বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৩৮ সালের ২৬ জুন পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত কাঁঠালপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ইংরেজি ও ফারসি ভাষায় দক্ষ যাদবচন্দ্র ১৮৫৮ সালে মেদিনীপুরে ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ভবানীচরণ বিদ্যাভূষণ তাঁর মাতামহ। তিনি ছিলেন স্বনামধন্য পণ্ডিত। পাঁচ বছর বয়সে কুলপুরোহিত বিশ্বম্ভর ভট্টাচার্যের কাছে পড়াশোনায় বঙ্কিমচন্দ্রের হাতেখড়ি হয়। তাঁর পিতা যখন ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে মেদিনীপুরে বসবাস শুরু করেন তখন তিনি সেখানকার একটি ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ঐ স্কুলের কৃতি ছাত্র হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। বঙ্কিমচন্দ্রের মেধা ও ফলাফলে সন্তুষ্ট হয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাঁকে ডবল প্রমোশন দিতে চাইলেও পিতার আপত্তিতে তা হয়নি।
তৎকালীন হিন্দুসমাজে বাল্যবিবাহের প্রচলন ছিল। বঙ্কিমচন্দ্রকেও ১৮৪৯ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে পাঁচ বছর বয়সের এক বালিকার সঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। এ সময়ে তিনি কাঁঠালপাড়া গ্রামের হলধর ন্যায়বাগীশ ও শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের কাছে সংস্কৃত সাহিত্য এবং বাংলা কবিতা সম্পর্কে শিক্ষাগ্রহণ করেন। এগার বছর বয়সে বঙ্কিমচন্দ্র হুগলি কলেজের স্কুল শাখায় ভর্তি হন এবং ১৮৫৬ সালের ১২ জুলাই পর্যন্ত এখানে পড়াশোনা করেন। পরীক্ষায় অসাধারণ কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্যে তিনি প্রথমবার ৮ টাকা এবং দ্বিতীয়বার ২০ টাকা মাসিক বৃত্তি লাভ করেন। ১৮৫৬ সালের ১২ জুলাইর পর বঙ্কিমচন্দ্র আইন বিষয়ে পড়াশোনার জন্যে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এন্ট্রাস পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৮৫৮ সালে বিএল পরীক্ষা দিয়ে ১৩ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে যে দুজন দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন তার মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র একজন। সে বছরই বঙ্কিমচন্দ্র ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর পদে চাকরিতে নিয়োগ লাভ করেন।
১৮৫৯ সালে তাঁর প্রথম স্ত্রীর আকস্মিক মৃত্যু ঘটলে ১৮৬০ সালে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম রাজলক্ষ্মী দেবী। তিনিই ছিলেন তাঁর জীবনের আনন্দ-বেদনার সাথী। বঙ্কিমচন্দ্র দীর্ঘ তেতত্রিশ বছর একই পদে চাকরি করে ১৮৯১ সালে অবসর গ্রহণ করেন। কর্মক্ষেত্রে একজন ন্যায়বান প্রশাসক হিসেবে তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ১৮৯৪ সালের ৮ ই এপ্রিল তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যসাধনা: কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত সংবাদ প্রভাকর’-এ কিছু গদ্য এবং পদ্য রচনা দিয়েই বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যসাধনায় হাতে খড়ি। ১৮৬৪ সালে তিনি ‘Rajmohan’s Wife’ নামে ইংরেজিতে একটি উপন্যাস লেখেন। প্রকৃতপক্ষে তার সাহিত্যজীবন শুরু হয় ১৮৬৫ সালে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাস প্রকাশের মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় উপন্যাসে কপালকুণ্ডলা’ প্রকাশিত হয় ১৮৬৬ সালে। তিন বছর পরে প্রকাশিত হয় তৃতীয় উপন্যাস ‘মৃণালিনী’। এরপর তাঁর উপন্যাস রচনায় সাময়িক বিরতি দেখা যায়।
বঙ্কিমচন্দ্রের নিজের তাে বটেই, বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রেও ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৭২ সালে এই পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং প্রথম চার বছর সম্পাদনা করেন। এর মধ্যে অবশ্য তিনি বেশ কিছু ইংরেজি প্রবন্ধ রচনা করেন। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা প্রকাশের পর বঙ্কিমচন্দ্রের প্রধান রচনাগুলি এখানেই প্রকাশিত হয়, পরে তা বই হিসাবে বের হয়। এখানে পর পর যে উপন্যাসগুলি তাঁর প্রকাশিত হয় সেগুলি হল—“বিষবৃক্ষ’, ইন্দিরা’, ‘যুগলাঙ্গুরীয়’, পশ্চিবহিনী সমস্ত নদী নিঝরিণী অকস্মাৎ ‘চন্দ্রশেখর’, ‘রাধারাণী’, ‘রজনী’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘রাজসিংহ’, ‘আনন্দমঠ’, ‘দেবী চৌধুরানী’ এবং ‘সীতারাম’। এদের মধ্যে ইন্দিরা’, ‘যুগলাঙ্গুরীয়’ এবং রাধারাণীকে ছােট উপন্যাস বা খণ্ডোপন্যাস বলাই ভালাে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, বঙ্কিমচন্দ্র পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস রচনা করেছেন মােট এগারােটি এবং খণ্ডোপন্যাস লিখেছেন তিনটি।
উপন্যাস ছাড়া উল্লেখযােগ্য প্রবন্ধও বঙ্কিমচন্দ্র অনেক লিখেছেন। সেগুলির কথাও আপনাদের জেনে রাখা দরকার। ছােট আকারের বেশির ভাগ প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে দুখণ্ড ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ গ্রন্থে। এ ছাড়াও তার প্রবন্ধের কিছু বই—‘বিজ্ঞানরহস্য’, ‘সাম্য’, ‘কৃষ্ণচরিত্র’, ‘ধর্মতত্ত্ব এবং শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা’। গল্পের মত করে লেখা তাঁর তিনটি বিচিত্র ধরনের প্রবন্ধ গ্রন্থ—“লােকরহস্য’, ‘কমলাকান্তের দপ্তর এবং মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত্র।