উপন্যাসের প্রকাশকাল
‘আরণ্যক’ বিভূতিভূষণের চতুর্থ উপন্যাস । গ্রন্থাকারে প্রকাশের আগে মাসিক ” প্রবাসী ” পত্রিকায় কার্তিক ১৩৪৪ থেকে ফাল্গুন ১৩৪৫ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশ চৈত্র ১৩৪৫ ( ইং ১৯৩৯ ) । প্রকাশক , কাত্যায়নী বুকস্টল।
সাধরণ আলোচনা
‘পথের পাঁচালী’ রচনার সময়ই বিভূতিভূষণের মাথায় ‘আরণ্যক’ উপন্যাস রচনারও পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছিল। ১৯২৪ এর পুজোর সময় তিনি ভাগলপুরে খেলাতচন্দ্র এস্টেটের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ছিলেন। ১৯২৫ এ ‘পথের পাঁচালী’ লেখা শুরু এবং ১৯২৮ এ শেষ। এই বছরেই ২৬ এপ্রিল বিচিত্রায় প্রকাশের জন্য পাণ্ডুলিপি পাঠানো হয় । এই সময়কার একাধিক দিনলিপিতে বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’ রচনার মানসিক প্রস্তুতির কথা জানা যায় মোড়া গভীর অঙ্গন পরিক্রমার সময়ই তাঁর মুখমন সিদ্ধান্ত নেয় এই জলের জীবন নিয়ে একটা কিছু লিখবো একটি কঠিন শৌর্যপূর্ণ গতিশীল , ব্রাত্যজীবনের ছবি । এই বন, এই নির্জনতা, ঘোড়ায় চড়া মন হারালো অন্ধকার— এই নির্জনে জঙ্গলের মধ্যে ঝুপড়ি বেঁধে থাকা, মাঝে মাঝে যেমন আজ গভীর বনের নির্জনতা ভেদ করে যে সঁডিপথটা বাগানের দিকে চলে গিয়েছে দেখা গেল ; ঐরকম সুঁড়িপথ এক বাথান থেকে আর এক বাথানে যাচ্ছে পথ হারানো রাত্রের অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে ঘোড়ায় করে ঘোরা , এদেশের লোকের দারিদ্র্যা , সরলতা , এই Virile , active life এই সন্ধ্যায় অন্ধকারে – ভবা গভীর বন , ঝাউবনের ছবি – এই সব ‘। ( ‘ স্মৃতির রেখা ‘ , ১২.২.১৯২৮ )।
‘অপ্রকাশিত দিনলিপি’তেও একই পরিকল্পনার পুনরাবৃত্তি । সেখানে তিনি তাঁর দেখা এই অরণ্যমহল নিয়ে সরাসরি উপন্যাস রচনার কথা ভাবছেন , ‘ A novel on forests . এতে নির্জনতার কথা থাকবে , গাছপালার কথা থাকবে । অরণ্যানী — খাড়া উঁচু পাথরের স্তর । ধাতুপ্রস্তর । রঙীন ঝরণা যা অরণ্যের মধ্য দিয়ে নেমে আসছে । পাহাড়ের মাথায় রাঙা রোদ । শিউলিবন – দাবানল টাড়বারো অনেকে দেখেছে— গভীর রাত্রের অন্ধকারে খাদানের কাছে দাঁড়িয়ে মহিষের পালকে রক্ষা করবে।'(২১:২.১৯৩৪)।
বোঝাই যায় যে , কেবল আরণ্যক এর পরিকল্পনাই নয় তার নানা ঘটনা ও চরিত্রও লেখকের মনে ক্রমশ একটি স্থায়ীরূপ নিচ্ছে । প্রকৃতি, মানুষ, সৌন্দর্য, সরলতা, দারিদ্র্য ও শোষণ সবকিছুই একটি সংহত চেহারা নিয়ে উপন্যাসে চলে এসেছে, সঙ্গে এসেছে তাদের নানা অতিপ্রাকৃত বিশ্বাস ও যুগসঞ্চিত সংস্কার। অরণাপরিবেশে যাকে চূড়ান্ত সত্য বলে মনে হবে, অথচ অরণ্যের বাইরে যা চূড়ান্ত অবিশ্বাস্য। উপন্যাসের নায়ক সত্যচরণের মধ্য দিয়েও আসলে বিভূতিভূষণের সমকালীন অভিজ্ঞতারই প্রতিফলন। জঙ্গলমহলে কাজ করার সময় তাঁর দেখা বিভিন্ন ঘটনা , চরিত্র বা তাঁর নিজস্ব অনুভূতি সম্পর্কে তিনি যে সমস্ত টুকরো টুকরো দিনলিপি লিখেছিলেন উপন্যাসে অনেক ক্ষেত্রেই তার হবহু প্রতিফলন ঘটেছে।
পটভূমি ও প্রেক্ষাপট
১৯২৩ এর শেষদিকে বিভূতিভূষণ খেলাতচন্দ্র ঘোষ এস্টেটের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত হন। ভাগলপুর এবং পূর্ণিয়া জেলার অরণ্য অঞ্চলের সঙ্গে এই সময়েই তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়। বিশেষ করে ইসমাইলপুর এবং আজিমাবাদের অরণ্যপরিবেশেই ছিল তাঁর কাছারিতে বসবাস এবং ব্যাপক পরিভ্রমণ। প্রকৃতিপ্রেমিক লেখককে এই অরণ্যভূমি মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করেছিল। অবশ্য প্রথম দর্শনেই লেখক যে এই অঞ্চলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাননি দিনলিপিতে তারও প্রমাণ আছে: ” অভিজ্ঞতায় একথা বুঝলাম , আজ যে স্থানটা নতুন , ভাল লাগে না , মন বসে না , যত দিন যায় তার সঙ্গে স্মৃতির যোগ হতে থাকে। ততই সেটা মধুর হয়ে ওঠে । এই ইসমাইলপুর ১৯২৪ সালে আন্দামান দ্বীপের মত ঠেকতো। আজিমাবাদকে তো মনে হতো (১৯২৫ সালেও) সভ্য জগতের প্রান্তভাগ জঙ্গলে ভরা বেলজিয়াম কঙ্গোর কোন নির্জ্জান উপনিবেশ – আজকাল সেই আজমাবাদ সেই ইসমাইলপুর ছেড়ে যেতে হবে ভেবে কষ্ট হচ্ছে।” (স্মৃতির রেখা)
‘আরণ্যক’ উপন্যাসের সূচনাতেও সত্যচরণের একই মনোভাবের প্রতিফলন; জীবনের বেশীর ভাগ সময় কলিকাতায়
কাটাইয়াছি। বন্ধু-বান্ধব, সঙ্গ, লাইব্রেরী, থিয়েটার, সিনেমা, গানের আড্ডা — এসব ভিন্ন জীবন কল্পনা করিতে পারি না- এ অবস্থায় চাকুরীর কয়েকটি টাকার খাতিরে যেখানে আসিয়া পড়িলাম , এত নির্জন স্থানের কল্পনাও কোনদিন করি নাই । প্রথম দিন দশেক কি কণ্ঠে যে কাটিল। কতবার মনে হইল চাকুরীতে দরকার নেই, এখানে হাঁপাইয়া মরার চেয়ে আধপেটা খাইয়া কলিকাতায় থাকা ভাল । অবিনাশের অনুরোধে কি ভুলই করিয়াছি এই জনহীন জঙ্গলে আসিয়া – এ 64 জীবন আমার জন্য নয় । কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই সত্যচরণকেই জঙ্গল যেন পেয়ে বসে। তার নিজেরই স্বীকারোক্তি , “ দিন যতই যাইতে লাগিল , জঙ্গলের মোহ ততই আমাকে ক্রমে পাইয়া বসিল। এর নির্জনতা ও অপরাহের সিঁদুর ছড়ানো বন- ঝাউয়ের জঙ্গলের কি আকর্ষণ আছে বলিতে পারি না আজকাল ক্রমশ মনে হয় এই দিগান্তব্যাপী বিশাল বনপ্রাপ্তর ছাড়িয়া , ইহার রোদপোড়া মাটির তাজা সুগন্ধ এই স্বাধীনতা , এই মুক্তি ছাড়িয়া কলিকাতার গোলমালের মধ্যে আর ফিরিতে পারিব না । ‘ ( ‘ আরণ্যক ‘ , তৃতীয় পরিচ্ছেদ )
