বিনির্মাণবাদকে মোটামুটি তিনটি পর্যায়ে চিহ্নিত করা যায় যথা-
ক. শাব্দিক (verbal),
খ. পুস্তক কেন্দ্রিক (textual) এবং
গ. ভাষাতাত্ত্বিক (linguistic)
এই পর্যায় তিনটিকে কবি ডিলন টমাসের ‘A Refusal to Mourn the Death by Fire of a child in London’ কবিতাটিকে বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে।
শাব্দিক (verbal) পর্যায়টি, ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে এস্পসনের ‘Seven Types of Ambiguity’ গ্রন্থে প্রস্তাবিত নিবিড় পাঠের (close reading) সাথে অনেক সাদৃশ্যপূর্ণ। নিবিড় পাঠ প্রস্তাবনা, কোনো রচিত পুস্তকের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও স্ববিরোধগুলোর অনুসন্ধান করে, যাকে প্রকৃষ্টভাবে শাব্দিক অনুসন্ধান বলা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ডিলন টমাসের উল্লিখিত কবিতাটির শেষ লাইন ‘After the first death there is no other ‘ নেয়া যায়। এ লাইনটি স্ববিরোধী বিবরণ দেয় এবং লাইনটি নিজেই নিজের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে: কারণ যদি প্রথম মৃত্যু বলে কিছু থেকে থাকে তাহলে তা ইঙ্গিত করে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ বলেও কিছু আছে। অতএব, ‘the first death’ শব্দ গুচ্ছ সুস্পষ্টতই ইঙ্গিত করে মৃত্যুর অন্য পর্বগুলোও আছে। এরকম অন্তর্বিরোধকেই ‘ভাষার বি-গঠনবাদীরা’ অবিশ্বস্ততা, অনির্ভরযোগ্যতা হিসেবে দেখেন। কবিতাটিতে এরকম অনেক দৃষ্টান্ত আছে। আপনি নিজেই কবিতাটি গভীরভাবে পড়ে দেখুন এরকম আরো কোনো দৃষ্টান্ত খুঁজে বের করতে পারেন কি না। আপনি ‘until’ শব্দটির সঙ্গে ‘never’ শব্দটির ব্যবহার করা দিয়েই আপনার অনুসন্ধান শুরু করতে পারেন।
উত্তর কাঠামোবাদের আরেকটি দিক হচ্ছে, সাধারণভাবে ব্যবহৃত বিপরীত শব্দ যেমন: পুরুষ-নারী, দিন-রাত্রি, আলো-আঁধার ইত্যাদি শব্দ যে দিক নির্দেশ করে তাকে উল্টে দেয়া, যাতে এসব শব্দের প্রচলিত অর্থের চেয়ে কাঠামোবাদীদের নির্ণিত অর্থ ‘বিশেষ সুবিধা’ পায়, বেশি গ্রাহ্য বিবেচিত হয়। তাই ডিলন টমাসের কবিতাটিতে আলোর চেয়ে আঁধারই বেশি জীবনের প্রতীকার্থে ব্যবহৃত, কবি যেমন বলেন, কবিতাটির স্ববিরোধী বর্ণনার প্রতিফলনই কবিতার ভুবনকে উল্টে দেয় একই সাে যে পৃথিবীতে আমরা বাস করি তার রূপকেও উল্টে দেয়। কবিতা ও দৃশ্যমান পৃথিবীর এরকম ব্যাখ্যাকে বি-গঠনবাদীরা লক্ষণ বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেন; ভাষা আমাদের দৃশ্যমান পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি আঁকে না, ভাষা নিজেই নিজের জন্য দৃশ্যমান পৃথিবীর সমান্তরাল একটি পৃথিবী গড়ে। ডিলন টমাসের কবিতায় চিহ্নিত স্ববিরোধী শব্দগুচ্ছের মতো অন্যান্য কবিতায়ও একই রকম শব্দগুচ্ছ আবিষ্কার করার মাধ্যমেই বি-গঠনবাদ তাঁর কবিতার বিরুদ্ধ-পাঠ (‘against itself) শুরু করে এবং সঙ্কেত আাপকের (signifier) বিরুদ্ধে প্রকাশিত সঙ্কেতের (signified) দ্বন্দ্ব উদ্ঘাটন করে। এবং এরা কীভাবে অবদমিত অচেতনকে বিধৃত করে তা বিশ্লেষণ করে দেখায়। বি-গঠনবাদের এই প্রাথমিক পর্যায়টিই পরবর্তী পর্যায়গুলোকে প্রভাবিত করে।
