Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

ডিকনস্ট্রাকশন (Deconstruction)

ভূমিকা: বিনির্মাণবাদ হলো টেক্সট এবং তার অর্থের মধ্যে সম্পর্ক বোঝার একটা পদ্ধতি, বিশেষ করে দর্শন ও সাহিত্য সম্পর্কিত ভাষার একটা বিচারমূলক অনুসন্ধান যার ভেতর দিয়ে ভাষার অভ্যন্তরীণ ও ধারণাগত প্রকৃতির অবয়ব বোঝার চেষ্টা করা হয়। তাছাড়া অর্থ সম্পর্কিত গুণগত মান এবং যা বলা হয়নি সেসব না বলা বাণীর অর্থ যাচাইয়ের এক পদ্ধতির কাজে বিনির্মাণ শব্দটা ব্যবহার করা হয়। বিনির্মাণতত্ব বহুরৈখিক মাত্রার ফলাফল। প্রতিটা বাক্যের একাধিক অর্থ থাকতে পারে এবং সেগুলো পরস্পর বিরোধী হতে পারে। এই পরস্পর বিরোধী মাত্রাগুলো একজায়গায় এনে সরল কিছু করার সুযোগ নেই। ব্যখ্যামূলক পাঠের মধ্যে আছে ধাঁধা যেগুলোকে বলে অ্যাপরিয়া, এই অ্যাপরিয়াই বিনির্মাণবাদের মূল প্রেরণা।

বিনির্মাণবাদের সংজ্ঞার্থ

J.W. Bertens তাঁর ”Literary Theory: Basics” গ্রন্থে দারিদার বিনির্মাণতত্বের একটা সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলছেন, দারিদা তাঁর বিনির্মাণতত্বে বলছেন, ভাষা প্রকৃতিগতভাবে অনির্ভরযোগ্য ব্যাপার। একটা শব্দ প্রকৃতপক্ষে যাকে রেফার করে সেটা কিন্তু ফলত শব্দের সাথে শব্দের পার্থক্য, সরাসরি কোন নির্দেশক নয়। কাজেই এই শব্দগুলো একটা ভাষিক পদ্ধতির মধ্যে কাজ করে, যা কখনই বাস্তব জগতকে স্পর্শ করে না। বাস্তবতা ভাষিক প্রকৃতি নির্ধারণ করে। একটা শব্দের থেকে আরেকটা শব্দের যে পার্থক্য যার প্রেক্ষিতে ঐ শব্দটা স্বতন্ত্র হয় তাকে নিয়ে আমাদের ভাবতে হয়। তবে বিনির্মাণ তত্বের একটা বড় ফলাফল হলো, এই তত্ব মনে করে কোন শব্দের অর্থ কোন সময়ই একটা সময়ের ফ্রেমে আবদ্ধ নয়, যার প্রেক্ষিতে এটা চলমান ও পরিবর্তনশীল। দারিদা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাচন প্রক্রিয়ায় কোন পারমাণবিক বিভাজন নেই (There is no atom: Dialanguages: in Points … Interviews, 1974-94)। এর অর্থ আমরা ভাষা দিয়ে যা প্রকাশ করি তার সবটুকু বিভাজন করা সম্ভব। জীবন কী? জীবন অনেক কিছুর সমন্বয়, সম্ভবত বহু মাত্রার এক সমন্বিত দ্যোতনা।

কবি রণজিৎ দাসের এক কবিতা দিয়ে দারিদার বিনির্মাণতত্বকে বোঝাতে চেয়েছেন দারিদা বিশেষজ্ঞ তপোধির ভট্টাচার্য তার “জাক দেরিদা তাঁর বিনির্মাণ” গ্রন্থে। “যা কিছু বিষণ্ণ করে, যেমন সূর্যাস্ত, নারী, গির্জা ও গোলাপ যা কিছু বিষণ্ণ করে, যেমন উৎসব, চাঁদ, নৌকো ও সমুদ্র যা কিছু বিষণ্ণ করে, যেমন বিগ্রহ, ধুপ, মুদ্রা, পূজারিণী যা কিছু বিষণ্ণ করে, যেমন পাহাড়, মেঘ, শালবন, চিঠি ও চুম্বন যা কিছু বিষণ্ণ করে, গরম ভাত, হাতপাখা, গন্ধলেবু, আদিবাসী গ্রাম যা কিছু বিষণ্ণ করে, যেমন সার্কাস, তাঁবু, ফেরিঘাট, পাগলের হাসি যা কিছু বিষণ্ণ করে, যেমন মায়ের ছবি, ডাকঘর, শিলাবৃষ্টি, মাঝিদের গান যা কিছু বিষণ্ণ করে, যেমন সমস্তই, হে জীবন, তোমার আনন্দ-অভিধান”। [‘যা কিছু বিষণ্ণ করে’, সন্ধ্যার পাগল, রণজিৎ দাস]

কবির এই বিচিত্র ও ভিন্ন ভিন্ন অনুভবের ভেতর দিয়ে জীবনের নানা প্রকরণের উন্মেষগুলো প্রকাশিত হয়েছে নানা রঙ্গে, নানা ঢঙে। আসলেই তো জীবনের বিচিত্র রাগ, দুঃখ, মৃত্যু, বিরহ, শান্তি, আনন্দ –এসবই তো জীবনের অংশ। কবিগুরু তো বললেন,

“তবু প্রাণ নিত্যধারা,

হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,

বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে”॥

জীবনের এই বহুমাত্রিকতা, বহুঅনুভবতা আর নিত্য পরিবর্তনশীলতাই তো বিনির্মাণতত্বের সারৎসার। অধ্যাপক তপোধির ঠিকই বলেছেন, “সমস্ত অনুষঙ্গ মনে রেখে লেখা যায়, দেরিদার বিনির্মাণপন্থা আসলে সমস্ত বাচনিক, প্রতীতিগত (ধারণা সম্বন্ধীয়), মনস্ত্বাতিক, নান্দনিক, ঐতিহাসিক, নৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও পাঠকৃতি বিষয়ক দৃশ্য–প্রপঞ্চ- পরিস্থিতিকে আমুল আলোড়িত –রূপান্তরিত- পুনঃস্থাপিত করার কৃতকৌশল”(পৃ. ১২৬)।

দেরিদার বি-গঠনবাদী পাঠ-প্রস্তাবনার উদ্দেশ্যও প্রায় একই রকম। দেরিদা বলেন, বি-গঠনবাদী পাঠ অবশ্যই কতগুলো সম্পর্কের দিকে লক্ষ্য রাখবে, যেগুলোর দিকে লেখক নিজে লক্ষ্য করেননি, তার ভাষা ব্যবহারের ধরন দিয়ে কী তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, আর কী চাননি… ‘বি-গঠন অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করার চেষ্টা করে। (‘Of Grammatology’ পৃ:-১৫৮, ১৬৩)

