বিনির্মাণবাদের সংজ্ঞার্থ: J.W. Bertens তাঁর ”Literary Theory: Basics” গ্রন্থে দারিদার বিনির্মাণতত্বের একটা সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলছেন, দারিদা তাঁর বিনির্মাণতত্বে বলছেন, ভাষা প্রকৃতিগতভাবে অনির্ভরযোগ্য ব্যাপার। একটা শব্দ প্রকৃতপক্ষে যাকে রেফার করে সেটা কিন্তু ফলত শব্দের সাথে শব্দের পার্থক্য, সরাসরি কোন নির্দেশক নয়। কাজেই এই শব্দগুলো একটা ভাষিক পদ্ধতির মধ্যে কাজ করে, যা কখনই বাস্তব জগতকে স্পর্শ করে না। বাস্তবতা ভাষিক প্রকৃতি নির্ধারণ করে। একটা শব্দের থেকে আরেকটা শব্দের যে পার্থক্য যার প্রেক্ষিতে ঐ শব্দটা স্বতন্ত্র হয় তাকে নিয়ে আমাদের ভাবতে হয়। তবে বিনির্মাণ তত্বের একটা বড় ফলাফল হলো, এই তত্ব মনে করে কোন শব্দের অর্থ কোন সময়ই একটা সময়ের ফ্রেমে আবদ্ধ নয়, যার প্রেক্ষিতে এটা চলমান ও পরিবর্তনশীল। দারিদা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাচন প্রক্রিয়ায় কোন পারমাণবিক বিভাজন নেই (There is no atom: Dialanguages: in Points … Interviews, 1974-94)। এর অর্থ আমরা ভাষা দিয়ে যা প্রকাশ করি তার সবটুকু বিভাজন করা সম্ভব। জীবন কী? জীবন অনেক কিছুর সমন্বয়, সম্ভবত বহু মাত্রার এক সমন্বিত দ্যোতনা।
কবি রণজিৎ দাসের এক কবিতা দিয়ে দারিদার বিনির্মাণতত্বকে বোঝাতে চেয়েছেন দারিদা বিশেষজ্ঞ তপোধির ভট্টাচার্য তার “জাক দেরিদা তাঁর বিনির্মাণ” গ্রন্থে। “যা কিছু বিষণ্ণ করে, যেমন সূর্যাস্ত, নারী, গির্জা ও গোলাপ যা কিছু বিষণ্ণ করে, যেমন উৎসব, চাঁদ, নৌকো ও সমুদ্র যা কিছু বিষণ্ণ করে, যেমন বিগ্রহ, ধুপ, মুদ্রা, পূজারিণী যা কিছু বিষণ্ণ করে, যেমন পাহাড়, মেঘ, শালবন, চিঠি ও চুম্বন যা কিছু বিষণ্ণ করে, গরম ভাত, হাতপাখা, গন্ধলেবু, আদিবাসী গ্রাম যা কিছু বিষণ্ণ করে, যেমন সার্কাস, তাঁবু, ফেরিঘাট, পাগলের হাসি যা কিছু বিষণ্ণ করে, যেমন মায়ের ছবি, ডাকঘর, শিলাবৃষ্টি, মাঝিদের গান যা কিছু বিষণ্ণ করে, যেমন সমস্তই, হে জীবন, তোমার আনন্দ-অভিধান”। [‘যা কিছু বিষণ্ণ করে’, সন্ধ্যার পাগল, রণজিৎ দাস]
কবির এই বিচিত্র ও ভিন্ন ভিন্ন অনুভবের ভেতর দিয়ে জীবনের নানা প্রকরণের উন্মেষগুলো প্রকাশিত হয়েছে নানা রঙ্গে, নানা ঢঙে। আসলেই তো জীবনের বিচিত্র রাগ, দুঃখ, মৃত্যু, বিরহ, শান্তি, আনন্দ –এসবই তো জীবনের অংশ। কবিগুরু তো বললেন,
“তবু প্রাণ নিত্যধারা,
হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে”॥
