বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের একমাত্র নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন চর্যাপদ। চর্যাপদের প্রায় সমসাময়িক বাংলাদেশের যেসব সংস্কৃত-প্রাকৃত-অপভ্রংশ সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছিল সেগুলো প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের প্রত্যক্ষ উপকরণ নয়। কিন্তু চর্যাপদ আবিষ্কারের মাধ্যমে বাংলা ভাষার আদি স্তরের লক্ষণ সম্পর্কে অবহিত হওয়া সম্ভব হয়েছে। চর্যাপদের মাধ্যমে প্রাচীন বাঙালির জীবন ও সাধনা সম্বন্ধে অনেক রহস্যের সমাধান ঘটেছে। তাই বলা যায়, চর্যাপদ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আদি নিদর্শন।
চর্যাপদের ভাষা ও ভাষা বিতর্কের সমাধান: চর্যাপদের ভাষাকে সান্ধ্যভাষা বলা হয়। চর্যাপদগুলো সান্ধ্যভাষায় রচিত। যে ভাষা সুনির্দিষ্ট রূপ পায়নি, যে ভাষার অর্থও একাধিক অর্থ্যাৎ আলো আধারের মতো, সে ভাষাকে পন্ডিতগণ সান্ধ্য ভাষা বলেছেন।
কারও মতে ‘সন্ধ্যাদেশ’ নামে বিশেষ অঞ্চলের ভাষার সঙ্গে চর্যাপদের ভাষার মিল আছে বলে এ নাম হয়েছে।
বাংলা ভাষার উদ্ভব যুগের এক প্রকার দ্ব্যর্থক শব্দযুক্ত ভাষা ব্যবহৃত হয় চর্যাপদে। এর ভাষা হেঁয়ালিপূৰ্ণ, কিছুটা স্পষ্ট, কিছুটা অস্পষ্ট। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এর ভাষাকে বলেছেন ‘সান্ধ্যা ভাষা’ সুকুমার সেনের মতে ‘সন্ধ্যা’ শব্দটিতে প্রকটভাবে রয়েছে ধ্যৈ বা ‘ধা’ ধাতুর অর্থ। যে ভাষায় অভীষ্ট অর্থ বুঝতে হয় অনুধাবনের মাধ্যমে বা মর্মজ্ঞ হয়ে অথবা যে ভাষায় ভাবার্থ বিশেষভাবে গুপ্ত [সম্+ধা] তা- ই সান্ধ্যা ভাষা। বস্তুত পদগুলোর রচয়িতাগণ ছিলেন বৌদ্ধ সাধক। তাঁরা সাধনা করতেন গোপন তত্ত্বের। আসলে তন্ত্রের সাধনা ছিল অনেকাংশে গূঢ় বা গোপন। এ সাধনা যাতে সাধারণ লোকের হাতে পড়ে বিকৃত না হতে পারে সেজন্য সান্ধ্যভাষার ব্যবহার হতো। চর্যাপদে এ উদ্দেশ্যে পারিভাষিক শব্দের প্রয়োগ হয়েছে। চর্যার অনেক বর্ণনা আক্ষরিকভাবে এক অর্থ, আবার যোগসাধনার দিক থেকে ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে।
চর্যাপদ যেই সময়ে রচিত হয়েছিল সেই সময়ে বাংলা ভাষা তার পুরো রূপ লাভ করেনি। চর্যাপদের ভাষা প্রাচীন বাংলা বলে তখনকার ভাষার প্রাচীনত্বের দরুন গৌড় অপভ্রংশের প্রভাব এতে রয়ে গেছে। ফলে কেউ কেউ অপভ্রংশ, প্রাচীন হিন্দি, মৈথিলি, উড়িয়া বা আসামি ভাষা বলে দাবি করেন। একই গোষ্ঠিজাত বলে এসব নব্য ভারতীয় আর্যভাষার সঙ্গে চর্চাপদের ভাষার মিল আছে। ফলে চর্যাপদ নিয়ে এই ভাষা বিতর্ক।