বিনির্মাণবাদের বৈশিষ্ট্য

১. বিনির্মাণবাদ একটি পূর্ণাঙ্গ সমালোচনা তত্ত্ব;

২. অবদমিত সত্যগুলো তাদের কণ্ঠে ভাষা ফিরে পায়;

৩. বিনির্মাণবাদ নির্দেশ করে অর্থের লীলাময় চরিত্র, তার পরিবর্তনশীলতা, তার ক্ষণস্থায়ীত্ব;

৪. বিনির্মাণবাদে যাবতীয় আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার সামাজিক শর্ত গড়ে ওঠে;

৫. বিনির্মাণবাদে রচনাশৈলি হয় সচেতনভাবেই জমকালো, অতি আলংকারিক;

৬. রচনাগুলোর শিরোনামও থাকে শব্দ চাতুর্য এবং কোনো সূত্র উল্লেখে পূর্ণ;

৭. রচনার মূল বিষয়ও থাকে শব্দ চাতুর্যপূর্ণ;

৮. বিনির্মাণবাদ রচনা প্রায়ই ভাষার কোনো না কোনো মৌলিক (‘material’) বিষয়ে কেন্দ্রীভূত থাকে;

৯. কোনো লেখকের ব্যবহৃত কোনো একটি উপমা (‘metaphor) বা কোনো একটি শব্দের বুৎপত্তি নিয়ে কাজ করে;

১০. বিনির্মাণবাদে নিস্পৃহতার পরিবর্তে এক ধরনের উষ্ণতা থাকে বলে মনে হয়।

১১. বিনির্মাণবাদে সৃষ্টি হয় প্রান্তিক গোষ্ঠীসমূহের সঙ্গে কাতারে কাতার মেলানোর যৌক্তিক পটভূমি;

১২. সামাজিক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বহুদলীয় সংলাপের পরিসর প্রস্তুত হয়;

১৩. ‘ডিকনস্ট্রাকশন’-এর মাধ্যমে গড়ে ওঠে একধরনের সমতলীয় ক্ষেত্র, যেখানে খেলা করে অর্থের বহুমাত্রিকতা।

১৪.  ‘ডিকনস্ট্রাকশন’ প্রক্রিয়ায় একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক উন্মোচিত হয়;

১৫. বিনির্মাণবাদে রচনার প্রবণতা থাকে আবেগ উদ্দীপনার দিকে, প্রায়ই উচ্ছ্বসিত।

বিনির্মাণবাদের প্রেক্ষাপটস্বরূপ  পরিসর

বিশ শতককে বলা যেতে পারে তত্ত্বচিন্তার শতক। উনিশ শতকে বা তারও আগে মানুষের চিন্তাচেতনায় বিভিন্ন প্রবণতার সূচনা হয়েছিল। তবে দুটি বিশ্বযুদ্ধ ও স্নায়ুযুদ্ধের অভিঘাত শুষে নিতে-নিতে ভাবনা-প্রস্থানগুলি প্রসারিত হলো বিচিত্র শাখা-প্রশাখায়। একুশ শতকের শূন্যদশক পেরিয়েও অব্যাহত রয়েছে জিজ্ঞাসার পালাবদল। তবু বিশ শতকই তত্ত্ববিশ্বের প্রকৃত চারণভূমি। অখণ্ড অবিভাজ্য মানববিশ্বের অধিবাসী হিসেবে যত চিনতে পারছি নিজেদের, আমাদের কৌতূহল মহাদেশের গণ্ডি অতিক্রম করে যাচ্ছে দ্রুত। নতুন নতুন তত্ত্বের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে তৃতীয় বিশ্বের অধিবাসীদের চিন্তা-চেতনার সীমান্তরেখাও মুছে গেছে কবেই। সাহিত্য ও সংস্কৃতিতত্ত্বের মাটি ও আকাশ আমূল পালটে গেছে। তারই ফসল বিনির্মাণবাদ।

জে,এ কুডন তাঁর ‘Dictionary of Literary Terms’ গ্রন্থে বিনির্মাণবাদ সম্পর্কে বলেন, “একটা বই যা বলতে চায় ঠিক সেভাবে না পড়ে তাকে অন্যভাবেও পড়া যায়… বইটিতে বহু ইঙ্গিত পূর্ণ বহু কথার সমাহার থাকতে পারে, মৌলিক বিরোধ পূর্ণ কিছু কথা থাকতে পারে, কোনো ‘প্রতিষ্ঠিত’ সত্য বিরোধী মন্তব্য থাকতে পারে। এভাবে বইটি নিজেই নিজেকে ‘প্রবঞ্চিত’ করতে পারে।”

অতএব, দেখা যায় বিনির্মাণবাদ এমন বিষয়ই চর্চা করে, যাতে মূল পুস্তকের অবমাননা করা বা পুস্তকটির বিরুদ্ধ পাঠ হয়। পুস্তকটিকে এমনভাবে পাঠ করা হয় যেন পুস্তকটি অভ্যন্তরস্থ বিরোধ ও অপ্রাসঙ্গিকতাগুলো তুলে ধরে পুস্তকটির আপাত ঐক্যের মধ্যে অনৈক্য খুঁজে বার করাই পুস্তকটি পাঠের প্রধান উদ্দেশ্য। এর আগের প্রজন্মের ‘নব্য-সমালোচনাবাদের’ (New criticism) উদ্দেশ্য ছিল এর বিপরীত, তাদের উদ্দেশ্য ছিল: পুস্তকটি আপাত অনৈক্যের মধ্যে ঐক্য সূত্র আবিষ্কার করা। বি-গঠনবাদের উদ্দেশ্য অনুসারে; বিনির্মাণবাদে পুস্তকটির কোনো একটি বিশেষ বিষয় – কোনো একটা নির্দিষ্ট উপমাকে নেয়া হয় এবং সেটিকেই সম্পূর্ণ পুস্তকটি মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে নেয়া হয়, এবং সে আলোকেই পুস্তকটি পাঠ করা হয়।

প্রধানত ভাষাতত্ত্ব থেকেই কাঠামোবাদের উদ্ভব। ভাষাতত্ত্ব জ্ঞানের এমন একটি শাখা যা ঐতিহ্যগতভাবেই নৈর্ব্যক্তিক জ্ঞান প্রতিষ্ঠায় প্রত্যয়ী। ভাষাতত্ত্ব বিশ্বাস করে, যদি সঠিক পর্যবেক্ষণ করা যায়, সঠিকভাবে তথ্য সংগ্রহ করা যায় এবং যৌক্তিকভাবে অগ্রসর হওয়া যায় তাহলে ভাষা ও বিশ্ব সম্পর্কে একটা নির্ভরযোগ্য উপসংহারে আমরা পৌঁছতে পারি। কাঠামোবাদ ভাষাতত্ত্বের দৃঢ় বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিটি ধারণ করে: নির্ভরযোগ্য সত্য বিনির্মাণে কাঠামোবাদ যুক্তি, নিরীক্ষণ প্রক্রিয়ায় তথ্য নির্ভরতায় বিশ্বাস করে।