বিনির্মাণবাদের পুস্তক কেন্দ্রিক (textual) পর্যায়টি প্রত্যেক শব্দগুচ্ছকে আলাদাভাবে বিশ্লেষণ না করে সমগ্র পুস্তকটি বা কবিতাটিই বিশ্লেষণ করে। বিনির্মাণবাদের দ্বিতীয় পর্যায়ে, সমালোচক পুস্তকটি বা কবিতাটির ধারাবাহিকতায় কোনো বিচ্যুতি বা অসংলগ্নতা আছে কিনা, তা বিচার করে দেখে: কারণ এসব বিচ্যুতি, অসংলগ্নতাই রচয়িতার এককেন্দ্রিক চিন্তাহীনতার পরিচয় বহন করে। বিচ্যুতি ও অসংলগ্নতাগুলো অনেক রকমের হতে পারে (পূর্বে বর্ণিত ছকটি দ্রষ্টব্য); সেগুলো, প্রধান আলোচ্য বিষয়, সময়, বক্তব্যের ধরন, দৃষ্টিভঙ্গি, গতি ও শব্দ ব্যবহারজনিত হতে পারে। ব্যাকরণ ব্যবহারেও সে সব বিচ্যুতি, অসংলগ্নতা থাকতে পারে: প্রথম পুরুষ থেকে তৃতীয় পুরুষ ব্যবহার, বা অতীতকাল থেকে বর্তমানকালে আসা। এভাবে বি গঠনবাদীরা সমগ্র রচনাটির বিশ্লেষণ করে। উদাহরণস্বরূপ-
ডিলন টমাসের কবিতাটিতে প্রচুর সময়-বিচ্যুতি, দৃষ্টিকোণের বিচ্যুতি আছে ফলে কবিতাটির মসৃণ অগ্রগমন বিঘ্নিত হয়। তাই কবিতাটির প্রথম দুই স্তবকে মহাকালের যাত্রাপথকে কল্পনা করা হয় এবং পৃথিবীর আসন্ন বিলোপকে (‘end of the world’) কল্পনা করা হয়…. শেষ আলো ফুটে ওঠে, সমগ্র স্থির হয়ে যায়, যে বৃত্তে পশু, পাখি, ফুল, (‘Bird, beast and flower’) জন্ম নেয়, তা স্থির হয়ে আসে এবং সব শেষে সর্বগ্রাসী আঁধার (‘all humbling darkness’) নেমে আসে। কিন্তু তৃতীয় স্তবকে আবার বর্তমানকালের কথা বলা হয়েছে—শিশুটির মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে, ‘The majesty and burning of the child’s death’ – শেষ স্তবকটি একটা বৃহৎ দৃষ্টিতে লন্ডন শহরকে দেখবার চেষ্টা করে কিন্তু তা কেবল লন্ডন শহরের ইতিহাসেই সীমাবদ্ধ থাকে; *the unmourning water of the riding Thames’। এ ছাড়া শিশুটির মৃত্যুকে আর কোনো বৃহত্তর তাৎপর্যে চিহ্নিত করা হয় না, তাই টমাসের কবিতার ভাব পরিবর্তনগুলোর অর্থোদ্ধার কঠিন হয়ে পড়ে।
আপনি কবিতাটি আরেকবার পড়ে দেখুন, এরকম কোনো বিচ্যুতি বা বিঘ্নিত ধারাবাহিকতা কবিতাটিতে খুঁজে পান কিনা। কোনো কিছু কবি বাদ দিয়ে গেলেন কিনা (Omission) তাও আপনি খুঁটিয়ে দেখবেন অর্থাৎ রচনাটিতে রচয়িতা কোনো কিছু বলা বাদ রাখলেন কি না যা তার বলা উচিত ছিল। আপনি হয়তো প্রথমেই প্রশ্ন করতে পারেন, শিশুটির মৃত্যুতে কেন কবি শোক প্রকাশে অনাগ্রহী, সে কথা কবি স্পষ্ট করে বলেননি কেন ।
সবশেষে ‘ভাষাতাত্ত্বিক’ পর্যায়টি আসে, যার লক্ষ্য হচ্ছে ভাষার পর্যাপ্ত ব্যবহারকে প্রশ্ন করা। এরকম অবস্থা তখনি আসে যখন ব্যবহৃত ভাষার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়: যা বলার মতো নয় কবি যখন তা বলেন বা কবি যদি বলেন ভাষা ভাবকে অতিরঞ্জিত করে বা কম রঞ্জিত করে অথচ কবি নিজেই সে রকম ভাষা ব্যবহার করেন। উদাহরণস্বরূপ-
