প্রকৃতিপ্রীতি বিভূতিভূষণের রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্যমুগ্ধতার মধ্যেই এই মনোভাব সীমাবদ্ধ ছিল না। প্রকৃতির অন্তর্নিহিত রহস্যেরও তিনি আজন্ম সন্ধানী। তাঁর প্রকৃতিভাবনার সঙ্গে অনেকেই ওয়ার্ডসওয়ার্থ – এর দৃষ্টিভঙ্গির তুলনা করেছেন । ‘ পথের পাঁচালী ‘ – র অপুকে গড়ে তুলেছিল নিশ্চিন্দিপুর গ্রাম এবং ইছামতীর দুই তীরের অপরূপ প্রকৃতি । এক্ষেত্রে প্রকৃতির যেন শিক্ষকের ভূমিকা। ওয়ার্ডসওয়ার্থ – এর মনোভাবও ছিল তাই , Let nature be your teacher . তা ছাড়া ওয়ার্ডসওয়ার্থ – এর মতো বিভূতিভূষণও অনেক ক্ষেত্রেই অধ্যাত্মবাদী দৃষ্টিতে প্রকৃতিকে দেখতে চেয়েছেন । এই প্রকৃতি সবসময়ই সজীব ওয়ার্ডসওয়ার্থ – এর ‘ Prelude ‘ কিশোর নায়কের মনে হয়েছিল যে , there is a spirit in the woods . ‘ এই ‘ spirit ‘ বিভূতিভূষণের অনেক চরিত্রকেই গড়ে তুলেছিল। এই কারণেই তাঁর ‘ ইছামতী ‘ উপন্যাসের ভবানী বাঁড়ুয্যের মনে হয়েছিল , অমনি স্নেহময়ী মা আছে এই বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে লুকিয়ে , নইলে এই মা, এই স্নেহ এখানে থাকতো না।‘
‘কুশল পাহাড়ী গল্পের সাধুজিরও এই একই আধ্যাত্মিক উপলব্ধি ঘটেছিল।’ কবিই তিনি বটে। বাবা। এখানে বসে বসে দেখি । এই শালগাছটিতে ফুল ফোটে , বর্ষাকালে পাহাড়ে ময়ূর ডাকে , ঝর্ণা দিয়ে জল বয়ে যায় , তখন ভাবি , কবিই বটে তিনি ।… তাঁর এই কবিরূপ দেখে ধন্য হয়েছি । ‘ ‘ কুশল পাহাড়ী ‘ – র এই প্রাচীন সাধুর মতোই তাঁর স্রষ্টা বিভূতিভূষণ বিশ্বপ্রকৃতির সমস্ত সৌন্দর্য এবং বৈচিত্র্যের মধ্যে বিশ্বস্রষ্টার উপস্থিতি অনুভব করেছিলেন । আরণ্যক ‘ ও তার ব্যতিক্রম নয় । প্রকৃতির যথার্থ স্বরূপকে কীভাবে আত্মস্থ করা সম্ভব তা ‘ আরণ্যক ‘ উপন্যাসের অষ্টম পরিচ্ছেদের সূচনাতেই বিভূতিভূষণ জানিয়ে দেন, ‘ প্রকৃতি তাঁর নিজের ভক্তদের যা দেন , তা অতি অমূল্য দান । অনেক দিন ধরিয়া প্রকৃতির সেবা না করিলে কিন্তু সে গান মেলে না। আর কি ঈর্ষার স্বভাব প্রকৃতিবাণীর প্রকৃতিকে যখন চাহিব , তখন প্রকৃতিকে লইয়াই থাকিতে হইবে, অন্য কোন দিকে মন দিয়াছি যদি, অভিমানিনী কিছুতেই তাঁর অবগুণ্ঠন বুলিবেন না। এইভাবেই লবটুলিয়া বা ফুলকিয়া বইহারের প্রকৃতি সভাচরণের সামনে ধীরে ধীরে তার গোপন রহস্য ও সৌন্দর্যকে তুলে ধরেছিল।