তুলনায় বিনির্মাণবাদ দর্শন-ভিত্তিক। দর্শন জ্ঞানের এমন একটি শাখা, যা থেকে কোনো বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ধারণা পাওয়া বেশ কঠিন। দার্শনিক নীৎসের বিখ্যাত উক্তি এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য। নীৎসে বলেন, ‘There are no facts, only interpretations’ বলা যায় জ্ঞানের বিশেষ শাখা হিসেবে দর্শন নিজেই সংশয়বাদী’ তাই সাধারণ জ্ঞানভিত্তিক ধারণা ও প্রত্যয়কে দর্শন গ্রহণ করে না। যাকে স্বতঃসিদ্ধ ধরে নেয়া হয় তাকে প্রশ্নাক্রান্ত করাই দর্শনের প্রাগ্রসরমানতার ধারা। বিনির্মাণবাদ দর্শনের এই সংশয়বাদিতার ধারক এবং এই ধারাকেই তীব্রতর করে। বৈজ্ঞানিক কোনো তথ্য-উপাত্তে নির্ভর করাকে বিনির্মাণবাদ অতি সারল্য মনে করে এবং এমন একটা মর্ষকামী বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় নিয়োজিত হয় যে, কোনো কিছুই চূড়ান্তভাবে জানা সম্ভব নয়।

বিনির্মাণবাদে রচনার প্রবণতা থাকে আবেগ উদ্দীপনার দিকে, প্রায়ই উচ্ছ্বসিত। আর তাদের রচনাশৈলি হয় সচেতনভাবেই জমকালো, অতি আলংকারিক। তাদের রচনাগুলোর শিরোনামও থাকে শব্দ চাতুর্য এবং কোনো সূত্র উল্লেখে পূর্ণ। রচনার মূল বিষয়ও থাকে শব্দ চাতুর্যপূর্ণ।

বিনির্মাণবাদ রচনা প্রায়ই ভাষার কোনো না কোনো মৌলিক (‘material’) বিষয়ে কেন্দ্রীভূত থাকে, কোনো লেখকের ব্যবহৃত কোনো একটি উপমা (‘metaphor) বা কোনো একটি শব্দের বুৎপত্তি। সর্বোপরি বিনির্মাণবাদে নিস্পৃহতার পরিবর্তে এক ধরনের উষ্ণতা থাকে বলে মনে হয়।

কাঠামোবাদীরা মনে করে ভাষাই দৃশ্যমান জগৎ সৃষ্টি করে; এই অর্থে যে, আমরা ভাষা ছাড়া বাস্তব জগতে প্রবেশ করতে পারি না। কাঠামোবাদীরা ভাষাকেই তাদের চিন্তা চেতনার কেন্দ্রে স্থান দেন। আর ভাষা হচ্ছে একটা সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা, এর উপর আমাদের নির্ভরতার গুরুত্ব সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারলে তা কোনোভাবেই কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক হতাশায় পতিত হবার কোনো অবকাশ রাখে না।

বিনির্মাণবাদে অনেক বেশি মৌলবাদী কারণ তারা মনে করে, বাস্তব নিজেই পুস্তক কেন্দ্রিক। শুধু ভাষা থেকে কোনো জ্ঞান সম্ভব নয় বলে বিনির্মাণবাদীরা মনে করে। তাদের মতে, শব্দ যে সব ঈঙ্গিতকে ধারণ করে রাখার সম্ভাবনা আছে সেগুলো সব ভাসমান, অস্থির। ভাষা সম্বন্ধে বিনির্মাণবাদীদের বদ্ধমূল ধারণা হলো: ভাষা অনেকটাই তরল পদার্থের মতো, শব্দ যে সঙ্কেতগুলোকে বহন করে, সেগুলো সদা ভাসমান এবং যে-কোনো সময়ে তাদের অর্থ পিছলে যেতে পারে (slippage) বা ছলকে পড়তে পারে (‘spillage’) ভাষার এই পিচ্ছিল বিশৃঙ্খলা অননুমেয়ভাবে ভাষার সঙ্কেতকে ‘দাতার’ (giver) কাছ থেকে গ্রহীতার (receiver) কাছে সঠিকভাবে শব্দের (container) মাধ্যমে পৌঁছার প্রচেষ্টাকে অস্বীকার করে। ভাষা সম্পূর্ণভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণে নয়, তাই শব্দের অর্থকে সঠিক জায়গায় সঠিকভাবে স্থাপন করা যায় না। শব্দগুলোর যে প্রচলিত অর্থ বিদ্যমান, তা যে শতভাগ বিশুদ্ধ এমন নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। শব্দগুলো প্রায়শ তাদের বিপরীত শব্দ দিয়ে প্রভাবিত (‘contaminated’) হয় – আমরা দিনের উল্লেখ না করে রাতকে বুঝাতে পারি না, মন্দের উল্লেখ না করে ভালোকে বুঝাতে পারি না। অনেক সময় শব্দটির নিজস্ব ইতিহাস ও তার অর্থ উদ্ঘাটনে বাধার সৃষ্টি করে। শব্দটির পুরানো অর্থ, নতুন অর্থ প্রকাশের উপর প্রভাব ফেলে। আর এসব অস্বচ্ছতা দূর না হলে আমরা শব্দটি ব্যবহার করি না। যেমন, অতি সাধারণ একটি শব্দ ‘guest’ ব্যুৎপত্তিগতভাবে ‘hostis’ শব্দটির সঙ্গে জড়িত যার অর্থ ‘শত্রু বা আগন্তুক’। ফলে, ‘guest’ বলতে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকেই বুঝায়। এরকমভাবে অনেক শব্দকে তাদের রূপকের ভিত্তিতে দৰ্শনে বা সাহিত্যে ব্যবহার করলে, তাদের অর্থ প্রকাশে অস্বচ্ছতা দেখা দেয় এবং কোনো একক অর্থ প্রকাশে তাদের ব্যবহার করা যায় না। উত্তর কাঠামোবাদ, এই ভাষাতাত্ত্বিক জটিলতার দিকেই আলোকপাত করে।

কাঠামোবাদে আমরা বাস্তবকে যেভাবে গঠন ও বিন্যস্ত করি তাকেই প্রশ্ন করে, আমাদের ধারণাগুলোকে নাড়া দিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখায় । প্রচলিত ধারণাকে পুনর্গঠিত, পুনর্বিন্যস্ত করে আমরা আরো নির্ভরযোগ্য তথ্য পেতে পারি, কাঠামোবাদ এমনি বিশ্বাস করে। বিনির্মাণবাদে তুলনায় আরো বেশি রক্ষণশীল; কারণ যুক্তি (‘reason’ ) বুদ্ধিকেই তারা অস্বীকার করে, মানুষের স্বাধীন সত্তাকে অস্বীকার করে।