‘আরণ্যক’ উপন্যাসের কাহিনির সংক্ষিপ্তসার
প্রথম পরিচ্ছে: উপন্যাসের নায়ক সত্যচরণ বি.এ. পাশ করেও দীর্ঘকাল বেকার হয়ে বসেছিল। আনেক চেষ্টাতেও তার চাকরি জোটেনি। এদিকে মেসে তার দুমাসের টাকা বাকি পড়েছে। না দিতে পারলে খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। সৌভাগ্যক্রমে পথে কলেজের পুরনো বন্ধু সতীশের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ সেদিন সরস্বতী পুজো ছিল। তার সঙ্গে ছাত্রজীবনের হোস্টেলে গিয়ে আহার যেমন জোটে তেমনি জোটে সন্ধ্যায় জলসার নিমন্ত্রণ । এই হিন্দু হোস্টেলেই পুরনো বন্ধু অবিনাশের সঙ্গে সত্যচরণের দীর্ঘকাল বাদে দেখা। এরা ময়মনসিংহের কোনো অঞ্চলের জমিদার। তাছাড়া পূর্ণিয়া জেলায় তাদের একটা বিশাল জঙ্গল- মহালও আছে। সেখানে প্রায় বিশ-ত্রিশ হাজার বিঘে জমি বন্দোবস্তের চাকরি নিয়ে সত্যচরণ কলকাতা সেই নির্জন অরণ্যপ্রদেশে গিয়ে উপস্থিত হয়। প্রথম প্রথম সত্যচরণের অবস্থা হয়ে উঠেছিল শোচনীয়। সেই নির্জন নিঃসঙ্গ পরিবেশে দিনকাটানোই হয়ে উঠছিল অসম্ভব। কিন্তু ক্রমশই এখানকার প্রকৃতি ও মানুষ তাকে আকৃষ্ট করতে থাকে । ধীরে ধীরে সেও এই পরিবেশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ: সমস্ত অরণ্য পায়ে হেঁটে পরিদর্শন সম্ভব নয়। তাই সত্যচরণকে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরতে হয় । এত হাজার বিয়ে জমি অল্প সময়ে বিলি করা খুবই কঠিন। তা ছাড়া আর একটি সমস্যাও ছিল, সমস্ত জমিটাই গঙ্গার চর থেকে উঠে এসেছে। ত্রিশ বছর আগে গঙ্গার ভাঙনে যে জমি বিলুপ্ত হয়েছিল তাই আবার অন্যধারে চর হিসেবে দেখা দিয়েছে। কিন্তু জমিদার কিছুতেই পুরনো প্রজাদের জমি দেবে না। তাহলেই তারা স্বল্প দাবি করে বসবে। তাই ন্যায্য মালিকদের বঞ্চিত করে বেশি পয়সায় বাইরের লোকজনকে জমিতে বসানোই জমিদারের নির্দেশ। বঞ্চিত প্রজাদের প্রতি সত্যচরণ মমতা বোধ করে । ধীরে ধীরে তার চারপাশের প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটতে থাকে। প্রকৃতির সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যে সে যেমন মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়, তেমনই এখানকার দরিদ্র সরল মানুষগুলিও তাকে আকৃষ্ট করতে থাকে।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ: ধীরে ধীরে অরণ্যের রুক্ষতা ও ভয়াবহতার সঙ্গে সত্যচরণ পরিচিত হতে থাকে। নিরীহ দরিদ্র মানুষগুলির বিপরীতে একদল হৃদ্যাহীন, লোভী মানুষের মুখোমুখিও তাকে হতে হয়। সে বোঝে প্রকৃতি মানেই কেবল জোৎস্না নয়, তা অনেক সময় রুক্ষ, জলহীন এবং উত্তপ্ত। নিরীহ সরল মানুষগুলির বিপরীতে অত্যাচারী মহাজন নন্দলাল ওয়ারাও আছে, যে ফুলকিয়া বইহারের পুরনো তহশিলদারকে সরিয়ে তার বড়ো ছেলেকে সেখানে বসাতে চায়। কারণ, সেখানে তাঁচা পয়সা আদায়ের অনেক সুযোগ। সত্যচরণ রাজি না হওয়ায় নন্দলাল স্টেটের চিরশত্রু হয়ে থাকল। তবে এই পর্বে সভাচরণের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হল গ্রীষ্মের অসহ্য উত্তাপ, মারাত্মক জলকষ্ট এবং বিধ্বংসী দাবানল। প্রকৃতির যে এমন রুক্ষ দিক আছে তাও এইভাবে ধীরে ধীরে তার কাছে স্পষ্ট হয়।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ: পুণ্যাহ উৎসব হয় আষাঢ় মাসে । পুণ্যাহ মানে হল ‘পুণ্য কর্ম অনুষ্ঠানের শাস্ত্রসম্মত দিন’। আসলে জমিদারেরা যেদিন প্রজাদের কাছ থেকে নতুন বৎসরের জন্য খাজনা আদায় শুরু করতেন সেদিনই ‘পুণ্যাহ’ উৎসব। সত্যচরণ এই উপলক্ষে ধারে কাছের সমস্ত দরিদ্র প্রজাদেরও নিমন্ত্রণ জানায়। অতি দরিদ্র নিম্নবর্ণের মানুষেরা সামান্য চীনাদানা, শুড় এবং জলো টক দই খাওয়ার জন্য যেভাবে উঠোনে বসে প্রবল বৃষ্টিতে ভিজল তা দেখে, সত্যচরণ দুঃখ পায়। এত গরিব দেশ এবং গরিব মানুষ যে থাকতে পারে তা তার জানা ছিল না। এদের প্রতি গভীর সমতা নিয়েই সে একদিন এই দরিদ্র মানুষগুলিকে নিমন্ত্রণ করে নানা সুখাদ্য পরিবেশন করায়। জীবনের সেরকম ভোজ খাওয়ার কথা তারা কল্পনাও করেনি। এই পর্বে সাঁওতাল সার মতো মহাজনের সঙ্গে পরিচিত হওয়াটাও সত্যচরনের একটা বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। এরকম সৎ, নিরাসত্ত্ব ও দার্শনিক মহাজন বিরল। সে অনেক সময়ই বিনা মালে টাকা ধার দেয়, ঋণশোধের জন্য কোনো তাগাদা করে না, মামলা করা তার স্বভাববিরোধী। তাই হাজার হাজার টাকার দলিল অনায়াসে তামাদি হয়ে যায় এবং সে নির্বিকার চিত্তে তা ছিঁড়ে ফেলে দেয়। অপরদিকে অয়পাল কুমারের মতো দরিদ্র মানুষের শান্ত, অলস উদ্বেগহীন জীবনযাত্রা সত্যচরণের ওপর ধীরে ধীরে একটা প্রভাব ফেলে যায়। চঞ্চল, গতিশীল এবং উৎকণ্ঠাপ্রবণ যে নাগরিক জীবনের সে . এতকাল অংশীদার ছিল এর সঙ্গে তার মিল নেই।