রসের জন্ম হৃদয়ে, সমালোচনার জন্ম মস্তিষ্কে। কিন্তু সমালোচকও কিঞ্চিৎ পরিমাণে রসস্রষ্টা সাহিত্যে উৎকর্ষ বা অপকর্ষ বিচারমূলক আলোচনাকে সাধারণভাবে সমালোচনা নামে অভিহিত করা হয়। সাহিত্য স্রষ্টার মানস দৃষ্টি, সাহিত্যের ভাব, বস্তু, অলংকার প্রভৃতির সম্যক আলোচনা করে সমালোচনা সাহিত্য। সমালোচনা কর্মে সহৃদয়তার বড়ো বেশী প্রয়োজন, নিন্দা করার দৃষ্টি নিয়ে বা অকারণ স্তাবকাতয় গা ভাসিয়ে সমালোচনা করা চলে না। সহৃদয়তার সঙ্গে রসবোধের মেলবন্ধন ঘটা চাই, নইলে সমালোচকের বক্তব্য পাঠকের মনে আনন্দ ও সৌন্দর্যের খোরাক জোগাতে পারবে না। সমালোচনার প্রধান দায়িত্ব হলো লেখকের মনকে পাঠকের কাছে তুলে ধরা, লেখকের মানসকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে পাঠকের কাছে পরিচিত করিয়ে দেওয়া। যুগেযুগে নানা মুণি, সাহিত্য সমালোচনার নানা রীতি বা পদ্ধতির প্রবর্তন করেছেন। এর মধ্যে উদারনৈতিক মানবতাবাদী, গঠনবাদী, উত্তরগঠনবাদী, মার্কসবাদী, উত্তর-উপনিবেশবাদী, ইতিহাসমূলক, তুলনামূলক, বিশ্লেষণমূলক, মূল্যবিচারমূলক, নব্য-সমালোচনা, পাঠভিত্তিক, ব্যক্তিপন্থী ও যুক্তিপন্থী সমালোচনার পদ্ধতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নিম্নে সাহিত্য সমালোচনার নানা রীতি বা পদ্ধতি আলোচনা করা হলো:
সাহিত্য সমালোচনা তত্ত্ব কী?
সাহিত্য সমালোচনা তত্ত্ব হচ্ছে সাহিত্যের গবেষণা, আলোচনা, মূল্যায়ন এবং ব্যাখ্যা এই সবকিছুর সম্মিলন। আধুনিক কালে সাহিত্য সমালোচনায় সাহিত্য তত্ত্ব প্রয়োগ করা হয়। সাহিত্য তত্ত্বতে সাহিত্য সমালোচনার পদ্ধতি ও লক্ষ্যের দর্শন আলোচিত হয়।
সাহিত্য সমালোচনার আদিগুরু এরিস্টটল অনেক আগে তাঁর Poetics-এর সূচনায়ই উল্লেখ করেছেন, “কাব্যের নানা প্রকারভেদ এবং তাদের বৈশিষ্ট্য, সার্থক কাব্যের কাহিনী গঠনের শ্রেণী বিভাগ এর বিভিন্ন অংশের সংখ্যা ও ধরন এবং সেই সাথে কাব্য পাঠের সম্পৃক্ত প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই” (মৎকৃত এরিস্টটলের পোয়েটিকস্ পৃ: ৫৯)।
সাহিত্য সমালোচনার নানা রীতি বা পদ্ধতি
১. উদারনৈতিক মানবতাবাদী রীতি: ম্যাথিউ আরনল্ড এর মতে, “সমালোচনার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে মূল রচনায় বিষয়টি যেমন আছে ঠিক তেমন করেই দেখা।” প্রচলিত Liberal Humanism থেকেই নতুন নতুন সব তত্ত্বের উদ্ভব হয়েছে। Liberal Humanist রা মনে করে “সাহিত্য জীবনের প্রতি ইতিবাচক।” সাহিত্যে শুভ-অশুভ বিচার করে ইতিবাচক দিক তুলে ধরাই উদারনৈতিক মানবতাবাদী রীতির মূল উদ্দেশ্য।
২. মার্কসবাদী রীতি: সাহিত্যকে যখন ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এর ভিত্তিতে বিচার করা হয় তখন তা হয়ে ওঠে মার্কসীয় সমালোচনা রীতি। এখানে বস্তুবাদ বিশেষভাবে প্রাধান্য পায়, এটি বেশ উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সমালোচনা পদ্ধতি।
৩. উত্তর-উপনিবেশবাদী রীতি: সাহিত্যে মানুষের উপনিবেশিক মনস্কতার দর্শন ও মনস্তত্ত্বকে চিনিয়ে দেওয়া ও তা থেকে মুক্ত করাই ছিল উত্তর-গঠনবাদী রীতির মূল উদ্দেশ্য।
৪. ঐতিহাসিক সমালোচনা পদ্ধতি: যে সমালোচনা যুগচিত্ত, পরিবেশ-পরিপার্শ্ব ইত্যাদির নিরিখে সাহিত্যের বিচার করে থাকে তাকে চিহ্নিত করা হয় ঐতিহাসিক সমালোচনা পদ্ধতি বলে। পাশ্চাত্যের সাহিত্যিক টেইন এর হাত ধরে এই ধারার সূত্রপাত। বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিনয় ঘোষ এই ধারার বেশ সমৃদ্ধ ঘটিয়েছেন।
৫. তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতি: যে পদ্ধতি রয়েছে সেখানে ভাব, বিষয়, শব্দ সম্পদের তুলনামূলক বিচারের দ্বারা পারস্পরিক উৎকর্ষ ও অপকর্ষ নিরূপিত হয় তাকে তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতি বলে। যেমন: মধুসূদনের ‘বীরাঙ্গনা কাব্যে’র সঙ্গে তুলনা করি ওভিদের হিরোইক এপিসলসের, বাল্মীকি-ব্যাসদেবের সঙ্গে তুলনা হয় হোমার-ভার্জিলের। অ্যারিস্টটলের পোয়েটিক্সের সঙ্গে আমরা এখন তুলনীয় মনে করি সংস্কৃত আলংকারিকদের বিভিন্ন প্রস্থান।
৬. বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতি: একদল সমালোচক শব্দ, চিত্রকল্প, অলংকার ইত্যাদির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে তার স্বরূপ নির্ণয় করতে চান। এ ধরনের পদ্ধতিকে বলা হয় বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতি।
৭. বিচারমূলক সমালোচনা পদ্ধতি: আর বিশেষ মূল্যমানের দ্বারা কবিকৃতির স্বরূপ নির্ণয়ই মূল্য বিচারমূলক সমালোচনা পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য।
তাছাড়া সাহিত্য সমালোচনার অন্যান্য পদ্ধতি বা রীতি হলো:
ক. গঠনবাদী রীতি,
খ. উত্তরগঠনবাদী রীতি,
গ. নব্য সমালোচনা পদ্ধতি,
ঘ. ব্যক্তিগত সমালোচনা পদ্ধতি,
ঙ. যুক্তিপন্থি রীতি,
চ. পাঠভিত্তিক সমালোচনা পদ্ধতি,
ছ. ভাষ্যমূলক পদ্ধতি, ইত্যাদি।