১৯৬০-এর দশকের শেষাংশে, উত্তর কাঠামোবাদের আরেক প্রবক্তা হলেন, জ্যাক দেরিদা। বস্তুত, ১৯৬৬ সালে দেরিদার (‘Structure’ sign and Play in the Discourse of Human Sciences’ শীর্ষক বক্তব্যই উত্তর কাঠামোবাদের সূচনা করে। দেরিদা তাঁর এই বক্তব্যে আধুনিক বুদ্ধিবৃত্তির জগতে একটা নতুন সূচকের (“event”) উল্লেখ করেন। এই নতুন সূচকে তিনি নীৎসে, হেইডেগার এর দর্শনের সারাৎসারকে ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষণের সঙ্গে সংযুক্ত করেন। আর এই সূচকের লক্ষ্য ছিল বুদ্ধিবৃত্তির জগৎকে বিকেন্দ্রিত’ (‘decentred”) করা।

এর পূর্ব পর্যন্ত মূল্যবোধের আদর্শের একটা কেন্দ্রকে নিশ্চিত ধরে নেয়া হতো: যেমন, রেনেসাঁ যুগে মানুষই সব পার্থিব কর্মের মূলে এমন ধারণা পোষণ করা হতো এবং সেই আলোকেই বিশ্বের যাবতীয় বিষয়ের পরিমাপ করা হতো। পাশ্চাত্যের শ্বেতাঙ্গ মানুষের পোশাক, আচরণ, বুদ্ধিবৃত্তিক মান, স্থাপত্যকলা এসব কিছুকেই এক সময় প্রমিত মানের ধরে নেয়া হতো আর এর ব্যতিক্রমকে ‘ভিন্ন’ এবং প্রান্তিক ভাবা হতো। বিংশ শতকে এসে এরকম প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রগুলো সব ক্ষয়ে যেতে লাগল। কখনো কখনো কোনো ঐতিহাসিক কারণে—যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সভ্যতার ক্রমিক প্রাগসরতার ধারণায় প্রলয় আনে, ইউরোপ মানব সভ্যতার কেন্দ্র বিন্দু এই ধারণাকে ধ্বংস করে দেয়। কখনো কখনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার চিন্তার জগতে আমূল পরিবর্তন আনে—যেমন, আপেক্ষিকতা, (relalivity) সময় ও মহাশূন্য স্থির এই ধারণাকে বদলে দেয়। আবার কখনো কখনো বুদ্ধিবৃত্তি এবং শিল্প সাহিত্য জগতের বৈপ্লবিক ধারণা ও পূর্বতন ধারণাকে বদলে দেয়, যেমন—বিংশ শতকের প্রথম ত্রিশ বছর শিল্প সাহিত্যে আধুনিকতাবাদ: সঙ্গীতে ঐকতান, সুরকে, উপন্যাসে ধারাবাহিক বর্ণনাকে এবং চিত্রশিল্পে দৃশ্যমান জগতের রূপায়নকে বাতিল করা হয।

দেরিদা তাঁর প্রকাশিত ‘Speech and Phenomena’ of Grammatology’ এবং ‘Writing and Difference’ এই তিনটি গ্রন্থে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করেন। পর পর প্রকাশিত এই তিনটি গ্রন্থই সাহিত্য তত্ত্বের উপর রচিত নয় বরং দর্শনের উপর রচিত। কিন্তু দেরিদা তাঁর আলোচনায় এমনভাবে অগ্রসর হন, সেখানে অন্যান্য দার্শনিকদের ‘বি-গঠনবাদী’ তত্ত্বগুলোর নির্বাচিত দিক নিয়ে গভীর এবং বিস্তারিত আলোচনা করে। সাহিত্যতাত্ত্বিকরা সেগুলো উদ্ধৃত করেই সাহিত্য রচনা বিশ্লেষণে প্রয়োগ করে। সাহিত্যতাত্ত্বিকরা দেরিদা উল্লিখিত ‘বিকেন্দ্রীত বিশ্বের’ মূল তত্ত্বকেই প্রতীক ধরে সাহিত্যে ‘বি-গঠনবাদী’ আলোচনায় ব্রতী হন। ফলে যে সব সাহিত্য রচনাকে এতদিন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ শিল্প কর্ম বিবেচনা করা হতো, সেগুলোকে সাহিত্যতাত্ত্বিকরা খণ্ডিত, বিভাজিত ও কোনো কেন্দ্রবিহীন বলে সনাক্ত করেন।

জাক দেরিদা  বিনির্মাণবাদ

জাক দেরিদা বিংশ শতাব্দীর একজন ফরাসি দার্শনিক। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে পৃথিবীর চিন্তাশীল মনিষীদের মধ্যে তিনি ছিলেন খ্যাতির শীর্ষে। তার প্রবর্তিত তত্ত্ব ডিকন্সট্রাকশন (অ-নির্মাণ বা বিনির্মাণ) নামে অভিহিত।

দেরিদার চিন্তা ও বিশ্লেষণ উত্তরাধুনিক দর্শনের সাথে জড়িত এবং তার দার্শনিক অভিমুখ উত্তর কাঠামোবাদী (post-structuralist) কাজ হিসেবে পরিগণিত। দেরিদা তার বিভিন্ন বক্তবব্যে ও লেখায় কাঠামোবাদের (structuralism) নানা দুর্বলতা, অসঙ্গতি ও অপর্যাপ্ততা চিহ্নিত করেন।সৃষ্ট কোনও তত্ত্বকে চিরন্তন সত্য মনে করে স্থির বসে থাকলে আমরা কোনোদিনও সত্যে উপনীত হতে পারি না। তাই আগের তত্ত্বগুলো খারিজ করে আমাদের নিয়ত নতুন তত্ত্বের এষণায় থাকতে হয়। মোটামুটি এ-ই হলো দেরিদার চিন্তার সারাৎসার।

দেরিদা দেখান:

* প্রতিটা বাক্যের একাধিক অর্থ হতে পারে

* সেই অর্থগুলো পরস্পর-বিরোধী হতে পারে

* একই বাক্যের নানা ব্যাখ্যার পরস্পর-বিরোধিতা কমানোর উপায় নেই

* তাই ব্যাখ্যা-মূলক পাঠের সীমাবদ্ধতা আছে- এটাকে এপোরিয়া বলে

ডিকনস্ট্রাশনের মূলে আছে ডিফারেন্স (Différance)। এ তত্ত্ব অনুযায়ী: একটি শব্দের নির্দিষ্ট কোন অর্থ নেই- একটি শব্দের অর্থ তার কাছাকাছি সে সমার্থক শব্দগুলো আছে, তার সাথে পার্থক্য করে নির্ণয় করতে হয়। বাড়ি শব্দটির অর্থ নির্ণয় করতে আমদের দেখতে হবে কীকরে এই শব্দটি ঘর, গৃহ, বাটিকা, প্রাসাদ, অট্টালিকা ইত্যাদি শব্দের থেকে আলাদা।