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ: অরণ্যের নানাধরনের চরিত্রের সঙ্গে সত্যচরনের পরিচয় হতে থাকে। প্রবল প্রতাপশালী দেবী সিং রাজপুতের বিধবা স্ত্রী কুন্তার দুর্দশার কথা পাটোয়ারি তাকে জানায়। একদা যে চরম ভোগ-বিলাসের মধ্যে দিন কাটিয়েছে, সে এখন রাতের অন্ধকারে ম্যানেজাববাবুর পাতের এঁটো ভাত নেবার জন্য পাঁড়িয়ে থাকে। ছেলেমেয়েদের জন্য লুকিয়ে ফুল চুরি করতে গিয়ে ইজারাদারের লোকজনের হাতে মার খায়। আবার প্রকৃতিও ক্রমশ সত্যচরণকে হাতছানি দেয়। বুনো মহিষের ভয় কাটিয়ে সে ঘোড়ায় চড়ে জঙ্গল-পরিক্রমা করতে থাকে, গ্রাম্য মেলায় গিয়ে সেখানকার লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে থাকে। আবার এই মেলাতেই গিরিধারীলালের মতো সাচ্চা মানুষের দেখাও সে পায়। আর দেখা পায় নাটুয়া বালক ধাতুবিয়ার মতো শিল্পীর যে হো-হো নাচ বা ছক্কর-বাজি নাচ শিখেই খুশি নয়, তার লক্ষ্য অনেক দূরে।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ: মাঝে মাঝে জঙ্গল থেকে নানা অতিপ্রাকৃত ঘটনার খবর আসে। রামচন্দ্র আসিন বা বৃদ্ধ ইজারাদারের যুবক পুত্রের শোচনীয় পরিণতির কোনো যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা হয় না। অনেকেই নাকি দেখেছে যে রাতের বেলা তাদের খাটিয়ার নীচে জঙ্গল থেকে একটি সাদা কুকুর এসে ঢোকে। আর ভোরবেলায় সে একটি মেয়েমানুষ হয়ে বেরিয়ে যায়। এর অনিবার্য ফল হল তাদের উন্মাদ হয়ে যাওয়া অথবা শোচনীয় মৃত্যুবরণ। সত্যচরণের মনে হয়েছিল যে, শহরের আলোকোজুল বৈঠকখানায় যে কাহিনি সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য বলে মনে হলে, এই আদিম অরণ্যের মধ্যে তা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। তবে এই পর্বে রাজু পাঁড়ে চরিত্রটিই সত্যচরণকে আকৃষ্ট করে সবচেয়ে বেশি। এই গরিব ব্রাহ্মাণ চরিত্রটি আসলে জঙ্ক মানুষ, তার মধ্যে একটি কবিসাও লুকোনো রয়েছে। দু-বিঘে জমি ইজারা নিয়েও সে কোনো চাষের ব্যবস্থা করে উঠতে পারেনি, চীনাঘাসের দানা খেয়ে মাস কাটিয়ে দিয়েছে। সাত্ত্বিক প্রকৃতির এই মানুষটির খেতে কাজ করার বদলে গাছের তলায় বসে আধ্যাত্মিক চিন্তায় বিভোর হওয়াই তার বেশি পছন্দের।শুয়োরমারি বস্তিতে কলেরার প্রাদুর্ভাব হওয়ার সময়ে জড়িবুটি নিয়ে রাজু চিকিৎসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ । এর বিনিময়ে সে কোনো অর্থের প্রত্যাশা করে না । মহালিখারাপের ভীষণ জঙ্গলের মধ্যে সে অজ্ঞাত এক সৌন্দর্যভূমি রয়েছে সেটাও এই সময়েই সত্যচরণের আবিষ্কার । হিতে জন্তুর ভয়কে উপেক্ষা করে এর মধ্যে ঘোড়া ছুটিয়ে বেড়ানোটি ক্রমশ তার নেশার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল । এই অরণ্যের মধ্যেই যেন সভ্যতার আদিম স্তরটি লুকোনো আছে । তাই অরণা আদিম মানুষের বাসস্থান । সপ্তম পরিচ্ছেদ জগল – মহালে এখন ম্যানেজারবাবুর ব্যাপক পরিচিতি । দেশের জন্য তার মন মাঝে মাঝে ব্যাকুল হয়ে ওঠে ঠিকই । কিন্তু এখানকার প্রকৃতির মধ্যেও সে যেন নতুন ধরনের আকর্ষণ বোধ করে । আবার রাসবিহারী সিং – এর মতো দুর্দান্ত মহাজনের বাড়িতে নিমন্ত্রণ বজায় রাখতে গিয়ে এই ধনী অন্তঃপুরের রুচি ও সৌন্দর্যের অভাবও তার চোখে পড়ে । সেখানে কেবল ফুল প্রাচুর্যের নিদর্শন । তবে রাসবিহারীর বাড়িতে শিল্পী যাতুরিয়ার সাক্ষাৎলাড সভাচরণের আনদের কারণ হয় । এই নৃত্যশিল্পী বালকটিকে তার ভালো লাগে । ধাতুরিয়ার সাধ কলকাতায় গিয়ে নাচ দেখানো । অনেক কষ্ট করে সে যে – সব ভালো ভালো নাচ শিখেছে সেখানেই তার প্রকৃত সমঝদারের দেখা পাওয়া যাবে । কিন্তু কঠোর বাস্তব সত্যটি সত্যচরণের জানা ছিল । শহরে ধাতুরিয়ার কোনো স্থান নেই । অষ্টম পরিচ্ছেদ প্রকৃতির যথার্থ স্বরূপটি উপলব্ধি করতে হলে তার সঙ্গে একা হয়ে যেতে হয় , প্রকৃতির আরাধনা করতে হয় । কেবল বাইরে থেকে ক্ষণকালের জন্য দেখলে এর অন্দরমহলে প্রবেশ করা যাবে না । তা ছাড়া প্রকৃতি তার ভক্তদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ আনুগত্য দাবি করে , আংশিক আনুগত্য নয় । সত্যচরণ যে মুহূর্তে এই সত্যটি উপলব্ধি করে , সেই মুহূর্তেই প্রকৃতি তার কাছে আর অজানা থাকে না । নির্জন বিশাল বটুলিয়া বইবারের দিগন্তব্যাপী নিস্তব্ধ অরণ্যে ঘোড়ার উপরে বসে , অথবা গভীর রাতে ঘরের বাইরে একা দাঁড়িয়ে সত্যচরণ ক্রমশ প্রকৃতির অজানা রহস্য , মানুষ বা রোমাঞ্চের সন্ধান পায় । আবার মাঝে – মাঝেই কঠোর বাস্তব উকি মারে । সীতাপুর গ্রামের এক