সমাজের চরম অত্যাচারের যুগেও মানুষের চরিত্রের সনাতন মূল্যবােধের উদ্বোধনে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন বনফুল। তাই সর্বনাশা সামাজিক ভাঙন ও মানবিক মূল্যবােধের অবক্ষয়ের যুগে। এক সমাজ-সন্ধানী মানবিক বােধের উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটিয়েছেন “দুধের দাম” গল্পে।যখন মধ্যবিত্ত সমাজ তার মূল্যবােধ হারিয়ে ফেলছে, হয়ে উঠছে ক্রমশ অমানবিক, সেই অবক্ষয়ী মূল্যবােধের যুগেও মানুষের মধ্যে যে মানবিক অনুভূতি একেবারে নিঃশেষিত হয়ে যায়নি তার এক আশ্চর্যরূপ। ফুটে উঠেছে “দুধের দাম” গল্পে।
গল্পটির কেন্দ্রে আছেন এক বৃদ্ধা, যার কপালে সারাক্ষণ অবহেলা, অপমান, ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ,ঘৃণা জুটেছে। কিন্তু সেই বৃদ্ধাই অনন্যসাধারণ হয়ে উঠেছেন শেষে। যিনি উপকারের মূল্যস্বরূপ রেলের এক কুলিকে দুধ খাওয়ার জন্য দু’টি টাকা দিয়েছেন ছেলে সম্বোধন করে। তখন সেই দু’টাকার অর্থমূল্য এক দু’টাকার সীমা ছাড়িয়ে বহুমূল্যবান জীবনদ্যোতনা নিয়ে আসে।
গল্পটি সংক্ষেপে এরকম—ট্রেনে ওঠার হুড়ােহুড়িতে এক যাত্রীর হােন্ডঅল -এর স্ট্র্যাপে পা আটকে পড়ে গিয়ে বৃদ্ধার পা মচকে যায়। ক্ষমাপ্রার্থনা বা সহানুভূতি দেখানাে তাে দূরের কথা, যার ব্যাগে পা আটকে গিয়েছিল, সে ব্যক্তি বৃদ্ধাকে না দেখে-শুনে পথচলার জন্য কঠু কথা শোনায়। বৃদ্ধা বহুকষ্টে ট্রেনে ওঠে বসার জায়গা না পেয়ে মেঝেতেই বসলেন। ইতিমধ্যে পা ফুলে প্রচণ্ড যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। বৃদ্ধ বুঝলেন একা তার পক্ষে নামা সম্ভব নয়। বৃদ্ধার পাশে তার ছেলে ও নাতির বয়সি বহু বাঙালি ছিল। বৃদ্ধা তাদের করুণভাবে অনুরোধ জানালেন তাকে একটু নামিয়ে দেওয়ার জন্য। সকলেই শুনল, কিন্তু না শােনার ভান করল, কিন্তু উপরন্তু তাকে নানা জনে নানা কটুক্তি করল। শেষে এক অবাঙালী কুলি বৃদ্ধার অসহায়তার কথা জানতে পেরে বৃদ্ধাকে দু’হাতে বুকের কাছে তুলে ওয়েটিং রুমের মেঝেতে বসিয়ে রেখে আসে। কুলিটি বৃদ্ধাকে জানিয়ে যায়, ‘গয়া প্যাসেঞ্জার এলে সে আবার আসবে।
সেখানে দু’টি ইজিচেয়ারের হাতলে পা তুলে দুই শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে একজন খবরের কাগজ, অন্যজন ইংরেজি বই পড়ছিল। তারা বৃদ্ধাকে ভিখারী ভেবে একজন পকেট থেকে পয়সা বের করে বৃদ্ধার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, ‘পয়সা ওঠালেও, তুম হি কো দিয়া। উত্তরে বৃদ্ধা পরিস্কার বাংলায় বললেন- “আমি ভিখারী নই বাবা, আমি আপনাদের