জীবনের এই বহুমাত্রিকতা, বহুঅনুভবতা আর নিত্য পরিবর্তনশীলতাই তো বিনির্মাণতত্বের সারৎসার। অধ্যাপক তপোধির ঠিকই বলেছেন, “সমস্ত অনুষঙ্গ মনে রেখে লেখা যায়, দেরিদার বিনির্মাণপন্থা আসলে সমস্ত বাচনিক, প্রতীতিগত (ধারণা সম্বন্ধীয়), মনস্ত্বাতিক, নান্দনিক, ঐতিহাসিক, নৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও পাঠকৃতি বিষয়ক দৃশ্য–প্রপঞ্চ- পরিস্থিতিকে আমুল আলোড়িত –রূপান্তরিত- পুনঃস্থাপিত করার কৃতকৌশল”(পৃ. ১২৬)।
দেরিদার বি-গঠনবাদী পাঠ-প্রস্তাবনার উদ্দেশ্যও প্রায় একই রকম। দেরিদা বলেন, বি-গঠনবাদী পাঠ অবশ্যই কতগুলো সম্পর্কের দিকে লক্ষ্য রাখবে, যেগুলোর দিকে লেখক নিজে লক্ষ্য করেননি, তার ভাষা ব্যবহারের ধরন দিয়ে কী তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, আর কী চাননি… ‘বি-গঠন অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করার চেষ্টা করে। (‘Of Grammatology’ পৃ:-১৫৮, ১৬৩)
বিনির্মাণবাদের বৈশিষ্ট্য
১. বিনির্মাণবাদ একটি পূর্ণাঙ্গ সমালোচনা তত্ত্ব;
২. অবদমিত সত্যগুলো তাদের কণ্ঠে ভাষা ফিরে পায়;
৩. বিনির্মাণবাদ নির্দেশ করে অর্থের লীলাময় চরিত্র, তার পরিবর্তনশীলতা, তার ক্ষণস্থায়ীত্ব;
৪. বিনির্মাণবাদে যাবতীয় আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার সামাজিক শর্ত গড়ে ওঠে;
৫. বিনির্মাণবাদে রচনাশৈলি হয় সচেতনভাবেই জমকালো, অতি আলংকারিক;
৬. রচনাগুলোর শিরোনামও থাকে শব্দ চাতুর্য এবং কোনো সূত্র উল্লেখে পূর্ণ;
৭. রচনার মূল বিষয়ও থাকে শব্দ চাতুর্যপূর্ণ;
৮. বিনির্মাণবাদ রচনা প্রায়ই ভাষার কোনো না কোনো মৌলিক (‘material’) বিষয়ে কেন্দ্রীভূত থাকে;
৯. কোনো লেখকের ব্যবহৃত কোনো একটি উপমা (‘metaphor) বা কোনো একটি শব্দের বুৎপত্তি নিয়ে কাজ করে;
১০. বিনির্মাণবাদে নিস্পৃহতার পরিবর্তে এক ধরনের উষ্ণতা থাকে বলে মনে হয়।
১১. বিনির্মাণবাদে সৃষ্টি হয় প্রান্তিক গোষ্ঠীসমূহের সঙ্গে কাতারে কাতার মেলানোর যৌক্তিক পটভূমি;
১২. সামাজিক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বহুদলীয় সংলাপের পরিসর প্রস্তুত হয়;
১৩. ‘ডিকনস্ট্রাকশন’-এর মাধ্যমে গড়ে ওঠে একধরনের সমতলীয় ক্ষেত্র, যেখানে খেলা করে অর্থের বহুমাত্রিকতা।
১৪. ‘ডিকনস্ট্রাকশন’ প্রক্রিয়ায় একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক উন্মোচিত হয়;
১৫. বিনির্মাণবাদে রচনার প্রবণতা থাকে আবেগ উদ্দীপনার দিকে, প্রায়ই উচ্ছ্বসিত।