যেহেতু প্রতিটি শব্দ একটি ইমেজ বা ছবি (আসল বা এবস্ট্রাক্ট)’র প্রতিনিধিত্ব করে, সেহেতু বাড়ির সাথে গৃহ, বাটিকা, অট্টালিকা ইত্যাদি শব্দের পার্থক্য নিরূপণ করতে, একই সাথে সমার্থক শব্দগুলোর ইমেজ, সামাজিক, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকেও ভাবতে হবে।

দেরিদা তার বিভিন্ন বক্তবব্যে ও লেখায় কাঠামোবাদের (structuralism) নানা দুর্বলতা, অসঙ্গতি ও অপর্যাপ্ততা চিহ্নিত করেছেন। মানবিক ও সমাজ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার প্রভাব রয়েছে। দর্শন, সাহিত্য ছাড়াও আইন নৃতত্ত্ব, ইতিহাস-রচনা, ভাষাতত্ত্ব, সামাজিক-ভাষাতত্ত্ব, মনোঃসমীক্ষণ, রাজনৈতিক তত্ত্ব, ধর্মগবেষণা, নারীবাদ, সমকামিতা গবেষণায়ও তার প্রভাব আছে।

দেরিদা ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুলাই তৎকালীন ফ্রান্স অধ্যুষিত আলজেরিয়ার আলজিয়ার্স নগরীর এল বিয়ার শহরতলিতে এক ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব কেটেছে মুসলিম-প্রধান আলজিরিয়ায়। ছাত্রজীবনেই রুশো, নিৎসে, সার্ত্র, কামু ইত্যাদির পাঠ সেরে ফেলেন। সরবোন, কলম্বিয়া, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে থিতু হন। এখানেই তিনি আমৃত্যু মানববিদ্যার অধ্যাপনা করেন। তিনি রলাঁ বার্থ, জাক লাকাঁ, লুসিয়ঁ গোল্ডমান, জঁ-পল ভেরনা, ত্রিস্তান তোদোরব এবং জঁ ইপ্পোলিত – প্রমুখ নামজাদা বিদ্বান ও বুদ্ধিজীবীদের সমসাময়িক বা সান্নিধ্যধন্য।

সামাজিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে দেরিদা আর বিনির্মাণ (ডিকনস্ট্রাকশন) সমার্থক। দেরিদা মূলত কাজ করেছেন ভাষা নিয়ে। ‘মানববিদ্যার চিহ্ন ও ক্রীড়া’ শীর্ষক প্রবন্ধের মাধ্যমে জাক দেরিদা বিশ্বদরবারে ব্যাপক স্বীকৃতি

লাভ করেন। ষাটের দশকে কাঠামোবাদের পরিবর্তিত রূপ উত্তর-কাঠামোবাদ তাত্ত্বিকদের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। আর এতে দেরিদার অবদানই সর্বাধিক।

কিছু সমালোচকের মতে Speech and Phenomena (1967) তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অন্যান্য কাজের মধ্যে Of Grammatology, Writing and Difference, and Margins of Philosophy তার উল্লেখযোগ্য কাজ। ২০০৪ সালের ৯ অক্টোবর এই মহামনীষী প্যারিসে মৃত্যু বরণ করেন।

দারিদার বিনির্মাণতত্বের সারৎসার এক জায়গায় করলে দাঁড়ায়:

ক) বিনির্মাণতত্ব বহুরৈখিক মাত্রার ফলাফল;

খ) আসল সত্য জানা অসম্ভব;

গ) প্রতিটা বাক্যের একাধিক অর্থ থাকতে পারে এবং সেগুলো পরস্পর বিরোধী হতে পারে;

ঘ) এই পরস্পর বিরোধী মাত্রাগুলো একজায়গায় এনে সরল কিছু করার সুযোগ নেই;

ঙ) ব্যখ্যামূলক পাঠের মধ্যে আছে ধাঁধা যেগুলোকে বলে অ্যাপরিয়া, এই অ্যাপরিয়াই বিনির্মাণবাদের মূল প্রেরণা।

বিনির্মাণবাদে বিভিন্ন তাত্ত্বিকদের সৃষ্টিকর্ম

বিনির্মাণবাদকে মোটামুটি তিনটি পর্যায়ে চিহ্নিত করা যায় যথা-

ক. শাব্দিক (verbal),

খ. পুস্তক কেন্দ্রিক (textual) এবং

গ. ভাষাতাত্ত্বিক (linguistic)

এই পর্যায় তিনটিকে কবি ডিলন টমাসের ‘A Refusal to Mourn the Death by Fire of a child in London’ কবিতাটিকে বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে।

শাব্দিক (verbal) পর্যায়টি, ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে এস্পসনের ‘Seven Types of Ambiguity’ গ্রন্থে প্রস্তাবিত নিবিড় পাঠের (close reading) সাথে অনেক সাদৃশ্যপূর্ণ। নিবিড় পাঠ প্রস্তাবনা, কোনো রচিত পুস্তকের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও স্ববিরোধগুলোর অনুসন্ধান করে, যাকে প্রকৃষ্টভাবে শাব্দিক অনুসন্ধান বলা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ডিলন টমাসের উল্লিখিত কবিতাটির শেষ লাইন ‘After the first death there is no other ‘ নেয়া যায়। এ লাইনটি স্ববিরোধী বিবরণ দেয় এবং লাইনটি নিজেই নিজের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে: কারণ যদি প্রথম মৃত্যু বলে কিছু থেকে থাকে তাহলে তা ইঙ্গিত করে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ বলেও কিছু আছে। অতএব, ‘the first death’ শব্দ গুচ্ছ সুস্পষ্টতই ইঙ্গিত করে মৃত্যুর অন্য পর্বগুলোও আছে। এরকম অন্তর্বিরোধকেই ‘ভাষার বি-গঠনবাদীরা’ অবিশ্বস্ততা, অনির্ভরযোগ্যতা হিসেবে দেখেন। কবিতাটিতে এরকম অনেক দৃষ্টান্ত আছে। আপনি নিজেই কবিতাটি গভীরভাবে পড়ে দেখুন এরকম আরো কোনো দৃষ্টান্ত খুঁজে বের করতে পারেন কি না। আপনি ‘until’ শব্দটির সঙ্গে ‘never’ শব্দটির ব্যবহার করা দিয়েই আপনার অনুসন্ধান শুরু করতে পারেন।