বাঙালি ডাক্তার রাখালবাবুর অকালমৃত্যুতে তার পরিবারের শোচনীয় দুরবস্থা সত্যচরণকে বাণিত করে । এই নিঃস্ব পরিবারটির জন্য জমিদারি থেকে কিছু আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করা তার চাকরিজীবনের আর একটি সৎ কাজ । তবে সরস্বতী কৃতী এবং তার সৌন্দর্যের নীরব উপাসক যুগলপ্রসাদের সঙ্গে পরিচয়ই বোধ হয় সভাচরণের জীবনের চরম প্রাপ্তি । প্রকৃতির এরকম সৌন্দর্যও যেমন তার এর আগে চোখে পড়েনি , তেমনই যুগলপ্রসাদের মতো মানুষও সে আগে আর দেখেনি । নিজের পরিশ্রম এবং অর্থব্যয় করে যে সরস্বতী তুর্কীর চারধারে নানা দুষ্প্রাপ্য ফুলের গাছ বসিয়ে যাচ্ছে । সত্যচরণত উৎসাহিত হয়ে সরস্বতী কূর্তীকে সুন্দরতর করার কাজে হাত দেয় । নবম পরিবেটুলিয়া আসার তিন বছর বাসে সত্যচরণের মানসিকতা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত । এখন আর শহর তার ভালো লাগে না । ওপরওয়ালাদের ক্রমাগত ভাগাদা ও আল নষ্ট করে প্রজ্ঞা বসাতে তার মন চায় না । বিচিত্র ধরনের আরও কিছু মানুষের সে দেখা পায় । মটুকনাথ পাঁড়ের মতো সাংসারিক কান্ডজ্ঞানহীন 72 ব্রাহ্মণ পণ্ডিত কাছারিতে এসে উপস্থিত হয় । যেখানে সভ্যজগতের মানুষেরই দেখা নেই , সেখানে সে টোল খুলবে । সম্পূর্ণ ফাঁকা ঘরে বসে সে কল্পিত ছাত্রদের ব্যাকরণ পড়ায় । আবার দুর্ধর্ষ রাজপুত সর্দার ছটু সিং ও তার দলবল কীভাবে নিরীহ গাঙ্গোতা প্রজাদের ফসল লুঠ করে নিতে চায় তাও সত্যচরণ চোখের সামনে -দেখে । আপাতত হাঙ্গামা ঠেকানো যায় বটে , কিন্তু দুটু সিং – এরা যে ভবিষ্যতে চরম অশান্তির কারণ হয়ে উঠবে তাও তার কাছে স্পষ্ট হয় । আবার ফুলকিয়া বইহারের নির্জন অরণ্যে তাঁবু খাটিয়ে থাকার সময়ই সত্যচরণ বুনো মহিষের দেবতা টাড়বারোর কথা শোনে । এই দেবতা নাকি শিকারিদের হাত থেকে বুনো মহিষদের রক্ষা করেন । দমশ পরিচ্ছেদ জমি জরিপের কাজে প্রচন্ড শীতের মধ্যেও সত্যচরণকে দলবল নিয়ে জঙ্গলে তাঁবু খাটিয়ে থাকতে হয় । কর্মচারীদের সঙ্গে যেমন ঘনিষ্ঠতা হয়েছে , তেমনই জঙ্গলের দরিদ্রতম অধিবাসীদের জীবনযাত্রা দেখে সে চিন্তিত হয় । শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য নক্ছেনী ভক্তরা সপরিবারে যে রুলাইয়ের ভূষির মধ্যে শুয়ে থাকে এটা জানার পর সে বোঝে যে , প্রকৃত ভারতবর্ষকে চেনা কত কঠিন । ফসল উঠে যাওয়ার পর ফুলবিয়া বইহারের চেহারা পালটে যায় , বাইরে থেকে ব্যবসায়ীরা মাল কিনতে আসে । তাদের সঙ্গে সঙ্গে আসে নানা দোকানদার ও ফিরিওয়ালা । ঠাকুর – দেবতারও আমদানি ঘটে , রং – তামাশা দেখানো লোকেরাও এসে ভিড় জমায় । সকলেরই এটা দুপয়সা রোজগারের সময় । এখানে নগদ পরসার কারবার বেশি নেই । ফসলের বিনিময়ে ফিরিওয়ালারা দরিদ্র প্রজাদের জিনিস বেচে এবং তাদের মারাত্মকভাবে ঠকায় । এখানেই আবার বৃদ্ধ নট দশরথের দেখা মেলে । এই ঘাট বছরের বৃদ্ধ যখন রং মেখে ‘ ননীচোর নাটুয়া’র নাচ নাচে তখন হাসি সামলানো কঠিন হয় । আবার নক্ছেদী ভকতের বালিকা বধূ মীর মধ্যে সত্যচরণ এক চিরন্তন নারীর সন্ধান পায় । একাদশ পরিচ্ছেদ : সাঁওতাল রাজা দোবন্ধু পান্না এবং তার পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হওয়াটা ছিল সভাচরণের অরণাজীবনের সবচেয়ে বড়ো লাভ । এই রাজবংশই এই অঞ্চলের প্রকৃত মালিক । উত্তরে হিমালয় পর্বত , দক্ষিণে ছোটনাগপুরের সীমানা , পূর্বে কুশা নদী , পশ্চিমে মুঙ্গের একদা এই ছিল এঁদের রাজ্যের সীমানা । এঁরা বীর এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী । এদেরই পূর্বপুরুষেরা মোগল সৈন্যদের সঙ্গে লড়েছে , সাঁওতাল বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে । কিন্তু সেই বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়াতেই এদের সমৃদ্ধির অবসান । সাঁওতাল বিদ্রোহের অন্যতম নেতা গোবরু পারা বীরবর্তী এখন অতিবৃদ্ধ এবং খুবই গরিব । তিনি এখন সপরিবারে খোলার চালের বাড়ির বাসিন্দা , গোরু – মহিষ চরানোই এখন তাঁদের জীবিকা । তথাপি এই বনভূমির আদিম অধিবাসীরা তাঁকে এখনো রাজার সম্মান দেয় । সত্যচরণও তাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিয়েছে । তবে রাজার নাতির মেয়ে ভানুমতীই সত্যচরণকে মুগ্ধ করেছিল বেশি । তার প্রতি তার মনের গোপন কোণে একটা দুর্বলতাও দেখা দেয় । এই প্রাচীন রাজবংশের সমাধিস্থলে দাঁড়িয়ে সত্যচরণ এক নিষ্ঠুর ঐতিহাসিক সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ায় । ভারতবর্ষের ইতিহাস যেন কেবল বিজয়ী আর্থসভ্যতার ইতিহাস , বিজিত অনার্যজ্ঞাতির ইতিহাস নয় । অথচ এরাই । ভারতবর্যের আদিম অধিবাসী , এরাই প্রকৃত ভূমিপুত্র । দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : মাঝে মাঝে কাছারির ম্যানেজার হিসেবে সত্যচরণকে নানা বিচিত্র ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয় । কখনও রাজু পাঁড়ের ফসলের খেতকে বুনো শুয়োরের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তাকে বলুক নিয়ে উপস্থিত হতে হয় , কখনও রাজুর তরুণ বয়সের প্রেমকাহিনিও শুনতে হয় । আবার কখনও একটি গোঁড় পরিবার , অথবা এক বৃদ্ধ সাধুর সঙ্গেও তার জঙ্গলে দেখা হয়ে যায় । তবে কবি বেঙ্কটেশ্বর প্রসাদের সঙ্গে
