বিশ শতককে বলা যেতে পারে তত্ত্বচিন্তার শতক। উনিশ শতকে বা তারও আগে মানুষের চিন্তাচেতনায় বিভিন্ন প্রবণতার সূচনা হয়েছিল। তবে দুটি বিশ্বযুদ্ধ ও স্নায়ুযুদ্ধের অভিঘাত শুষে নিতে-নিতে ভাবনা-প্রস্থানগুলি প্রসারিত হলো বিচিত্র শাখা-প্রশাখায়। একুশ শতকের শূন্যদশক পেরিয়েও অব্যাহত রয়েছে জিজ্ঞাসার পালাবদল। তবু বিশ শতকই তত্ত্ববিশ্বের প্রকৃত চারণভূমি। অখণ্ড অবিভাজ্য মানববিশ্বের অধিবাসী হিসেবে যত চিনতে পারছি নিজেদের, আমাদের কৌতূহল মহাদেশের গণ্ডি অতিক্রম করে যাচ্ছে দ্রুত। নতুন নতুন তত্ত্বের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে তৃতীয় বিশ্বের অধিবাসীদের চিন্তা-চেতনার সীমান্তরেখাও মুছে গেছে কবেই। সাহিত্য ও সংস্কৃতিতত্ত্বের মাটি ও আকাশ আমূল পালটে গেছে। তারই ফসল বিনির্মাণবাদ।
জে,এ কুডন তাঁর ‘Dictionary of Literary Terms’ গ্রন্থে বিনির্মাণবাদ সম্পর্কে বলেন, “একটা বই যা বলতে চায় ঠিক সেভাবে না পড়ে তাকে অন্যভাবেও পড়া যায়… বইটিতে বহু ইঙ্গিত পূর্ণ বহু কথার সমাহার থাকতে পারে, মৌলিক বিরোধ পূর্ণ কিছু কথা থাকতে পারে, কোনো ‘প্রতিষ্ঠিত’ সত্য বিরোধী মন্তব্য থাকতে পারে। এভাবে বইটি নিজেই নিজেকে ‘প্রবঞ্চিত’ করতে পারে।”
অতএব, দেখা যায় বিনির্মাণবাদ এমন বিষয়ই চর্চা করে, যাতে মূল পুস্তকের অবমাননা করা বা পুস্তকটির বিরুদ্ধ পাঠ হয়। পুস্তকটিকে এমনভাবে পাঠ করা হয় যেন পুস্তকটি অভ্যন্তরস্থ বিরোধ ও অপ্রাসঙ্গিকতাগুলো তুলে ধরে পুস্তকটির আপাত ঐক্যের মধ্যে অনৈক্য খুঁজে বার করাই পুস্তকটি পাঠের প্রধান উদ্দেশ্য। এর আগের প্রজন্মের ‘নব্য-সমালোচনাবাদের’ (New criticism) উদ্দেশ্য ছিল এর বিপরীত, তাদের উদ্দেশ্য ছিল: পুস্তকটি আপাত অনৈক্যের মধ্যে ঐক্য সূত্র আবিষ্কার করা। বি-গঠনবাদের উদ্দেশ্য অনুসারে; বিনির্মাণবাদে পুস্তকটির কোনো একটি বিশেষ বিষয় – কোনো একটা নির্দিষ্ট উপমাকে নেয়া হয় এবং সেটিকেই সম্পূর্ণ পুস্তকটি মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে নেয়া হয়, এবং সে আলোকেই পুস্তকটি পাঠ করা হয়।
প্রধানত ভাষাতত্ত্ব থেকেই কাঠামোবাদের উদ্ভব। ভাষাতত্ত্ব জ্ঞানের এমন একটি শাখা যা ঐতিহ্যগতভাবেই নৈর্ব্যক্তিক জ্ঞান প্রতিষ্ঠায় প্রত্যয়ী। ভাষাতত্ত্ব বিশ্বাস করে, যদি সঠিক পর্যবেক্ষণ করা যায়, সঠিকভাবে তথ্য সংগ্রহ করা যায় এবং যৌক্তিকভাবে অগ্রসর হওয়া যায় তাহলে ভাষা ও বিশ্ব সম্পর্কে একটা নির্ভরযোগ্য উপসংহারে আমরা পৌঁছতে পারি। কাঠামোবাদ ভাষাতত্ত্বের দৃঢ় বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিটি ধারণ করে: নির্ভরযোগ্য সত্য বিনির্মাণে কাঠামোবাদ যুক্তি, নিরীক্ষণ প্রক্রিয়ায় তথ্য নির্ভরতায় বিশ্বাস করে।
