্গি ক্ষেত্রে অস্তিত্ববাদীরা আত্মীয়তায় আত্মকেন্দ্রিক।
৩) পাশ্চাত্য দর্শনে প্লেটো, এরিস্টটলসহ অনেক দার্শনিক মনে করতো যে সবকিছুর মধ্যে একটি এসেন্স বা সার রয়েছে। এটি এমন একটা কিছু যা মৌলিক, যাকে আর ভাঙা যায় না। যেমন:
কারো নাম যদি সৌরভ হয়, এসেন্সিয়ালিস্টারা মনে করবে এমন একটা কিছু আছে যার পরিচয় হলো সৌরভ এবং যা পরবর্তী সময়ে বিকশিত হয়েও মূল এসেন্স একই থাকবে। কিন্তু অস্তিত্ববাদীরা পাশ্চাত্য দর্শনের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যকে ভেঙে ফেলে। অর্থাৎ, তারা সামষ্টিক এসেন্সের ধারণাকে অস্বীকার করে। কেননা প্রতিনিয়ত আমাদেরকে নানা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সে হিসেবে কোন চিন্তার একটা নির্যাস। থাকবে তা সম্ভব নয়।
৪) অস্তিত্ববাদী দর্শনে ব্যক্তির ভয়, অস্তিত্বের সংকটে পড়ার মুহূর্তের অনুভূতিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। কেননা সেই মুহূর্তেই ব্যক্তি প্রবলভাবে অস্তিত্বশীল হয়ে ওঠে।
৫) জ্ঞান তত্ত্বে অস্তিত্ববাদীরা প্রজ্ঞা বিরোধী। হেগেলীয় ভাববাদকে তাঁরা পরিহার করে চলেন। কেননা সেখানে ব্যক্তি অপেক্ষা পরম ব্রহ্মের মূল্য অধিক।
যে বিষয়টি আমাদের অস্তিত্ববাদী চিন্তা বোঝার ক্ষেত্রে আগ্রহ সৃষ্টি করে এবং উপলব্ধিকে পরিষ্কার করে সেটা হলো ল্যাটিন শব্দ “Cogito ergo sum”. যার মূলকথা হলো আমার চিন্তা আছে বলেই আমি আছি। আমার অস্তিত্ব আছে। আমার চিন্তা আমাকে নির্ণয় করে। আর আধুনিক দর্শনের জনক রেনে দেকার্তের একটি বিখ্যাত সূত্র হচ্ছে ‘আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমি আছি।”
রামেন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ভারতীয় দর্শন’ – এ ‘Cogito’ কে ‘আত্মতত্ত্ব’ বলেছেন।
আর যে সকল দার্শনিকের হাত ধরে অস্তিত্ববাদী দর্শনের প্রকাশ ও ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে তাঁদের মধ্যে সোরেন কিয়ের্কেগার্দ (১৮১৩-১৮৫৩), জ্যাঁ পল সার্ত্রে (১৯০৫-১৯৮০), ফ্রঞ্জ কাফকা, আলবেয়ার ক্যামু, দস্তয়ভস্কি, মার্টিন হাইডেগার, ফ্রেডরিখ শীটশে (১৮৪৪-১৯০০), কার্ল জাসপার্স, মার্সেল প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
অস্তিত্ববাদী দার্শনিকদের সাধারণত আস্তিক ও নাস্তিক এ দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়।তবে আস্তিক বা নাস্তিক যে দৃষ্টিকোণ থেকেই তাঁদের চিন্তাকে বিচার করা হোক না কেন, এর মধ্যে একটা বিষয়ে ঐক্য লক্ষ করা যায়। সেটা হলো এ ধারার দার্শনিকেরা মনে করে, ব্যক্তিসত্তা সার্বিক সত্তার অগ্রগামী।