“বুধনী” গল্পে রূপায়িত হয়েছে প্রেমের এক বিকৃত রূপ, যা জীবনের এক বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রকটিত হয়েছে। আপাত ভালাে মানুষের অন্তরালে এক বন্য মানুষের আত্মপ্রকাশ। মানুষ আর পশুতে পার্থক্য বিচার বুদ্ধিতে, চেতনায়, সংস্কৃতিতে, উন্নততর জীবনভাবনায়, নিঃস্বার্থ প্রেম প্রীতিতে। কিন্তু জৈব প্রবৃত্তিতে মানুষ আর পশুতে কোন প্রভেদ নেই। ’বুধনী’ গল্পে বর্বর জীবনের এক বিচিত্র প্রণয়লীলা রূপায়িত হয়েছে, যা জৈবপ্রবৃত্তি তাড়িত।
গল্পটি সংক্ষেপে এরকম হাজারীবাগের পার্বত্য প্রদেশের অধিবাসী সাঁওতাল বিন্দু ভালােবেসে বিয়ে করেছিল ‘নিকষ কালাে কৃশাঙ্গী কিশােরী বুধনীকে। অবশ্য তার জন্য কঠিন জীবন সংগ্রামের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয় বিন্দুকে। প্রাণ সংশয় করে জিতে নিতে হয় বুধনীকে। সহজ স্বাভাবিক ছন্দে তাদের বিবাহিত জীবন অতিবাহিত হচ্ছিল। সেখানে পরস্পর পরস্পরের প্রতি ভালােবাসার কোন কমতি ছিল না। “বিবাহের পর বিন্দু বুধনিকে একদণ্ড ছাড়ে নাই। এক দণ্ডও নয়। বনে, জঙ্গলে, পর্বতে, গুহায় এই বর্বর দম্পতি অর্ধনগ্ন দেহে অবিচ্ছিন্নভাবে বিচরণ করিয়া বেড়াইতাে।”
“কিন্তু সহসা একটা বিপর্যয় ঘটিয়া গেল। বুধনী এক সন্তান প্রসব করিল। অসহায় ক্ষুদ্র এক মানব শিশু। বুধনীর সে কি আনন্দ! বর্বর জননীরও মাতৃত্ব আছে, তাহারও অন্তরের লিঙ্গ স্নেহময়ী জননীর কল্যাণী মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করে। নারীত্বের ধাপে পা রাখিয়া বুধনী মাতৃত্বলােকে উত্তীর্ণ হইয়া গেল। বিন্দু দেখিল— একি! বুধনীকে দখল করিয়া বসিয়াছে শিশুটা!’ বুধনীতে তাহার আর একার নাই। অসহ্য!” এর পরেই বিন্দু হত্যা করে শিশুটিকে, যার জন্য তার ফাঁসির আদেশ হয়। কিন্তু “সে মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত চিৎকার করিয়া গেল— বুধনী, বুধনী, বুধনী! ভগবানের নামটা পর্যন্ত করিল না।”
সাধারণ সভ্য সমাজের দৃষ্টিতে বিন্দুর এই আচরণ কিন্তু অস্বাভাবিক, বিকৃত মস্তিষ্কজাত মনে হতে পারে, কিন্তু বিন্দুর প্রেমের মহত্ব সেখানেই প্রতিষ্ঠিত। সাধারণের চোখে বিন্দু খুনী বলে মনে হলেও প্রেম নিষ্ঠায় সে এক অপরাজেয় সত্তা। তাই সে বুধনীর মাঝখানে দ্বিতীয় কাউকে সহ্য করতে পারেনি। এমনকি তার নিজের সন্তানকেও না। ভালােবাসার গভীরতা কখনাে কখনাে অসহিষ্ণু অধিকার বােধে পরিণত হয়। বিন্দুর ভালােবাসা সেই গােত্রের। অধিকার স্পৃহার নিমর্ম উন্মত্ততায় বুধনীকে একান্ত নিজের করে ধরে রাখতে চায় বিন্দু। তাই সেই অপ্রতিরােধ্য একরৈখিক প্রেমের মধ্যে অন্য কেউ এসে স্থান দখল করে বসুক, তা বিন্দু মেনে নিতে পারেনি। তাই হিতাহিত জ্ঞানশুন্য হয়ে সে নিজের সন্তানকে বিনা দ্বিধায় হত্যা করে বসে। এতে তার কোন আত্ম-অনুশােচনা নেই, গ্লানি নেই, অন্যায় বােধ নেই, পাপ-পুণ্য বােধ নেই। কারণ তার কাছে বুধনী ছাড়া আর সবকিছু তুচ্ছ। প্রাণ সংশয় বাড়িতে জিতে সে বুধনীকে পেয়েছে।
সে বুঝেছে যতদিন ঐ শিশু বুধনীর কোল জুড়ে থাকবে, ততদিন বুধনীকে ফিরে পাবার আশা তার নেই। তাই আত্মজনকে হত্যা করতেও এতটুকু মনে বাধে নি তার। এ মানসিকতা সভ্য সমাজে পাগলামি বলে বিবেচিত হতে পারে, কিন্তু জঙ্গলের এই- ই নিয়ম। জংলী বিন্দু সেই নিয়মকে অনুসরণ করেছে মাত্র। ফাঁসির পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বিন্দু শুধু বুধনী বুধনী বলে চিৎকার করে গেছে। আসলে “নারী ও পুরুষের পারস্পরিক আকর্ষণ যুগ, সমাজ, সময় ভেদে এক ও অবিচ্ছিন্ন। কিশােরী বুধনীকে দেখে ধনুকধারী বিল্টর কামনা ও তাকে ছাড়া করার পেছনে নিকৃষ্ট ধরনের আদিরস ও অশ্লীলতা ফুটে উঠলেও বিশ্বজনীন প্রেম কথার এটাই মূল কাঠামাে। সভ্য সমাজে উপকরণ ও পদ্ধতির প্রভেদ আছে কিন্তু মৌল আবেদনের কোন প্রকার নেই। নিষ্ঠুর নিয়তি সভ্যতার হাত ধরে বিন্টুর চিৎকার স্তব্ধ করে দিলেও সহৃদয় পাঠক আজও যেন দেখতে পান তীব্র হাহাকার, শুনতে পান বিন্দুর করুণ আর্তনাদ।
বনফুলের ছােটগল্প উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ.ডি. (বাংলা) উপাধির জন্য প্রদত্ত গবেষণা অভিসন্দর্ভ
গবেষক: সুবল কান্তি চৌধুরী
তত্ত্বাবধায়ক: ড. নিখিল চন্দ্র রায় বাংলা বিভাগ, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
১. বাংলা ছােটগল্প’ – শিশির কুমার দাস।
২. ‘বনফুলের ছােটগল্প সমগ্র’ – চিরন্তন মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত।
৩. ‘বনফুলের ফুলবন’ – ড. সুকুমার সেন।সাহিত্যলােক।
৪. ‘বনফুলের উপন্যাসে পাখসাট শােনা যায় প্রবন্ধ—মনােজ চাকলাদার।
৫. ‘পশ্চাৎপট – বনফুল (১৬ – তম খণ্ড)।