তুলনায় বিনির্মাণবাদ দর্শন-ভিত্তিক। দর্শন জ্ঞানের এমন একটি শাখা, যা থেকে কোনো বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ধারণা পাওয়া বেশ কঠিন। দার্শনিক নীৎসের বিখ্যাত উক্তি এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য। নীৎসে বলেন, ‘There are no facts, only interpretations’ বলা যায় জ্ঞানের বিশেষ শাখা হিসেবে দর্শন নিজেই সংশয়বাদী’ তাই সাধারণ জ্ঞানভিত্তিক ধারণা ও প্রত্যয়কে দর্শন গ্রহণ করে না। যাকে স্বতঃসিদ্ধ ধরে নেয়া হয় তাকে প্রশ্নাক্রান্ত করাই দর্শনের প্রাগ্রসরমানতার ধারা। বিনির্মাণবাদ দর্শনের এই সংশয়বাদিতার ধারক এবং এই ধারাকেই তীব্রতর করে। বৈজ্ঞানিক কোনো তথ্য-উপাত্তে নির্ভর করাকে বিনির্মাণবাদ অতি সারল্য মনে করে এবং এমন একটা মর্ষকামী বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় নিয়োজিত হয় যে, কোনো কিছুই চূড়ান্তভাবে জানা সম্ভব নয়।
বিনির্মাণবাদে রচনার প্রবণতা থাকে আবেগ উদ্দীপনার দিকে, প্রায়ই উচ্ছ্বসিত। আর তাদের রচনাশৈলি হয় সচেতনভাবেই জমকালো, অতি আলংকারিক। তাদের রচনাগুলোর শিরোনামও থাকে শব্দ চাতুর্য এবং কোনো সূত্র উল্লেখে পূর্ণ। রচনার মূল বিষয়ও থাকে শব্দ চাতুর্যপূর্ণ।
বিনির্মাণবাদ রচনা প্রায়ই ভাষার কোনো না কোনো মৌলিক (‘material’) বিষয়ে কেন্দ্রীভূত থাকে, কোনো লেখকের ব্যবহৃত কোনো একটি উপমা (‘metaphor) বা কোনো একটি শব্দের বুৎপত্তি। সর্বোপরি বিনির্মাণবাদে নিস্পৃহতার পরিবর্তে এক ধরনের উষ্ণতা থাকে বলে মনে হয়।
কাঠামোবাদীরা মনে করে ভাষাই দৃশ্যমান জগৎ সৃষ্টি করে; এই অর্থে যে, আমরা ভাষা ছাড়া বাস্তব জগতে প্রবেশ করতে পারি না। কাঠামোবাদীরা ভাষাকেই তাদের চিন্তা চেতনার কেন্দ্রে স্থান দেন। আর ভাষা হচ্ছে একটা সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা, এর উপর আমাদের নির্ভরতার গুরুত্ব সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারলে তা কোনোভাবেই কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক হতাশায় পতিত হবার কোনো অবকাশ রাখে না।