উত্তর কাঠামোবাদের আরেকটি দিক হচ্ছে, সাধারণভাবে ব্যবহৃত বিপরীত শব্দ যেমন: পুরুষ-নারী, দিন-রাত্রি, আলো-আঁধার ইত্যাদি শব্দ যে দিক নির্দেশ করে তাকে উল্টে দেয়া, যাতে এসব শব্দের প্রচলিত অর্থের চেয়ে কাঠামোবাদীদের নির্ণিত অর্থ ‘বিশেষ সুবিধা’ পায়, বেশি গ্রাহ্য বিবেচিত হয়। তাই ডিলন টমাসের কবিতাটিতে আলোর চেয়ে আঁধারই বেশি জীবনের প্রতীকার্থে ব্যবহৃত, কবি যেমন বলেন, কবিতাটির স্ববিরোধী বর্ণনার প্রতিফলনই কবিতার ভুবনকে উল্টে দেয় একই সাে যে পৃথিবীতে আমরা বাস করি তার রূপকেও উল্টে দেয়। কবিতা ও দৃশ্যমান পৃথিবীর এরকম ব্যাখ্যাকে বি-গঠনবাদীরা লক্ষণ বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেন; ভাষা আমাদের দৃশ্যমান পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি আঁকে না, ভাষা নিজেই নিজের জন্য দৃশ্যমান পৃথিবীর সমান্তরাল একটি পৃথিবী গড়ে। ডিলন টমাসের কবিতায় চিহ্নিত স্ববিরোধী শব্দগুচ্ছের মতো অন্যান্য কবিতায়ও একই রকম শব্দগুচ্ছ আবিষ্কার করার মাধ্যমেই বি-গঠনবাদ তাঁর কবিতার বিরুদ্ধ-পাঠ (‘against itself) শুরু করে এবং সঙ্কেত আাপকের (signifier) বিরুদ্ধে প্রকাশিত সঙ্কেতের (signified) দ্বন্দ্ব উদ্ঘাটন করে। এবং এরা কীভাবে অবদমিত অচেতনকে বিধৃত করে তা বিশ্লেষণ করে দেখায়। বি-গঠনবাদের এই প্রাথমিক পর্যায়টিই পরবর্তী পর্যায়গুলোকে প্রভাবিত করে।

বিনির্মাণবাদের পুস্তক কেন্দ্রিক (textual) পর্যায়টি প্রত্যেক শব্দগুচ্ছকে আলাদাভাবে বিশ্লেষণ না করে সমগ্র পুস্তকটি বা কবিতাটিই বিশ্লেষণ করে। বিনির্মাণবাদের দ্বিতীয় পর্যায়ে, সমালোচক পুস্তকটি বা কবিতাটির ধারাবাহিকতায় কোনো বিচ্যুতি বা অসংলগ্নতা আছে কিনা, তা বিচার করে দেখে: কারণ এসব বিচ্যুতি, অসংলগ্নতাই রচয়িতার এককেন্দ্রিক চিন্তাহীনতার পরিচয় বহন করে। বিচ্যুতি ও অসংলগ্নতাগুলো অনেক রকমের হতে পারে (পূর্বে বর্ণিত ছকটি দ্রষ্টব্য); সেগুলো, প্রধান আলোচ্য বিষয়, সময়, বক্তব্যের ধরন, দৃষ্টিভঙ্গি, গতি ও শব্দ ব্যবহারজনিত হতে পারে। ব্যাকরণ ব্যবহারেও সে সব বিচ্যুতি, অসংলগ্নতা থাকতে পারে: প্রথম পুরুষ থেকে তৃতীয় পুরুষ ব্যবহার, বা অতীতকাল থেকে বর্তমানকালে আসা। এভাবে বি গঠনবাদীরা সমগ্র রচনাটির  বিশ্লেষণ করে। উদাহরণস্বরূপ-

ডিলন টমাসের কবিতাটিতে প্রচুর সময়-বিচ্যুতি, দৃষ্টিকোণের বিচ্যুতি আছে ফলে কবিতাটির মসৃণ অগ্রগমন বিঘ্নিত হয়। তাই কবিতাটির প্রথম দুই স্তবকে মহাকালের যাত্রাপথকে কল্পনা করা হয় এবং পৃথিবীর আসন্ন বিলোপকে (‘end of the world’) কল্পনা করা হয়…. শেষ আলো ফুটে ওঠে, সমগ্র স্থির হয়ে যায়, যে বৃত্তে পশু, পাখি, ফুল, (‘Bird, beast and flower’) জন্ম নেয়, তা স্থির হয়ে আসে এবং সব শেষে সর্বগ্রাসী আঁধার (‘all humbling darkness’) নেমে আসে। কিন্তু তৃতীয় স্তবকে আবার বর্তমানকালের কথা বলা হয়েছে—শিশুটির মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে, ‘The majesty and burning of the child’s death’ – শেষ স্তবকটি একটা বৃহৎ দৃষ্টিতে লন্ডন শহরকে দেখবার চেষ্টা করে কিন্তু তা কেবল লন্ডন শহরের ইতিহাসেই সীমাবদ্ধ থাকে; *the unmourning water of the riding Thames’। এ ছাড়া শিশুটির মৃত্যুকে আর কোনো বৃহত্তর তাৎপর্যে চিহ্নিত করা হয় না, তাই টমাসের কবিতার ভাব পরিবর্তনগুলোর অর্থোদ্ধার কঠিন হয়ে পড়ে।

আপনি কবিতাটি আরেকবার পড়ে দেখুন, এরকম কোনো বিচ্যুতি বা বিঘ্নিত ধারাবাহিকতা কবিতাটিতে খুঁজে পান কিনা। কোনো কিছু কবি বাদ দিয়ে গেলেন কিনা (Omission) তাও আপনি খুঁটিয়ে দেখবেন অর্থাৎ রচনাটিতে রচয়িতা কোনো কিছু বলা বাদ রাখলেন কি না যা তার বলা উচিত ছিল। আপনি হয়তো প্রথমেই প্রশ্ন করতে পারেন, শিশুটির মৃত্যুতে কেন কবি শোক প্রকাশে অনাগ্রহী, সে কথা কবি স্পষ্ট করে বলেননি কেন ।

সবশেষে ‘ভাষাতাত্ত্বিক’ পর্যায়টি আসে, যার লক্ষ্য হচ্ছে ভাষার পর্যাপ্ত ব্যবহারকে প্রশ্ন করা। এরকম অবস্থা তখনি আসে যখন ব্যবহৃত ভাষার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়: যা বলার মতো নয় কবি যখন তা বলেন বা কবি যদি বলেন ভাষা ভাবকে অতিরঞ্জিত করে বা কম রঞ্জিত করে অথচ কবি নিজেই সে রকম ভাষা ব্যবহার করেন। উদাহরণস্বরূপ-

ডিলন টমাসের কবিতা ‘ A Refusal to Mourn’ কবিতাটিতে কবি কোনো শোক প্রকাশ করবেন না বলেও সমগ্র কবিতাটি জুড়ে শোকই প্রকাশ করেন। কবিতাটির তৃতীয় স্তবকে কবি বলেন তিনি মানবতাকে হত্যা করবেন না (‘murder / The mankind of her going with a grave truth’)। এরকম বলে শোক প্রকাশের প্রচলিত সব ভাষাকে বর্জন করে কবি একটা নতুন চমক দিতে চান। তবুও কবির সে চমক নীরবতায় প্রকাশিত হয় না বরং সমবেত প্রার্থনা সঙ্গীতের গুরু গাম্ভীর্যে কবিতাটির তৃতীয় স্তবকে ঘোষিত হয়: ‘Deep with the first dead lies London’s daughter’। এই লাইনটি প্রচলিত স্তুতির সুরে মৃত শিশুটিকে জীবন জয়ী ‘London s daughter’ (অসম্ভব কল্পনা) বলে। সব যুগের শব-যাত্রায় শিশুটির শব-যাত্রাকে একীভূত করে মৃত্তিকা মাতার কোলে (London clay) শিশুটিকে সমাধিস্থ করে ।