মতাে এক প্যাসেঞ্জার। শিক্ষিত বাঙালি দু’টি ‘আরাে নানা অপমানকর কথা বলতে লাগল। ইতিমধ্যে কুলিটি এসে বৃদ্ধাকে জানালেন যে, ‘মাইজি গয়া প্যাসেঞ্জার আগিয়া’। কুলিটি বৃদ্ধাকে ‘তাহার বলিষ্ঠ বাহুর দ্বারা পুনরায় বৃদ্ধাকে শিশুর মতাে বুকে তুলিয়া লইয়া বাহির হইয়া গেল’ এবং কামরার মধ্যে এক বেঞ্চের এক কোনে বসিয়ে দিল। তারপর ‘বৃদ্ধা তাহাকে দুইটি টাকা বাহির করিয়া দিলেন। কিন্তু কুলিটি জানায় তার মজুরী আট আনা। সে কিছুতেই ধর্ম বিক্রি করে বেশী টাকা নিতে রাজী হয় না। শেষে বৃদ্ধা তাকে বলে “তুমি আমার ছেলে বাবা, ছেলের কাজই করেছ। আমি তাে তােমাকে দুধ খাওয়াইনি, সামান্য যা দিচ্ছি তা দুধের দাম মনে করেই নাও বাবা।” বলতে বলতে “বৃদ্ধার বলার স্বর ঝাপিয়া গেল। চোখের কোনে জল টলমল করিতে লাগিল।” এরপর কুলিটি বৃদ্ধাকে প্রণাম করে বিদায় নেয়।
গােটা গল্পটিতে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের পাশে কুলিটি এক বলিষ্ঠ জীবনবােধের প্রতীক। কুলিটি শুধু কুলি হয়ে থাকেনি। বৃদ্ধার কাছে সন্তান তুল্য হয়ে উঠেছে। কারণ, বৃদ্ধাকে ট্রেন থেকে নামানাে এবং যথাসময়ে আবার ট্রেনে উঠিয়ে জায়গা করে বসিয়ে দেওয়া একজন ছেলের পক্ষেই সম্ভব। কুলিটি বৃদ্ধার কেউ নয়, অথচ বৃদ্ধার সে অশেষ উপকার করেছে, যা ট্রেনের অন্যরা করেনি বা করার কথাও ভাবেননি। তাই বৃদ্ধা কুলিটিকে সন্তানরূপে সম্বোধন করেছে। বৃদ্ধা বুকের দুধ খাইয়ে তাকে বড়াে তােলেনি ঠিক, কিন্তু সন্তানের মতাে কাজ করেছে। যে সমাজে “শিভালরি’-র প্রকাশ কেবল যুবতি মেয়েদের বেলা’, সেখানে কুলিটি এক বিশেষ সামাজিক মূল্যবােধকে তুলে ধরেছে। বাঙালী মধ্যবিত্ত সমাজ যখন তার মূল্যবােধ, মানবিকতাবােধ হারিয়ে ফেলছে, সেই পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে বনফুল এক বলিষ্ঠ জীবনবােধের রূপ দিয়েছেন এ গল্পে, যা আমাদের চেতনার মূল ধরে ঝাকিয়ে দেয়।
বনফুলের ছােটগল্প উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ.ডি. (বাংলা) উপাধির জন্য প্রদত্ত গবেষণা অভিসন্দর্ভ
গবেষক: সুবল কান্তি চৌধুরী
তত্ত্বাবধায়ক: ড. নিখিল চন্দ্র রায় বাংলা বিভাগ, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
১. বাংলা ছােটগল্প’ – শিশির কুমার দাস।
২. ‘বনফুলের ছােটগল্প সমগ্র’ – চিরন্তন মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত।
৩. ‘বনফুলের ফুলবন’ – ড. সুকুমার সেন।সাহিত্যলােক।
৪. ‘বনফুলের উপন্যাসে পাখসাট শােনা যায় প্রবন্ধ—মনােজ চাকলাদার।
৫. ‘পশ্চাৎপট – বনফুল (১৬ – তম খণ্ড)।