বিনির্মাণবাদে অনেক বেশি মৌলবাদী কারণ তারা মনে করে, বাস্তব নিজেই পুস্তক কেন্দ্রিক। শুধু ভাষা থেকে কোনো জ্ঞান সম্ভব নয় বলে বিনির্মাণবাদীরা মনে করে। তাদের মতে, শব্দ যে সব ঈঙ্গিতকে ধারণ করে রাখার সম্ভাবনা আছে সেগুলো সব ভাসমান, অস্থির। ভাষা সম্বন্ধে বিনির্মাণবাদীদের বদ্ধমূল ধারণা হলো: ভাষা অনেকটাই তরল পদার্থের মতো, শব্দ যে সঙ্কেতগুলোকে বহন করে, সেগুলো সদা ভাসমান এবং যে-কোনো সময়ে তাদের অর্থ পিছলে যেতে পারে (slippage) বা ছলকে পড়তে পারে (‘spillage’) ভাষার এই পিচ্ছিল বিশৃঙ্খলা অননুমেয়ভাবে ভাষার সঙ্কেতকে ‘দাতার’ (giver) কাছ থেকে গ্রহীতার (receiver) কাছে সঠিকভাবে শব্দের (container) মাধ্যমে পৌঁছার প্রচেষ্টাকে অস্বীকার করে। ভাষা সম্পূর্ণভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণে নয়, তাই শব্দের অর্থকে সঠিক জায়গায় সঠিকভাবে স্থাপন করা যায় না। শব্দগুলোর যে প্রচলিত অর্থ বিদ্যমান, তা যে শতভাগ বিশুদ্ধ এমন নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। শব্দগুলো প্রায়শ তাদের বিপরীত শব্দ দিয়ে প্রভাবিত (‘contaminated’) হয় – আমরা দিনের উল্লেখ না করে রাতকে বুঝাতে পারি না, মন্দের উল্লেখ না করে ভালোকে বুঝাতে পারি না। অনেক সময় শব্দটির নিজস্ব ইতিহাস ও তার অর্থ উদ্ঘাটনে বাধার সৃষ্টি করে। শব্দটির পুরানো অর্থ, নতুন অর্থ প্রকাশের উপর প্রভাব ফেলে। আর এসব অস্বচ্ছতা দূর না হলে আমরা শব্দটি ব্যবহার করি না। যেমন, অতি সাধারণ একটি শব্দ ‘guest’ ব্যুৎপত্তিগতভাবে ‘hostis’ শব্দটির সঙ্গে জড়িত যার অর্থ ‘শত্রু বা আগন্তুক’। ফলে, ‘guest’ বলতে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকেই বুঝায়। এরকমভাবে অনেক শব্দকে তাদের রূপকের ভিত্তিতে দৰ্শনে বা সাহিত্যে ব্যবহার করলে, তাদের অর্থ প্রকাশে অস্বচ্ছতা দেখা দেয় এবং কোনো একক অর্থ প্রকাশে তাদের ব্যবহার করা যায় না। উত্তর কাঠামোবাদ, এই ভাষাতাত্ত্বিক জটিলতার দিকেই আলোকপাত করে।
কাঠামোবাদে আমরা বাস্তবকে যেভাবে গঠন ও বিন্যস্ত করি তাকেই প্রশ্ন করে, আমাদের ধারণাগুলোকে নাড়া দিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখায় । প্রচলিত ধারণাকে পুনর্গঠিত, পুনর্বিন্যস্ত করে আমরা আরো নির্ভরযোগ্য তথ্য পেতে পারি, কাঠামোবাদ এমনি বিশ্বাস করে। বিনির্মাণবাদে তুলনায় আরো বেশি রক্ষণশীল; কারণ যুক্তি (‘reason’ ) বুদ্ধিকেই তারা অস্বীকার করে, মানুষের স্বাধীন সত্তাকে অস্বীকার করে।
১৯৬০-এর দশকের শেষাংশে, উত্তর কাঠামোবাদের আরেক প্রবক্তা হলেন, জ্যাক দেরিদা। বস্তুত, ১৯৬৬ সালে দেরিদার (‘Structure’ sign and Play in the Discourse of Human Sciences’ শীর্ষক বক্তব্যই উত্তর কাঠামোবাদের সূচনা করে। দেরিদা তাঁর এই বক্তব্যে আধুনিক বুদ্ধিবৃত্তির জগতে একটা নতুন সূচকের (“event”) উল্লেখ করেন। এই নতুন সূচকে তিনি নীৎসে, হেইডেগার এর দর্শনের সারাৎসারকে ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষণের সঙ্গে সংযুক্ত করেন। আর এই সূচকের লক্ষ্য ছিল বুদ্ধিবৃত্তির জগৎকে বিকেন্দ্রিত’ (‘decentred”) করা।