আমরা বলতেও পারি, কবিতাটিতে ডিলন টমাস প্রথমে ভাষার চক্র চিহ্নিত করেন, পরে কবি নিজেই ভাষার চক্রে পড়ে যান। ‘textual’ দৃষ্টিকোণ থেকে পুনরায় কবিতাটিকে দেখুন। উপরে উল্লিখিত উদাহরণটির মতো আর কোনো উদাহরণ খুঁজে পান কি না দেখুন। ‘mother’ ‘daughter’ শব্দ দুটির ব্যবহারের মাধ্যমে যে পরিবারের কল্পনা করা হয়েছে তা নিয়ে ভাবুন এবং ‘murder’ এবং ‘unmourning’ Thames ধারণাটি কোনো ইঙ্গিতবহ কিনা ভেবে দেখুন ।

একবার যদি কবিতাটির ব্যবচ্ছেদ করা যায়, তখন তা সহজেই বিনির্মাণবাদের আওতায় এসে পড়ে এবং একটা খণ্ডিত, স্ববিরোধী, সাংস্কৃতিক ও ভাষাভিত্তিক লক্ষণ নিজের মধ্যে স্পষ্ট করে তোলে। বিনির্মাণবাদকে আমরা যে স্তরে ভাগ করে দেখিয়েছি তা কবিতা ছাড়া অন্যান্য রচনার বেলায়ও একইভাবে প্রযোজ্য। এই তিনটি স্তর বিনির্মাণবাদকে একটা সমালোচনা তত্ত্ব হিসেবে সুপরিচিত করে।

সবশেষে, বিনির্মাণবাদ সমালোচনা তত্ত্বে ‘aporia’ পরিভাষাটি বহুল প্রচলিত। ভাবার্থে শব্দটির অর্থ অচলাবস্থা (impasse’) এবং এ দিয়ে এমন স্ববিরোধকে বুঝায়, যার জটিলতার জট সহজে ছাড়ানো যায় না। সম্ভবত শব্দটির অর্থ ব্রিটিশ সমালোচক উইলিয়াম এম্পসনের ‘Seven Types of Ambiguity’ (১৯১০) গ্রন্থটির মূল বক্তব্যে যে সাতটি দ্ব্যর্থকতার উল্লেখ করা হয়েছে তার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। যেমন, কুপারের কবিতাটির তৃতীয় স্তবকের শুরুতে বলা হয়েছে ‘No poet wept him’ কিন্তু কবিতাটির মূল ভাবের সঙ্গে এই লাইনটি সাংঘর্ষিক। এই ‘সাংঘর্ষিকতা’ থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ নেই। ১৯৬৮ সালে রচিত, রোনাল্ড বার্থেসের ‘The Death of the Author’ প্রবন্ধটিকে কাঠামোবাদ থেকে উত্তর কাঠামোবাদের সূচক বলা হয়ে থাকে। প্রবন্ধটিকে বার্গেস মত দেন, ‘সব জটিলতার জট ছাড়াতে হবে’ কোনো কিছুকে বাদ দেয়া যাবে না (‘everything must be disentangled nothing deciphered’)। ‘aporia’ পরিভাষাটি শুধু মাত্র পুস্তক কেন্দ্রিক সমালোচনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও, ‘aporia’ শিরোনামে অনেক জটিল বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বিনির্মাণবাদ কবিতার ‘ক্ষুদ্রতম’ অংশকেও বিশ্লেষণ করে দেখে একথা সহজে বুঝা যায়, কিন্তু কবিতাটিতে একটি স্বচ্ছ বোধের ‘ক্ষুদ্রতম’ (grain) অংশ আছে, যা অনুসারে সমালোচক তাঁর বিশ্লেষণে এগিয়ে যাবেন এমন ধরে নেয়া বিভ্রান্তিকর হবে। কুপারের কবিতাটির বিশ্লেষণ এ কথাটাই প্রমাণ করে থাকবে।

ডিকনস্ট্রাকশন’/বিনির্মাণবাদের ঘাটতি কোথায়?

‘ডিকনস্ট্রাকশনিস্ট’রা কোনো একটি তত্ত্ব পর্যালোচনার সময় সেই তত্ত্বে বিদ্যমান কেন্দ্রাভিমুখীনতা সনাক্ত করেন। ভাঁজ খুলে দেখান যে, সেই তত্ত্বের গঠনকাঠামোয় কীভাবে একটি কেন্দ্রীয় টান ক্রিয়াশীল রয়েছে। এবং তা নির্দেশিত হয় সেই তত্ত্বের খামতি হিসেবে। সেই হিসেবে একজন ‘ডিকনস্ট্রাকশনিস্ট’ চিন্তার দিক থেকে থাকবেন একদম শূন্য। অবাধ ও নিরপেক্ষ ‘ব্ল্যাঙ্ক ডিস্ক’। ভালো মন্দ কিছুই যেখানে আগে থেকে ‘আপলোড’ করা নাই। তাই হওয়ার কথা। ফলে, তার কাজ হবে নৈর্ব্যক্তিক। তিনি কাজ করবেন বিষয়গত ‘ডিফারেন্স’-এর ভিত্তিতে। অর্থাৎ, শেষাবধি যে কেন্দ্রীয় টানটি সনাক্ত হবে তা মূলত টেক্সটেই নিহিত থাকবে, ‘ডিকনস্ট্রাকশনিস্ট’-এর মাথায় অন্তত নয়। কিন্তু রবার্ট উইকস এতে বাদ সাধছেন। তিনি খোলাসা করে জানিয়ে দিলেন তার আপত্তির কথা। তার কথা হলো:

If we consider examples of Derrida’s own deconstructions, for instance, we notice that they are impressively imaginative, and are unlikely to have been duplicated by anyone who might have been independently deconstructing the same text. This is due, significantly, to Derrida’s own wealth of knowledge… The deconstructor is thus very far from acting as the objective force of difference when approaching a text. The deconstructor always operates with a wealth of background presuppositions, and unavoidably brings these to bear on the activity of discerning the text’s tensions and internal conflicts. Any particular deconstruction, then, will carry the mark of the deconstructor. (Wicks, 2003: 215)