ডিলন টমাসের কবিতা ‘ A Refusal to Mourn’ কবিতাটিতে কবি কোনো শোক প্রকাশ করবেন না বলেও সমগ্র কবিতাটি জুড়ে শোকই প্রকাশ করেন। কবিতাটির তৃতীয় স্তবকে কবি বলেন তিনি মানবতাকে হত্যা করবেন না (‘murder / The mankind of her going with a grave truth’)। এরকম বলে শোক প্রকাশের প্রচলিত সব ভাষাকে বর্জন করে কবি একটা নতুন চমক দিতে চান। তবুও কবির সে চমক নীরবতায় প্রকাশিত হয় না বরং সমবেত প্রার্থনা সঙ্গীতের গুরু গাম্ভীর্যে কবিতাটির তৃতীয় স্তবকে ঘোষিত হয়: ‘Deep with the first dead lies London’s daughter’। এই লাইনটি প্রচলিত স্তুতির সুরে মৃত শিশুটিকে জীবন জয়ী ‘London s daughter’ (অসম্ভব কল্পনা) বলে। সব যুগের শব-যাত্রায় শিশুটির শব-যাত্রাকে একীভূত করে মৃত্তিকা মাতার কোলে (London clay) শিশুটিকে সমাধিস্থ করে ।
আমরা বলতেও পারি, কবিতাটিতে ডিলন টমাস প্রথমে ভাষার চক্র চিহ্নিত করেন, পরে কবি নিজেই ভাষার চক্রে পড়ে যান। ‘textual’ দৃষ্টিকোণ থেকে পুনরায় কবিতাটিকে দেখুন। উপরে উল্লিখিত উদাহরণটির মতো আর কোনো উদাহরণ খুঁজে পান কি না দেখুন। ‘mother’ ‘daughter’ শব্দ দুটির ব্যবহারের মাধ্যমে যে পরিবারের কল্পনা করা হয়েছে তা নিয়ে ভাবুন এবং ‘murder’ এবং ‘unmourning’ Thames ধারণাটি কোনো ইঙ্গিতবহ কিনা ভেবে দেখুন ।
একবার যদি কবিতাটির ব্যবচ্ছেদ করা যায়, তখন তা সহজেই বিনির্মাণবাদের আওতায় এসে পড়ে এবং একটা খণ্ডিত, স্ববিরোধী, সাংস্কৃতিক ও ভাষাভিত্তিক লক্ষণ নিজের মধ্যে স্পষ্ট করে তোলে। বিনির্মাণবাদকে আমরা যে স্তরে ভাগ করে দেখিয়েছি তা কবিতা ছাড়া অন্যান্য রচনার বেলায়ও একইভাবে প্রযোজ্য। এই তিনটি স্তর বিনির্মাণবাদকে একটা সমালোচনা তত্ত্ব হিসেবে সুপরিচিত করে।
সবশেষে, বিনির্মাণবাদ সমালোচনা তত্ত্বে ‘aporia’ পরিভাষাটি বহুল প্রচলিত। ভাবার্থে শব্দটির অর্থ অচলাবস্থা (impasse’) এবং এ দিয়ে এমন স্ববিরোধকে বুঝায়, যার জটিলতার জট সহজে ছাড়ানো যায় না। সম্ভবত শব্দটির অর্থ ব্রিটিশ সমালোচক উইলিয়াম এম্পসনের ‘Seven Types of Ambiguity’ (১৯১০) গ্রন্থটির মূল বক্তব্যে যে সাতটি দ্ব্যর্থকতার উল্লেখ করা হয়েছে তার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। যেমন, কুপারের কবিতাটির তৃতীয় স্তবকের শুরুতে বলা হয়েছে ‘No poet wept him’ কিন্তু কবিতাটির মূল ভাবের সঙ্গে এই লাইনটি সাংঘর্ষিক। এই ‘সাংঘর্ষিকতা’ থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ নেই। ১৯৬৮ সালে রচিত, রোনাল্ড বার্থেসের ‘The Death of the Author’ প্রবন্ধটিকে কাঠামোবাদ থেকে উত্তর কাঠামোবাদের সূচক বলা হয়ে থাকে। প্রবন্ধটিকে বার্গেস মত দেন, ‘সব জটিলতার জট ছাড়াতে হবে’ কোনো কিছুকে বাদ দেয়া যাবে না (‘everything must be disentangled nothing deciphered’)। ‘aporia’ পরিভাষাটি শুধু মাত্র পুস্তক কেন্দ্রিক সমালোচনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও, ‘aporia’ শিরোনামে অনেক জটিল বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বিনির্মাণবাদ কবিতার ‘ক্ষুদ্রতম’ অংশকেও বিশ্লেষণ করে দেখে একথা সহজে বুঝা যায়, কিন্তু কবিতাটিতে একটি স্বচ্ছ বোধের ‘ক্ষুদ্রতম’ (grain) অংশ আছে, যা অনুসারে সমালোচক তাঁর বিশ্লেষণে এগিয়ে যাবেন এমন ধরে নেয়া বিভ্রান্তিকর হবে। কুপারের কবিতাটির বিশ্লেষণ এ কথাটাই প্রমাণ করে থাকবে।