এর পূর্ব পর্যন্ত মূল্যবোধের আদর্শের একটা কেন্দ্রকে নিশ্চিত ধরে নেয়া হতো: যেমন, রেনেসাঁ যুগে মানুষই সব পার্থিব কর্মের মূলে এমন ধারণা পোষণ করা হতো এবং সেই আলোকেই বিশ্বের যাবতীয় বিষয়ের পরিমাপ করা হতো। পাশ্চাত্যের শ্বেতাঙ্গ মানুষের পোশাক, আচরণ, বুদ্ধিবৃত্তিক মান, স্থাপত্যকলা এসব কিছুকেই এক সময় প্রমিত মানের ধরে নেয়া হতো আর এর ব্যতিক্রমকে ‘ভিন্ন’ এবং প্রান্তিক ভাবা হতো। বিংশ শতকে এসে এরকম প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রগুলো সব ক্ষয়ে যেতে লাগল। কখনো কখনো কোনো ঐতিহাসিক কারণে—যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সভ্যতার ক্রমিক প্রাগসরতার ধারণায় প্রলয় আনে, ইউরোপ মানব সভ্যতার কেন্দ্র বিন্দু এই ধারণাকে ধ্বংস করে দেয়। কখনো কখনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার চিন্তার জগতে আমূল পরিবর্তন আনে—যেমন, আপেক্ষিকতা, (relalivity) সময় ও মহাশূন্য স্থির এই ধারণাকে বদলে দেয়। আবার কখনো কখনো বুদ্ধিবৃত্তি এবং শিল্প সাহিত্য জগতের বৈপ্লবিক ধারণা ও পূর্বতন ধারণাকে বদলে দেয়, যেমন—বিংশ শতকের প্রথম ত্রিশ বছর শিল্প সাহিত্যে আধুনিকতাবাদ: সঙ্গীতে ঐকতান, সুরকে, উপন্যাসে ধারাবাহিক বর্ণনাকে এবং চিত্রশিল্পে দৃশ্যমান জগতের রূপায়নকে বাতিল করা হয।
দেরিদা তাঁর প্রকাশিত ‘Speech and Phenomena’ of Grammatology’ এবং ‘Writing and Difference’ এই তিনটি গ্রন্থে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করেন। পর পর প্রকাশিত এই তিনটি গ্রন্থই সাহিত্য তত্ত্বের উপর রচিত নয় বরং দর্শনের উপর রচিত। কিন্তু দেরিদা তাঁর আলোচনায় এমনভাবে অগ্রসর হন, সেখানে অন্যান্য দার্শনিকদের ‘বি-গঠনবাদী’ তত্ত্বগুলোর নির্বাচিত দিক নিয়ে গভীর এবং বিস্তারিত আলোচনা করে। সাহিত্যতাত্ত্বিকরা সেগুলো উদ্ধৃত করেই সাহিত্য রচনা বিশ্লেষণে প্রয়োগ করে। সাহিত্যতাত্ত্বিকরা দেরিদা উল্লিখিত ‘বিকেন্দ্রীত বিশ্বের’ মূল তত্ত্বকেই প্রতীক ধরে সাহিত্যে ‘বি-গঠনবাদী’ আলোচনায় ব্রতী হন। ফলে যে সব সাহিত্য রচনাকে এতদিন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ শিল্প কর্ম বিবেচনা করা হতো, সেগুলোকে সাহিত্যতাত্ত্বিকরা খণ্ডিত, বিভাজিত ও কোনো কেন্দ্রবিহীন বলে সনাক্ত করেন।