[6:27 PM, 5/9/2022] Gourab Roy: পরিচিত হয়ে সত্যচরণের ভালো লাগে । এই গ্রাম্য কবিটি জমি চাওয়ার জন্য তার কাছে আসেনি , এসেছিল কবিতা শোনানোর জন্য । এটিই সত্যচরণের সবচেয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা । বেঙ্কটেশ্বর প্রসাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে সে একদিন কবিপত্নীর সঙ্গে আলাপও করে আসে । 4 ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ বটুলিয়া ও নাঢ়া বইহারের ওপর সত্যচরণের টান বাড়তে থাকে । সার্ভের কাজের জন্য বাইরে গেলে তার মনে হয় যে , সে বিদেশে আছে । পরিচিত চরিত্রগুলির সঙ্গে দেখা হলে তার মন ভালো হয়ে যায় । অনায়াসেই তাদের ঘরে সে আহার্য গ্রহণ করতে পারে । তবে দোবরু পান্নার রাজধানীতে বুলনপূর্ণিমার উৎসব দেখার অভিজ্ঞতা সভাচরণের কাছে অতুলনীয় বলে মনে হয় । জ্যোৎস্নারাতে ভানুমতী ও তার সহচরীদের সমবেত নাচগান এক অপরূপ স্বর্গীয় পরিবেশের সৃষ্টি করে । এর মধ্য দিয়ে যেন প্রাচীন ভারতবর্ষের হারানো সংস্কৃতিরই একটি পরিচয় ফুটে ওঠে । চতুর্দশ পরিচ্ছেদ শহরের লোকের জঙ্গল সম্পর্কে অনভিজ্ঞতা এবং হাস্যকর ধারণার একটা উদাহরণ একদিন সত্যচরণ হাতেনাতেই পেয়ে যায় । কলকাতা এবং পূর্ণিয়া থেকে এক বাঙালি রায়বাহাদুরের পরিবার সরস্বতী কুণ্ডীর ধারে পিকনিক করতে এসেছে । এদের প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখার চোখ নেই , রূপ আস্বাদনের ক্ষমতা নেই , আবার এর মধ্যে যে বিপদের আশঙ্কা আছে সে সম্পর্কেও তারা অবহিত নয় । একটা সামান্য সো – নলা শটগান হাতে নিয়ে এই ভীষণ অরণ্যে এরা প্রবেশ করেছে । এদের কাজ প্রকৃতিকে সবদিক দিয়েই দুষিত করা । ঘুরে ফিরে পুরনো চরিত্রদের সঙ্গে সভাচরণের মাঝে মাঝেই দেখা হয় । তাদের সুখ – দুঃখের খবর সে নেয় , তারাও সত্যচরণকে নিজেদের লোক ভেবে অনেক মনের কথা বলে । কেবল এখানকার প্রকৃতিই নয় , এখানকার মানুষগুলির সঙ্গেও সে ক্রমশ একাত্ম হয়ে উঠেছে । ইতিমধ্যে রাজা দোবরু পান্নার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে সত্যচরণ চকমকিটোলায় যায় । মহাজনেরা ঋণের দায়ে তাদের গোরু – মহিষগুলিকে আটকে রেখে দিয়েছে । শেষ পর্যন্ত তার হস্তক্ষেপে সমস্যার আপাতত সমাধান হয় । ভানুমতীকে সঙ্গে নিয়ে সত্যচরণ দোবর পান্নার সমাধিতে ফুল ছড়িয়ে দিয়ে যেন এক ঐতিহাসিক কর্তব্য পালন করে । আর্যজাতির কোনো বংশধর বোধ হয় এই প্রথম কোনো অনার্য রাজার স্মৃতির প্রতি সম্মান জানা পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ বাওতাল সাহু মহাজনের নির্লোভ এবং নিরাসক্ত চরিত্রের পরিচয় সত্যচরণ আর একবার পায় । সরকারের রেভিনিউ দাখিল করবার প্রয়োজনে তার দশ হাজার টাকার প্রয়োজন হয় । যাওতাল কোনো হ্যাজনেটি ছাড়াই ম্যানেজারবাবুকে অতগুলো টাকা দিয়ে দেয় । আর টাকা শোধ না হওয়া পর্যন্ত সে একদিনও কাছারির পথ মাড়ায়নি পাছে কেউ মনে করে যে , সে টাকার তাগাদা দিতে এসেছে । মৃত রাখালবাবুর পরিবারের খোঁজ নিতে গিয়ে তার অবিবাহিতা তিন বয়স্ক কন্যার ভবিষ্যৎ ভেবে সভাচরণের দুশ্চিন্তা বাড়ে । বিহারের এই সুদূর গ্রামাঞ্চলে এদের উপযুক্ত পাত্র মেলা সম্ভব নয় । এই বাঙালি পরিবারটি যে দ্রুত তাদের বাঙালিত্ব হারিয়ে ফেলছে এ সম্পর্কে তার মনে কোনো সন্দেহই থাকে না । ঘোর বর্ষার দিনে মাইলের পর মাইল ঘোড়া ছুটিয়ে সভ্যচরণের মনে এক অনাস্থানিত আনন্দের অনুভূতি জাগে । এই বিপুল ও মহান সৌন্দর্যের আড়ালে কোনো এক মহান অদৃশ্য দেবতার উপস্থিতি অনুভব করে । ইসমাইলপুরের কাছারিতে এক বর্ষামুখর শ্রাবণ – দিনে বালকশিল্পী ধাতুরিয়ার সঙ্গে সভ্যচরণের আবার দেখা । এখনও তার মনে কলকাতায় যাওয়ার বাসনা , কারণ , সেখানে নাকি নাচের কদর আছে । কিন্তু মাস দুই পরে বাটারিয়া স্টেশনের অদুরে রেললাইনের ধারে তার মৃতদেহ পাওয়া যায় । এটি আত্মহত্যা হতে পারে । কিন্তু তার কারণ জানা যায়নি । তিন বছরের মধ্যে নাড়া 74 বইহার আর লবটুলিয়ার সমস্ত জমি বিলি হয়ে যায় । বাকি থাকে সরস্বতী কুণ্ঠীর তীরবর্তী বনভূমি । এ জমি সবচেয়ে বেশি উর্বর এর জন্য চাহিদাও বেশি । আর কতদিন এই অরণ্যভূমিকে বাঁচানো যাবে , এ সম্পর্কে সত্যচরণের মনেও সন্দেহ জাগে । : ষোড়শ পরিচ্ছেদ এখনও যুগলপ্রসাদের আশা যে , সত্যচরণ সরস্বতী কুখীটি বাঁচিয়ে রাখতে পারবে । তাই এখনও সে মহালিখারানপের পাহাড়ে নতুন নতুন গাছপালার সন্ধান করে বেড়ায় । কুণ্ডীর ধারে ধারে পুড়বে । কিন্তু সভাচরণের জানা আছে যে , লবটুলিয়া তো গেছেই , সরস্বতী কুণ্ডীও যাবার মুখে । জমির ক্ষুধা