অজান্তে গল্পে রূপলাভ করেছে আমাদের সমাজের আত্মকেন্দ্রিক ভালােবাসার এক নির্মম রূপ — যে ভালােবাসা বস্তুু কেন্দ্রিকতার আবরণে মানবিক বােধ সমূহকে আচ্ছন্ন করে, মানুষ যার জন্য যথার্থই অমানুষে পরিণত হয়, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। গল্পের নায়ক যেখানে তাঁর স্ত্রীর একখণ্ড ‘বডিস অর্থাৎ অন্তর্বাস নিয়ে বিপর্যস্ত বর্ষার দিনে মােহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে বাড়ি গিয়ে কতক্ষণে পৌছবেন আর প্রেম নিবেদন করবেন তার স্ত্রীকে। যার জন্য অন্ধকার গলিতে অন্ধ ভিখারীকে না জেনে-শুনে লাথি মারতে ও অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে তার বাধে না।
গল্পটি এরকম – গল্পের নায়ক অফিসে মাইনে পেয়েছেন, তাই বাড়ি ফেরার পথে ভাবলেন, “ওর জন্যে একটা বডিস্ কিনে নিয়ে যাই। বেচারী অনেক দিন থেকেই বলছে। এ দোকান সে দোকান খুঁজে জামা কিনতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল।” জামাটি কিনে বেরিয়েছেন, অমনি বৃষ্টি আরম্ভ হল। তাই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। বৃষ্টি একটু থামাতে জামাটি বগলে করে ছাতাটি মাথায় দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। বড় রাস্তা পেরিয়ে এলেন, তারপর এক অন্ধকার গলিতে গলিতে ঢুকে অন্যমনস্ক হয়ে ভাবতে ভাবতে চলেছেন, সে কত ভাবনা! মনের রঙিন নেশায় যখন ডুবে হেঁটে চলেছেন ‘এমন সময় হঠাৎ একটা লােক ঘাড়ে এসে পড়ল’ বক্তার। সেও পড়ে গেল, গল্পের নায়কও পড়ে গিয়ে কাদায় মাখামাখি হয়ে গেল জামাটি। গল্পের নায়ক উঠে দাঁড়ালেন, কিন্তু লােকটা তখনও ওঠেনি — উঠবার উপক্রম করছে। রাগে গল্পের নায়কের সর্বাঙ্গ যেন জ্বলে উঠল। সে লােকটিকে এক লাথি মেরে বসলেন আর বললেন – “রাস্তা দেখে চলতে পার না শুয়ার?” “মারের চোটে সে আবার পড়ে গেল, কিন্তু কোনও জবাব করলে না।”
এতে গল্পের নায়কের ‘আরও রাগ হল’ এবং আরাে মারতে লাগলেন লােকটিকে। “গোলমাল শুনে পাশের বাড়ির এক দুয়ার খুলে গেল। লণ্ঠন হাতে এক ভদ্রলােক বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন – “ব্যাপার কি মশাই?” গল্পের নায়ক তখন বললেন- “দেখুন দিকি মশাই – রাস্কেলটা আমার এত টাকার জামাটা মাটি করে দিলে। কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে একেবারে। পথ চলতে জানে না, ঘাড়ে এসে পড়ল ” তার পর সেই আগন্তুক ভদ্রলােক গষ্পের নায়ককে বললেন – “কে – ও? ওঃ থাক মশাই, মাপ করুন, ওকে আর মারবেন না। ও বেচারা অন্ধ বােবা ভিখারী, এই গলিতেই থাকে — ” তার পর গল্পের নায়ক দেখলেন “মারের চোটে সে বেচারা কাপছে – গা-ময় কাদা” আর গল্পের নায়কের দিকে কাতর মুখে অন্ধ দৃষ্টি তুলে হাত দুটি জোড় করে আছে।”
গল্পের বেচারা অন্ধ বােবা ভিখারী’র কাতরমুখে অন্ধ দৃষ্টি তুলে হাত দু’টি জেড়ি করে গল্পের নায়ককে আর না মারার যে প্রার্থনা করেছে তাতে গল্পের নায়কের মতাে আমরাও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। গল্পের নায়ক অন্ধ ভিখারীটিকে যে মুহূর্তে লাথি মেরেছে তা যে কোন স্বপ্নাচ্ছন্ন ব্যক্তির পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু অন্ধ দেহ, সর্বস্ব ভালােবাসার টানে সে যে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, আত্মকেন্দ্রিক ঠুনকো ভালােবাসার সেই রূপ চিত্ৰণ আমাদের ভাবিয়ে তােলে। বাস্তব পরিস্থিতির প্রতি দৃষ্টিপাত করার সহনশীলতা যে ভালবাসার থাকে না, তা নিতান্তই এক বাতিকগ্রস্থ বিভ্রান্তিকর মানসিকতাজাত, ব্যর্থতাই যার চূড়ান্ত পরিণাম। মানবিক মূল্যবােধের এই চরম অবক্ষয় বনফুলকেও চঞ্চল করে তুলেছিল, এই আত্মসুখ পরায়ণ ভালােবাসার, না স্বার্থপরতার আর এক নামান্তর, তার চরম পরিণাম কি? এ প্রশ্ন বারবার বনফুলের মনে জেগেছিল। যার এক নেতিবাদী উত্তরই খুঁজে পেয়েছিলেন বনফুল। বিমূঢ় বিভ্রান্ত যুগের আত্মসর্বস্ব তথা আত্মক্ষয়কারী। ভালােবাসার রূঢ় বাস্তব চিত্রণ আর কি হতে পারে?
বনফুলের ছােটগল্প উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ.ডি. (বাংলা) উপাধির জন্য প্রদত্ত গবেষণা অভিসন্দর্ভ
গবেষক: সুবল কান্তি চৌধুরী
তত্ত্বাবধায়ক: ড. নিখিল চন্দ্র রায় বাংলা বিভাগ, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
১. বাংলা ছােটগল্প’ – শিশির কুমার দাস।
২. ‘বনফুলের ছােটগল্প সমগ্র’ – চিরন্তন মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত।
৩. ‘বনফুলের ফুলবন’ – ড. সুকুমার সেন।সাহিত্যলােক।
৪. ‘বনফুলের উপন্যাসে পাখসাট শােনা যায় প্রবন্ধ—মনােজ চাকলাদার।
৫. ‘পশ্চাৎপট – বনফুল (১৬ – তম খণ্ড)।