রবার্ট উইকসের আপত্তি – ‘ডিকনস্ট্রাকশনিস্ট’রা যেকোনো প্রকার পূর্বানুমান থেকে নিজেদের দূরে রাখতে অপারগ। এমনকি এটা হতে পারে তাদের ব্যক্তিগত দক্ষতার মতো ব্যাপার। নয়তো একই টেক্সট ‘ডিকনস্ট্রাকট’ করার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে এতো গরমিল কেন! এছাড়া তিনি ‘ডিকনস্ট্রাকশন’ প্রক্রিয়ারও ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ তত্ত্বের কথা তুললেন। তার কথা হলো, কমনসেন্সের খাতিরে হলেও একজন ‘ডিকনস্ট্রাকশনিস্ট’কে  চিন্তার কোনো একটি গড়পড়তা সেটের প্রতি আস্থাশীল হতেই হয়। তার ভাষায়:

The deconstructor may be aware of the metaphorical resonance of language, but this does not imply that the finite consciousness of the deconstructor operates within the world without a determinate perspective. This perspective constitutes a background theory, as the deconstructionist understands the term, if only in the rudimentary sense of containing basic distinctions and priorities – distinctions and priorities such as that between physical objects and hallucinations, mirages, afterimages, etc. The deconstructor’s consciousness (and everyone’s consciousness) is thus constituted by a theory in fusion with the metaphorical resonance that attends the term of that theory. (Wicks, 2003: 215)

রবার্ট উইকসের প্রস্তাবণাসমূহ বিনা সন্দেহে পর্যালোচনার দাবিদার। এছাড়া, মার্কসবাদীরাও ‘ডিকনস্ট্রাকশন’-এর সমালোচনা করেন। কারণ, এই প্রক্রিয়ায় কোনো পজিশন তৈরি হয় না দাঁড়াবার। এই বৈশিষ্ট্যকে তারা ‘ডিকনস্ট্রাকশন’-এর একরকম অক্ষমতা হিসেবেই দেখিয়ে থাকেন।

উপসংহার

বিনির্মাণতত্ব একটি দর্শন ও বহুরৈখিক মাত্রার ফলাফল। বিনির্মাণবাদ রচনা প্রায়ই ভাষার কোনো না কোনো মৌলিক (‘material’) বিষয়ে কেন্দ্রীভূত থাকে। কোনো লেখকের ব্যবহৃত কোনো একটি উপমা (‘metaphor) বা কোনো একটি শব্দের বুৎপত্তি নিয়ে কাজ করে। শাব্দিক, পুস্তক কেন্দ্রিক এবং ভাষাতাত্ত্বিক বিনির্মাণবাদের মূল উৎস।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

"সোজন বাদিয়ার ঘাট" কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

“সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

ভূমিকা: বাংলা কাব্যের ভুবনে বাংলাদেশের মানসকবি জসীম উদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) আবির্ভাব বিশ শতকের তৃতীয় দশকে। তিনি রবীন্দ্র-নজরুল ও তিরিশের কবিদের বলয় ও প্রভাব মুক্ত থেকে কবিতায় এক নতুন ও ব্যতিক্রম স্বর সৃষ্টি করেছেন। সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগরচেতনা, নাগরিক জীবন ও আচার-আচরণ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তুলে এনেছেন, জসীম উদদীন সেখানে তার কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কবির বিকল্প জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ উপন্যাসধর্মী রচনা। এ কাব্যে প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। নিম্নে … “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস ১. অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যে অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এ আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস, সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। “নমু পাড়ায় পূজা পরব, শঙ্ক কাঁসর বাজে, … মুসলমানের পাড়ায় বসে ঈদের মহোৎসবে,” ২. প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যেপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে মুসলমান চাষীর ছেলে সোজন আর হিন্দু নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠরতার আলেখ্য। গ্রামের হিন্দু বালিকা দুলীর সাথে মুসলমানের ছেলে সোজনের আবল্য বন্ধুত্ব। বন্ধু থেকে আস্তে আস্তে প্রেমে পরিণত হয়। কবিতায়- “নমুদের মেয়ে আর সোজনের ভারি ভাব দুইজনে, লতার সঙ্গে গাছের মিলন, গাছের লতার সনে।“ প্রেমের তুলনায় সমাজ অতিমাত্রায় কাব্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাব্যে সামাজিক অনুষঙ্গের উপস্থাপন করেছেন কবি। কবিতাতে তিনি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষকে আসার আহ্বান করেছেন। সমাজের মানুষের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, খেলাধুলা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায় কাব্যটিতে। দুলির মায়ের কণ্ঠে সমাজের রূঢ় রূপটি প্রকাশ পায়- “পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেত পাড়ায় যে ঠেকা ভার, চূণ নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!” ৩. জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রচনা: কবি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে। শহরজীবনে বসবাস করলেও তিনি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে গ্রামে কাজ করেছেন। ফলে তিনি মানুষের সাথে মিশতে পেরেছেন এবং তাঁর জীবনবোধ ও জীবন অভিজ্ঞতা হয়েছে সমৃদ্ধ। তাঁর জীবনপদ্ধতি ব্যতিক্রমধর্মী এবং বড় কবিতার ধারক হিসেবেই তিনি পরিচিত। ৪. উপন্যাসধর্মী রচনা: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” একটি উপন্যাসধর্মী রচনা। কাব্যের কবিতাগুলো জসীম উদদীন উপন্যাসের ঢংয়ে লিখেছেন। এ যেন লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক। ৫. মৌলিক রচনাধর্মী ও অনন্য: অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় সম্পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন কাহিনী নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রাম-বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। ৬. আধুনিকতা ও উদারনীতির বৈশিষ্ট্য: সময়কে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে স্বীকার করে নিয়ে লেখা আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাণিজগতের কল্যাণকামনা করে মানবিক হওয়াও আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। এসবের সংমিশ্রণে জসীম উদদীন কবিতায় অবয়ব দিয়েছেন। হিন্দু কিশোরী দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সুজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীমউদ্দীন লিখলেন- এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে . . . এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি। ৭. চরিত্র নির্মাণে দক্ষতা: ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে লেখক চরিত্রের আমদানি করেছেন, চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং চরিত্রের পরিণতি দেখিয়েছেন। চরিত্র যেন অনুভূতির মাধ্যমে কথা বলছে। তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভাষার ব্যবহারেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ৮. কাহিনী ও ভাষা বিন্যাসে পাণ্ডিত্য: কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ৯. ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ: আধুনিক কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীমউদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলঙ্কারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলঙ্কারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ।

Read More
কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলা: বাংলা সাহিত্যের একটি চরিত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়েন। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার

Read More

Keto Diet Recipes

Keto for Beginners: A Simple 7-Day Meal Plan The ketogenic (keto) diet has taken the health and wellness world by storm, promising weight loss, increased

Read More
শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক নাটক। এটি রচিত হয় ১৮৫৯ সালে। নাটকটি মহাভারতের কাহিনীকে উপজীব্য করে পাশ্চাত্য রীতিতে রচিত হয়। নাটকটির কাহিনী মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.