বড় ভয়ানক । এরই মাঝেঝ গনোরি তেওয়ারীর দুঃখের জীবনের কাহিনি তাকে শুনতে হয় । একটা জিনিস ক্রমশ সভ্যচরণের চোখে পড়ে । যুগলপ্রসাদ ছাড়া এখানকার সবাই বৈষয়িক উন্নতি নিয়ে মাথা ঘামায় , জমি আর মোষের পরিমাণ বৃদ্ধি হলেই তারা খুশি । প্রকৃতি থাকল কি গেল তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই । লবটুলিয়া ছাড়ার আগে সত্যচরণ যে – কটি সৎ কাজ করে তার মধ্যে একটি হল কুত্তাকে বিনা খাজনায় দশ বিঘে জমি দেওয়া । সপ্তদশ পরিচ্ছেদ সন্ধ্যার পর লবটুলিয়াকে দেখতে এখন নতুন লাগে । এখন সেখানে বিস্তীর্ণ প্রান্তর ব্যাগী শস্যক্ষেত্র আর মাঝে মাঝেঝ অজস্র ছোটো ছোটো গ্রাম । প্রত্যেকটি বাড়িই জঙ্গলের বাঁশে ছাওয়া । কাশ ডাটার বেড়া সেখানে । এই নতুন জনপদে নানা ধর্ম ও বিশ্বাসের মানুষের ভিড় । জাতি বা বর্ণ নিয়ে এখানে কেউ মাথা আমায় না , তাই গাঙ্গোতা দ্রোণ মাহাতো রাক্ষণ মটুকনাথ পণ্ডিতকে উপেক্ষা করে শিবপুজো করে । এই নতুন সমাজে মটুকনাথদের নির্দেশ অচল । ইতিমধ্যে ছটপুজো আসে যায় । কার্তিক মাসের ছুট – পরব এদেশের বড়ো উৎসব । যেখানে একদা নীলগাইয়ের দল দৌড়ে যেত , হায়েনার হাসি ও বাঘের গলার আওয়াজ শোনা যেত সেখানে এখন উৎসবের কোলাহল । সত্যচরণকে বিভিন্ন টোলায় ছটের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতে হয় । এর মধ্যেই একদিন গিরিধারীলালের মতো নিরীহ এবং অসুস্থ মানুষকে সত্যচরণের নির্দেশে বন থেকে কাছারিতে নিয়ে আসা হয় । কুষ্ট হয়েছে সন্দেহে তাকে কেউ ছোঁয় না , আর তার সারা গায়ে হয়েছে এক রকমের খা বাজু পাঁড়ের জড়িবুটির চিকিৎসায় সে ভালো হয়ে যায় । সত্যচরণ এই দরিদ্র নিরীহ মানুষটিকেও বিনা সেলামিতে কিছু জমির ব্যবস্থা করে দেয় । অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ সত্যচরণের জঙ্গল থেকে বিদায় নেবার সময় এসে গেছে । যুগলপ্রসাদকে সঙ্গে নিয়ে শেষবারের মতো ভানুমতীর সঙ্গে সে দেখা করতে যায় । ভানুমতীদের আতিথেয়তার এবারেও তুলনা নেই । তবে সত্যচরণের মনে এখন বিষণ্ণতার সুর । এই বন , এই পাহাড় বা এই মানুষগুলির সঙ্গে তার আর কোনোদিনই দেখা হবে না । যাবার সময় ভানুমতী হঠাৎ সত্যচরণের প্রতি মনের দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেলে , আর সত্যচরণেরও মনে হয় যে , ভানুমতীকে বিবাহ করে এখানে থেকে গেলেই বোধ হয় ভালো হত । কিন্তু তার এও জানা যে , বাস্তবে তা সম্ভব নয় । তবে বটুলিয়া ছাড়ার সময় একটি দুঃখ সত্যচরণের মনে থেকেই যায় । চাকরির শর্ত পালন করে সব জমি সে বিলি করেছে ঠিকই কিন্তু তার হাতেই তো এ অপূর্ব বনানীর ধ্বংস হয়েছে । এর জন্য অরণ্য – দেবতাদের কাছে সে ক্ষমা প্রার্থী । জগল ছেড়ে আসার পনেরো – ষোলো বছর বাদেও মাঝে মাঝে স্বপ্নের মতো অরণ্যজীবনের স্মৃতি তার মনকে উদাস করে দেয় । সেখানকার মানুষগুলির কথাও তার মাঝে মাঝে মনে পড়ে । এই স্মৃতিটুকুই এখন তার একমাত্র সম্বল।
[6:31 PM, 5/9/2022] Gourab Roy: চরিত্রবিচার ক . সত্যচরণ : ‘ আরণ্যক ‘ উপন্যাসে প্রচলিত অর্থে নায়িকা না থাকলেও এর নায়ক নিঃসন্দেহে সত্যচরণ । নায়ক না বলে কেন্দ্রীয় চরিত্র বললেও ক্ষতি নেই। উপন্যাসের প্রথম থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত তার একক অবস্থিতি । বন্ধু অবিনাশদের পূর্ণিয়া জেলার জঙ্গল মহলে চাকরি নিয়ে এক শীতের বিকেলে বি.এন.ডব্লিউ রেলওয়ের একটি ছোটো স্টেশনে সভ্যচরণের নামা থেকে উপন্যাসের কাহিনির আরম্ভ আর প্রায় বিশ – ত্রিশ হাজার বিশ্বে জমি বন্দোবস্ত করে তার ফিরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাহিনির ওপর যবনিকাপাত । আঠারোটি পরিচ্ছেদের প্রায় প্রতিটিতেই সত্যচরণ ক্রমাগত নতুন নতুন ঘটনা ও চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে , ধীরে ধীরে প্রকৃতির রহস্য তার সামনে উদ্ঘাটিত হয়েছে , এখানকার মানুষগুলিকে তার ভালো লাগা শুরু হয়েছে এই সব অভিজ্ঞতার বিবরণের মধ্যে দিয়ে যেমন উপন্যাস গড়ে ওঠে , তেমনই সভ্যচরণ চরিত্রের ক্রমপরিণতির একটি চিত্র পাওয়া যায় । লবটুলিয়ায় পা দেবার প্রথম দিন দশেক সত্যচরণের বেশ কষ্টে কেটেছিল । কতবার মনে হইল চাকুরীতে দরকার নাই , এখানে হাঁপাইয়া মরার চেয়ে আধপেটা খাইয়া কলিকাতায় থাকা ভাল । কিন্তু ক্রমশ এখানকার সরল দরিদ্র মানুষগুলিকে তার ভালো লাগতে শুরু করে । আর জঙ্গলের আকর্ষণও ক্রমশ বাড়তে থাকে , দিন যতই যাইতে লাগিল , জঙ্গলের মোহ ততই আমাকে ক্রমে পাইয়া বসিল । ‘ এই উপন্যাসে সভাচরণের মানবপ্রীতি এবং প্রকৃতিপ্রীতি পাশাপাশি চলেছে । ‘ প্রস্তাবনা ‘ – তেই সে জানিয়েছিল , ‘ শুধু বনপ্রাপ্তর নয় , কত ধরনের মানুষ দেখিয়াছিলাম । ‘ কথাটি আক্ষরিকভাবেই সত্য । প্রকৃতি বিভিন্ন ঋতুতে তার কাছে বিভিন্ন রূপে দেখা দেয় , আর প্রকৃতিসন্তানেরা দেখা দেয় তাদের সুখ – দুঃখ , বিশ্বাস ও সরলতা নিয়ে । তাই সত্যচরণকে বিচার করতে হবে তার দেখা প্রকৃতি ও মানুষের পটভূমিকায় । সভাচরণকে স্বাভাবিকভাবেই স্বয়ং বিভূতিভূষণের প্রতিনিধি বলে অনেক সমালোচকের মনে হয়েছে । বিভূতিভূষণের বিভিন্ন দিনলিপির অনেক অভিজ্ঞতার বর্ণনাই ‘ আরণ্যক ‘ – ৫ পাওয়া যাবে । বিভূতিভূষণের ব্যক্তিগত অনেক অনুভূতি এবং দেখা ঘটনা উপন্যাসে ব্যবহৃত । বিভূতিভূষণও একটা খেলাতচন্দ্র ঘোষের ভাগলপুর পূর্ণিয়ার বিস্তীর্ণ অরণামহলের অ্যাসিস্টান্ট ম্যানেজার নিযুক্ত হয়েছিলেন । তাঁরও কাজ ছিল প্রজাদের মধ্যে জঙ্গলের জমি বিলি করা । এখানেই তাঁর মনে ” A novel on forests ‘ লেখার পরিকল্পনা জাগে , Forest এর নভেলে জমিদার অর্থবান ও rich | দুঃস্থ ও গরিব উভয়ের দ্বন্দ্ব । এইটি ফোটার । ( ‘ অপ্রকাশিত দিনলিপি ‘ ) পুণ্যাহ উৎসবে প্রজাদের খাওয়ানো , ফাল্গুন মাসে হোলির সময় গ্রাম্য মেলা দেখতে গিয়ে সভাচরণের অভিজ্ঞতা , অরণ্যের মধ্যকার প্রাচীন রাজবংশের সমাধিস্থল , বেঙ্কটেশ্বর নামক হিন্দিভাষী গ্রামা কবি – এনের কথা বিভূতিভূষণের অপ্রকাশিত দিনলিপি ‘ , ‘ স্মৃতির রেখা ‘ বা ‘ উৎকণ ‘ নামক সিনপঞ্জিতে খুঁজে পাওয়া যাবে । সভাচরণের প্রকৃতিমুগ্ধতা এবং প্রকৃতির মধ্যে অধ্যাত্ম – রহস্যের সন্ধান এ সময়ই স্বয়ং বিভূতিভূষণের উত্তরাধিকার । তবে বিভূতিভূষণের সৃষ্টিকৌশলে বাস্তব সত্য এখানে সাহিত্যের মধ্যে রূপান্তরিত । সংক্ষেপে সভ্যচরণের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলির উল্লেখ করা যেতে পারে । নগরজীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত থাকলেও তার মন কৃত্রিম বা যান্ত্রিক হয়ে যায়নি । তাঁর মধ্যে একটা অনুভূতিপ্রবণ মন ছিল , আর ছিল সহজাত মমত্ববোধ , তাই প্রাথমিক বিরূপতা সত্ত্বেও ধীরে ধীরে লবটুলিয়ার প্রকৃতির মোহে সে আচ্ছন্ন 76 হয়ে পড়ে , সরস্বতী কুন্ডীর ( সৌন্দর্যপূজারি যুগলপ্রসাদ তার কাছেই যোগ্য মর্যাদা পায় । যুগলপ্রসাদের খ্যাপামির সেও অংশীদার হয় । জঙ্গলের অসহায় দরিদ্র মানুষগুলির প্রতি সত্যচরণের গভীর সহানুভূতি তার চরিত্রের একটি উল্লেখযোগ্য দিক । দু – আনা নামের একটি লোহার কড়াই কিনতে পেরে কাছারির সিপাহি মুনেশ্বর সিং এর আনন্দ , ভয়ংকর শীতে বিনা নিমন্ত্রণে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কেবল ভাত খেতে পাওয়ার জন্য দরিদ্র প্রজাদের ন – মাইল পথ হেঁটে কাছারিতে আসা , ভরা বর্ষায় ভিজে কাছারির উঠোনে গাঙ্গোতা এবং সোসাদ প্রজাদের মহানন্দে কেবল চীনা ঘাসের দানা , ভেলিগুড় এবং জোলো দই খাওয়া — এসবই মানবজীবন ও মানবচরিত্র সম্পর্কে তার ধারণা পাল্টে দেয় , কেন জানি না , ইহাদের হঠাৎ এত ভাল লাগিল । ইহাদের দারিদ্র্য্য , ইহাদের সারল্য , কঠোর জীবনসংগ্রামে ইহাদের মুঝিবার ক্ষমতা— এই অন্ধকার আরণ্যভূমি ও হিমবর্ষী মুক্ত আকাশ বিলাসিতার কোমল পুষ্পাদ্ভূত পথে ইহাদের যাইতে দেয় নাই , ইহাদিগকে সত্যকার পুরুষমানুষ করিয়া তুলিয়াছে । ‘ তাই এদের উপকারের জন্য তার নিজের হাতে যতটুকু ক্ষমতা ছিল তা সে কাজে লাগিয়েছে । বিনা সেলামিতে বা খাজনায় সে অনেককে জমি দিয়েছে । এদের কেউ ক্ষতি করতে চাইলে বাধা দিয়েছে । বিশেষ করে কুণ্ডা বা গিরিধারীলালের মতো অসহায় মানুষকে বিনা সেলামিতে জমি দেওয়া যে তার জীবনের অন্যতম সৎকর্ম তা স্বীকার করতেও সে দ্বিধা করেনি । অন্যদিকে রাসবিহারী সিং , নন্দলাল ওঝা বা ছুট্টু সিং – এর মতো অত্যাচারী মহাজন বা জোতদারদের প্রতি তার বিরূপতার কথা সত্যচরণ গোপন রাখেনি । নিরীহ প্রজাদের ওপর অত্যাচার চালিয়েই এদের সমৃদ্ধি । নারীজাতির প্রতি সত্যচরণের বিশেষ সময় ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল । কুপ্তা , মঞ্চী , রাখালবাবুর বিধবা স্ত্রী বা ভানুমতীর সঙ্গে তার আচরণই এর প্রমাণ । ভানুমতীর প্রতি তার এক ধরনের দুর্বলতাও জন্মেছিল । এমন কি , ভানুমতীকে বিয়ে করে লবটুলিয়ায় থেকে যাওয়ার কথাও সে ভেবেছে । কিন্তু তা যে অসম্ভব তাও তার জানা ছিল । তাই নীরবে বেদনাবোধ করেই সে সরে গেছে । উপন্যাসের শেষে নিজের হাতেই জঙ্গলটা ধ্বংসের জন্য আদিম অরণ্যদেবতাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার মধ্য দিয়ে সত্যচরণ আধুনিক নগরসভ্যতার এক ট্যাজিক নায়ক হয়ে ওঠে । খ . রাজু পাঁড়ে সুপুরুষ , পঞ্চান্ন ছাপান্ন বছরের সুগঠিত দেহের ব্রাহ্মণ । সেলামি দেওয়ার ক্ষমতা তার ছিল না , তাই আষা বখরা বন্দোবস্তে স্টেটের কাছ থেকে সে কিছু জমি নিতে চায় । অর্থাৎ উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক সে খাজনা হিসেবে দেবে । রাজুকে সত্যচরণ একরকম বিনা খাজনাতেই দু বিঘে জমি দিয়েছিল । কিন্তু সে আসলে ভক্ত ও কবিমানুষ । চাষবাস তার ধাতে নেই । তাই দেড়বছরেও সে জঙ্গল পরিষ্কার করে উঠতে পারেনি । চীনা খাসের দানা খেয়েই দিন কাটিয়েছে । আবার সে প্রকৃতিপ্রেমিকও বটে । তাই জঙ্গল কাটতে তার মন চায় না । তার খালি মনে হয় যে , এখানে দেবতারা থাকেন , জঙ্গল গেলেই তাঁরাও চলে যাবেন । রাজু হিন্দি লেখাপড়া জানে , সংস্কৃত সামান্য জানে । টোলে পড়বার সময় অধ্যাপক কন্যার সঙ্গে তার প্রেম ও বিবাহ । এই রোম্যান্টিক রাজু আবার জড়িবুটি নিয়ে কবিরাজি চিকিৎসাও করে , ওষুধ দেয় ধারে । অনেক সময় পয়সা আদায়ও হয় না । তবে চিকিৎসক হিসাবে রাজু খারাপ ছিল না । গিরিধারালালের যা সে ভালো করে দিয়েছিল । বিনিময়ে কোনো পয়সা নেয়নি । তবে রাজুর পাণ্ডিত্যের গর্ব ছিল প্রচণ্ড । নিরক্ষর নিরীহ গাঙ্গোতা প্রজারা তার বিদ্যাবত্তায় মুগ্ধ । সে তাদের জানিয়ে দিয়েছে যে , আকাশের যেমন শেষ নেই , তেমনই পৃথিবীরও শেষ নেই । সূর্য ঘোরে না , পৃথিবী ঘোরে — সত্যচরণের এই বক্তব্য রাজু হেসে উড়িয়ে দেয় । কারণ , তার গভীর বিশ্বাস টে
[6:31 PM, 5/9/2022] Gourab Roy: সূর্যনারায়ণ উদয় পাহাড়ে উদিত হয়ে , পশ্চিমে সমুদ্রে অস্ত যায় । গাঙ্গোতারা তার কথাই বিশ্বাস করে । আসলে রাজু পাঁড়েই জঙ্গলের লোক , সত্যচরণ নয় । তাই গাঙ্গোতারা তার কথা বিশ্বাস করবে কেন ? গ . ধাতুরিয়া ধাতুরিয়ার মতো চরিত্র বিভূতিভূষণের মনেই আঁকা সম্ভব । ধাতুরিয়ার সঙ্গে সত্যচরণের প্রথম সাক্ষাৎ কাছারিতে । দক্ষিণ দেশে অজন্মা হওয়ায় অনেকেই নাচের দল নিয়ে বেড়িয়েছে । এরকম একটা দলের সঙ্গেই খাতুরিয়ার আগমন । অন্যদের নাচগান তেমন ভালো না লাগলেও ধাতুরিয়ার অনুষ্ঠান সকলেরই ভালো লেগেছিল । তখন তার বয়স বারো – তেরো , চেহারা যাত্রাদলের কৃষ্ণঠাকুরের মতো । ভারী শান্ত , সুন্দর চোখ – মুখ , কুচকুচে কালো গায়ের রং । শুধু পেটে দুটি খাবার জন্য এই বালক – নাচের দলের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে , পয়সার ভাগ সে বড়ো একটা পায় না । কিন্তু তার মধ্যে একটি শিল্পীমন লুকিয়েছিল । রাসবিহারী সিং – এর বাসায় দ্বিতীয়বার তার নাচ দেখার সময় সত্যচরণ বুঝতে পারে যে , ধাতুরিয়ার বয়সই কেবল বাড়েনি , নাচের দিক দিয়েও সে অনেক পরিণত । সত্যিকারের শিল্পীর নিষ্ঠা তার মধ্যে আছে । তাই ম্যানেজারের ঘোড়ার পিছু পিছু ছুটে এসে সে কাতরকণ্ঠে তাকে কলকাতায় নিয়ে যাবার জন্য আবেদন জানায় । অনেক কষ্ট করে সে ছক্করবাজি নাচটা শিখেছে , কিন্তু সমঝদারের অভাবে সে নাচ ধাতুরিয়া ভুলতে বসেছে । সে শুনেছে কলকাতায় নাকি নাচগানের বড়ো কদর । কিন্তু ধাতুরিয়ার আশা পূর্ণ হয়নি । শিল্পীকে কোনো বন্ধনে আবদ্ধ করা যায় না । তাই সত্যচরণ জমি দিয়ে তাকে লবটুলিয়ায় বসাতে চাইলেও সে রাজি হয় না । আবার শহরেও তার যাওয়া হল না । বি . এন . ডব্লিউ . লাইনের কাটারিয়া স্টেশনের ধারে তার মৃতদেহ পাওয়া যায় । হয় সেটা দুর্ঘটনা অথবা আত্মহত্যা , কিন্তু ধাতুরিয়ার মতো শিল্পী অরণ্য – পরিবেশের বাইরে টিকতে পারে না । তার পরিণতি রবীন্দ্রনাথের ‘ ছুটি ‘ গল্পের ফটিক চরিত্রের করুণ পরিণতির কথা মনে করিয়ে দেয় । ঘ . ভানুমতী ভানুমতী সাঁওতাল রাজ দোবরু পান্নার নাতির মেয়ে । রাজবংশের এই একটি মেয়ের সঙ্গেই পাঠকের পরিচয় হয়েছে । সত্যচরণও একে রাজকন্যা বলে অভিহিত করেছে । তার মধ্যে রাজকীয় আভিজাত্য এবং অতিথিপরায়ণতা রয়েছে । প্রথম দিন সত্যচরণ ও তার দলবলের আহার্যের সমস্ত জোগাড় – যস্তুর সেই করে দিয়েছিল । এই নিটোল স্বাস্থ্যবর্তী সুঠাম মেয়েটিকে প্রথম পর্বে সাধারণ সাঁওতাল কন্যা বলেই মনে হবে । সত্যচরণের তাই হয়েছিল । কিন্তু ক্রমশ সে যেন ইতিহাসের এক বিরাট ট্র্যাজেডির নায়িকা হয়ে ওঠে । সে যেন এক তরুণী অনার্য রাজকন্যা , একদা সমগ্র অরণাভূমি যে রাজবংশের অধীনে ছিল তাদেরই উত্তরাধিকারিণী পাশাপাশি তার মানবী সত্তাটিও উপন্যাসে প্রধান হয়ে উঠতে থাকে । সত্যচরণের প্রতি তার গোপন অনুরাগ মাঝে মাঝে প্রকাশিত হয়ে পড়ে । বিশেষ করে দোবরু পান্না মারা যাবার পর অসহায় ভানুমতী যেন সত্যচরণের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল , ‘ আপনি মাঝে মাঝে আসবেন বাবুর্জী , আমাদের দেখাশুনো করবেন — ভুলে যাবেন না বলুন । ‘ আবার কখনও সত্যচরণের হাত ধরে সে বলে বসে , ‘ আজ যেতে দেব না বাবুজী । ‘ সত্যচরণ অবশ্য তার এই জাতীয় আচরণের মধ্যে এক ধরনের বলিষ্ঠ আদিম সরলতা খুঁজে পেয়েছিল । হয়তো একথা ঠিক কিন্তু ভানুমতী যে তাকেও দুর্বল করে তুলেছিল উপন্যাসের অন্তত একজায়গায় তার প্রমাণ আছে , ‘ এখানেই যদি থাকিতে পারিতাম । ভানুমতীকে বিবাহ করিতাম । এই মাটির ঘরের জ্যোৎস্না – ওঠা দাওয়ায় সরলা বন্যবালা হাঁটিতে হাঁটিতে এমনি করিয়া ছেলেমানুষী গল্প করিত – আমি বসিয়া বসিয়া শুনিতাম । ‘ কিন্তু এসব কিছু হয়নি । সত্যচরণ কলকাতায় ফিরে এসেছে । ভানুমতীও দরিদ্র অরণ্য – জীবনেই থেকে গেছে।
সহায়ক গ্রন্থ:
1. Netaji Subhas Open University- Study Material (PGBG).
2. বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়- রচনাসমগ্র : ‘আরণ্যক’