বনফুল সুস্থ -শুদ্ধ জীবন প্রত্যয়বাণী শিল্পী। তাই জটিল সংগ্রামের আবর্তে মানুষের জীবন যখন হাঁসফাস করছিল, সেই পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে এক আদর্শ জীবনবােধকে অন্বেষণ। করেছেন তার গল্পে। তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ আদর্শ জীবনবােধের সঙ্গে রূঢ় বাস্তবের সংঘাত সৃষ্টি হলেও তাই শেষ পর্যন্ত তার প্রত্যয়বাদী শুদ্ধ আদর্শ জীবনবােধকেই শেষ পর্যন্ত জয়ী করেছেন। সমকালীন বৈনাশিকতার কাছে তাঁর শিল্পীমন কখনাে পরাজয় স্বীকার করেনি, আত্মসমর্পণ করেনি। বনফুলে সেই সুস্থ বলিষ্ঠ জীবন বােধের এক শিল্পীত রূপলাভ করেছে “খুড়ো” গল্পে।
‘খুড়াে’ গল্পের কাহিনীটি সংক্ষেপে এরকম- নানা সদগুণের অধিকারী খুড়াের সংসারে নিত্য অভাব অনটন। কারণ নবাব গঞ্জের জমিদার বাবু যতদিন বেঁচেছিল ততদিন তার নানা সদগুণের জন্য তাঁকে যথেষ্ট খাতির করতেন। জমিদার প্রদত্ত পাঁচবিঘা লাখেরাজ জমি চাষ করে খুড়াের গ্রাসাচ্ছাদন চলত, এমনকি অন্যান্য অভাবও মিটত। কিন্তু জমিদার বাবুর মৃত্যু হওয়ায় তার আধুনিক পুত্রের এ জাতীয় বাজে খরচ পছন্দ না হওয়ায় আত্মসম্মানী খুড়াে জমিদার বাড়ি যাতায়াত বন্ধ করে দিল। অভাব তার সংসারে এখনাে নিত্যসঙ্গী। শত অভাবের মধ্যেও খুড়াের মধ্যে এমনকি একটি ছেলেমানুষি স্বভাব ছিল, যার জন্য বৃদ্ধ খুড়া গ্রামের সকলেরই প্রিয় ছিল। সংসারে সীমাহীন অভাব সত্ত্বেও খুড়াের মনে কখনাে প্রফুল্লতার অভাব ঘটেনি। মুখে এক টুকরাে অদ্ভুত হাসি নিয়ে সে ঘুড়িমার সমস্ত সাংসারিক অভিযোগকে অদ্ভুত উদাসীনতায় উড়িয়ে দিত। সংসারের অভাব মেটানাের চেয়ে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ‘মহা উৎসাহে’ গুলি খেলতে খুড়োর বেশী আনন্দ। ঘরে একখানা ভাল লেপ-তােষক নেই সে সামনের শীত কাটবে। তিন বছর যাবৎ বলতে বললে। লেপ-তােষক সম্বন্ধে ঔদাসীন্য ঘুচাইতে পারেন নাই খুড়িমা। খুড়িমার তীব্র ভর্ৎসনা, অভিযােগ-অনুযোেগ শােনার পর পড়ার কিছু হিতেষী ছেলে কুড়ি টাকা চাঁদা তুলে খুড়ােকে শহরে পাঠালেন লেপ-তােষক কিনে আনার জন্য। কিন্তু শহর থেকে খুড়ে ফিরে আসার পর গল্পকথক ভাবলেন কিরকম লেপ-তােষক কিনেছে তা দেখে আসা যাক।
বাড়ির কাছাকাছি যেতেই গল্পকথক শুনতে পেলেন, ‘খুড়িমা তারস্বরে চিৎকার করিতেছেন। আগ্রহ সহকারে গল্পকথক খুড়াের বাড়ির দিকে এগােলেন। বাড়িতে ঢুকিতেই খুড়াে হাসিয়া বলিলেন—দেখ তাে ভাই জিনিসটা ভালাে হয় নি? আঠারাে টাকায় এমন জিনিস কি পাওয়া যায়, দেখিখুড়াে সেতার হাতে বসিয়া আছেন।” | এই খুড়াে আসলে আনন্দবাদী জীবনশিল্পী। যিনি হাজারাে অভাব অনটনের মধ্যে মনের সহজ সুন্দর বৃত্তিগুলিকে মেরে ফেলেননি। খুড়াে চরিত্রের এই জীবন পিপাসা যেন বনফুলেরই অন্তসত্তার একখণ্ড প্রকাশ। আসলে খুড়াে সৌন্দৰ্য্য সন্ধানী! ‘তাই রূঢ় বাস্তব জীবনের আবর্তে পরে খুড়ে যেখানে লেপ-তােষক বানাতে পারছে না তিন বছর ধরে, পাড়ার হিতৈষীরা লেপতােষক বানানাের জন্য টাকা যােগাড় করে দিলেও সেই টাকায় সে কিনে আনে একটি সেতার। যে সেতারের সুরে জীবনের হাজারাে অভাবের কথা অনায়াসে ভুলে থাকা যায়, এক সুন্দর অনুভূতির জগতে পাড়ি দেওয়া যায়। খুড়াে আসলে সেই সুস্থ, শুদ্ধ, সুন্দর জীবন-সন্ধানী শিল্পীমানুষ।
বনফুলের ছােটগল্প উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ.ডি. (বাংলা) উপাধির জন্য প্রদত্ত গবেষণা অভিসন্দর্ভ
গবেষক: সুবল কান্তি চৌধুরী
তত্ত্বাবধায়ক: ড. নিখিল চন্দ্র রায় বাংলা বিভাগ, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
১. বাংলা ছােটগল্প’ – শিশির কুমার দাস।
২. ‘বনফুলের ছােটগল্প সমগ্র’ – চিরন্তন মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত।
৩. ‘বনফুলের ফুলবন’ – ড. সুকুমার সেন।সাহিত্যলােক।
৪. ‘বনফুলের উপন্যাসে পাখসাট শােনা যায় প্রবন্ধ—মনােজ চাকলাদার।
৫. ‘পশ্চাৎপট – বনফুল (১৬ – তম খণ্ড)।