মহলে প্রথম পা দেবার পর সত্যচরণের মনে অরণ্য সম্পর্কে ছিল প্রবল বিরূপতা, তাই প্রকৃতিও নিজেকে তার কাছে উন্মোচিত করেনি। কিন্তু ধীরে ধীরে প্রকৃতির সঙ্গে সত্যচরণের ব্যবধান যেন কেটে যায় , সে অনায়াসে তার অন্দরমহলে প্রবেশ করতে পারে। তখন তার রূপমুগ্ধ মনের অকুণ্ঠ স্বীকৃতি , গভীর 68 রাত্রে ঘরে বাহিরে একা আসিয়া দাঁড়াইয়া দেখিয়াছি, অন্ধকার প্রাপ্তরের অথবা ছায়াহীন ধু – ধু জ্যোৎস্লাভরা রাত্রির রূপ । তার সৌন্দর্যে পাগল হইতে হয় — একটুও বাড়াইয়া বলিতেছি না — আমার মনে হয় দুর্বলচিত্ত মানুষ যাহারা , তাহাদের পক্ষের সে – রূপ না দেখাই ভাল , সর্ব্বনাশা রূপ সে , সকলের পক্ষে তার টাল সামলানো বড় কঠিন । তবে একথাও ঠিক , প্রকৃতিকে সে রূপে দেখাও ভাগ্যের ব্যাপার। এমন বিজন বিশাল উন্মুক্ত অরণ্য – প্রান্তরে , শৈলমালা , বনঝাউ , আর কাশের বন কোথায় যেখানে – সেখানে । “
লক্ষণীয়, ওপরের বর্ণনায় কেবল প্রকৃতির স্নিগ্ধ মধুর রোম্যান্টিক রূপটিই চিত্রিত হয়নি, তার সর্বনাশী রূপটি’রও আভাস পাওয়া গেছে । প্রকৃতির ভয়ংকর – মূর্তিটির আর একটি চিত্র আঁকা হয়েছে প্রচণ্ড গ্রীষ্মের রুক্ষ রূপ বর্ণনায় , ‘ দুপুরে বাহিরে দাঁড়াইয়া তাম্রাভ অগ্নিবর্ষী আকাশ ও অর্ন্তগুদ্ধ বনঝাউ ও লম্বা ঘাসের বন দেখিতে ভয় করে চারি ধার যেন দাউ দাউ করিয়া জ্বলিতেছে মাঝে মাঝে আগুনের হল্কার মত তপ্ত বাতাস সর্বাঙ্গ ঝলসাইয়া বহিতেছে সূর্য্যের এ রূপ , দ্বিপ্রহরের রৌদ্রের এ ভয়ানক রুদ্র রূপ কখনও দেখি নাই , কল্পনাও করি নাই । ” আবার প্রকৃতির অপার্থিব রহস্যময় রূপটিও মাঝে মাঝে সত্যচরণের চোখে ধরা পড়ে যায় এইভাবে , ‘ চারি যারে চাহিয়া মনে হয় এ সে পৃথিবী নয় , এতদিন যাহাকে জানিতাম , এ স্বপ্নভূমি , এই দিগন্তব্যাপী জ্যোৎস্নায় অপার্থিব জীবেরা এখানে নামে গভীর বারে , তারা তপস্যার বস্তু , কল্পনা ও স্বপ্নের বস্তু । ” এই সব কিছু মিলিয়েই ‘ আরণ্যক ‘ উপন্যাসে বিভূতিভূষণের প্রকৃতিচেতনার একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ গড়ে ওঠে।
কখনও অধ্যাত্মবাদীর দৃষ্টিতে , কখনও রোম্যান্টিকের দৃষ্টিতে আবার কখনও বস্তুবাদীর দৃষ্টিতে তিনি প্রকৃতিকে দেখেন এবং তাকে সেভাবেই চিত্রিত করেন । রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে প্রকৃতির বিপুলতা ও রহস্যকে চেনবার ক্ষমতা আয়ত্ত করেছিলেন বিভূতিভূষণ— এটি তাঁর নিজের স্বীকৃতি । আবার ‘ বিশ্বমানবের সঙ্গে বিশ্বপ্রকৃতির যোগসূত্রটি আবিষ্কারের অন্তর্দৃষ্টিও তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকেই পান। (‘বিচিত্রা’ আশ্বিন, ১৩৩৮, ‘রবীন্দ্রনাথের দান’)
রবীন্দ্রনাথের ‘ ক্ষণিকা ‘ ছিল বিভূতিভূষণের অন্যতম প্রিয় গ্রন্থ । আমি ‘ ক্ষণিকা ‘ – র বড় ভক্ত । সে – কথায় রাত হয়ে গেল অনেক , কারণ ‘ ক্ষণিকা ‘ – র কথা একবার উঠলে আমি স্থির থাকতে পারি না।'(‘অপ্রকাশিত দিনলিপি’ ১১ আগস্ট ১৯৩৩। পুঃ ১২৮ ) মনে হয়। ‘ক্ষণিকা’র কোনো কোনো কবিতার মধ্যে লেখক তাঁর জীবনদর্শনের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেয়েছিলেন । তিনিও যেন অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে বলতে পারতেন, ” যখন যা পাস মিটায়ে নে আশ, ফুরাইলে দিস ফুরাতে । ‘(‘উদ্বোধন’, ‘ক্ষণিকা’) তাই একই সঙ্গে প্রকৃতির তুচ্ছতম রূপটিরও যেমন তিনি ভক্ত , ডেমনি আবার প্রকৃতির বিপুল ও গভীর রহস্যেরও তিনি উপাসক । বিশ্বপ্রকৃতির অন্তরালে বিশ্বস্রষ্টার গূঢ় উপস্থিতির কথা তাই তাঁর বারে বারে মনে হয়। ফুলকিয়া বইহারের জ্যোৎস্নারাত্রির অপরূপ সৌন্দর্যলোক সম্পর্কে ভাই তাঁর অনুভূতি, অমন মুক্ত আকাশ, অমন নিস্তব্ধতা, অমন নির্জনতা, অমন দিগ্দিগন্ত বিসর্পিত বনানীর মধ্যেই শুধু অমনতর রূপলোক ফুটিয়া ওঠে । জীবনে একবারও সে জ্যোৎস্নারাত্রি দেখা উচিত, যে না দেখিয়াছে ভগবানের সৃষ্টির একটি অপূর্ব রূপ তাহার নিকট চির অপরিচিত রহিয়া গেল ।
‘একদিকে ঈশ্বরসৃষ্ট এই রূপলোক , অপরদিকে এই রূপলোকের অন্তরালের অধিবাসী কিছু মানুষ— এই দুইয়ের মিলিত রূপই বিভূতিভূষণের প্রকৃতিচেতনায় প্রতিকলিত । কিছু চরিত্র এই উপন্যাসে আছে যারা প্রকৃতিরই সন্তান। রাজা গোবরু পান্না ও তার পরিবারের মানুষদের অস্তিত্ব অরণ্য- মহালের বাইরে কল্পনাও করা যায় না। তেমনই কল্পনা করা যায় না যুগলপ্রসাদ বা বালক নৃত্যশিল্পী ধাতুরিয়াকেও। লক্ষণীয় শহরের দিকে পা বাড়াতে গিয়েই বাডুবিয়াকে প্রাণ দিতে হয়েছে। ‘ছুটি’ গল্পের ফটিকের কথা এই প্রসঙ্গে মনে পড়বে। সত্যচরণ অরণ্যে ছিল বহিরাগত, তাই যতই এর প্রতি সে আকৃষ্টবোধ করুক এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস তার পক্ষে সম্ভব ছিল না , কিন্তু প্রকৃতির সন্তান যুগলপ্রসাদেরা এখানেই থেকে যাবে। নগরসভ্যতার প্রতিনিধি সভাচরণেরা নিজেদের জীবন ও জীবিকার স্বার্থে অরণ্যকে ধ্বংস করে । কিন্তু যুগলপ্রসাদেরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অরণাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে। এদের প্রকৃতিপ্রেম নিঃস্বার্থ সত্যচরণের ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে প্রকৃতিপ্রেমিক বিভূতিভূষণ এই সত্যটিই প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
সহায়ক গ্রন্থ:
1. Netaji Subhas Open University- Study Material (PGBG).
2. বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়- রচনাসমগ্র : ‘আরণ্যক’