মহৎ, চরিত্রবান মানুষের জীবন চিত্রণের পাশাপাশি বনফুল ভণ্ড মানুষের চরিত্রস্বরূপ উন্মোচনেও সিদ্ধহস্ত। “পরিবর্তন” গল্পে দাম্পত্য জীবনের চরম ট্রাজেডির নিষ্ঠুর বর্ণনা দিয়ে ভণ্ড পুরুষের ঠুনকো দাম্পত্য প্রেমের চিত্র নির্মম দৃষ্টিতে রূপায়িত করেছেন। গল্পটি এরকম— ‘হরিমােহনের স্ত্রী সরমা পতিব্রতা নারী। হরিমােহনের যক্ষ্মা হয়েছে জেনে তার পতি সেবার কোন ত্রুটি রাখে না। দিনরাত পতিসেবা সত্ত্বেও হরিমােহন মৃত্যুর দিকে ধীরগতিতে নিশ্চিতভাবে এগিয়ে চলেছে। সরমা যেদিন বুঝতে পারল যে তার স্বামীর বাঁচার সম্ভাবনা কম, তখন সরমা চরিত্রের এক অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। সরমা হরিমোহনের উচ্ছিষ্ট দুধ পান করে।
যক্ষ্মা রােগীর এটো খাওয়া বিপজ্জনক ভেবে গল্প-কথক ডাক্তার সরমাকে সতর্ক করে দেয়। সবকথা শােনার পর সরমা গল্প-কথক ডাক্তারবাবুকে বলে— “উনি যদি না বাঁচেন আমার বেঁচে লাভ আছে কোনও? ছেলে-মেয়েও একটা যদি থাকত তা হলেও বা কথা ছিল।” হরিমােহনের উচ্ছিষ্ট খেতে খেতে একসময় সরমার দুটো লান্সই যক্ষ্মা রােগে আক্রান্ত হলো এবং তার মৃত্যু হল। অথচ হরিমােহন কিন্তু মরল না। ধনী হরিমােহন সুইজারল্যাণ্ডে গিয়ে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে রােগমুক্ত হল। হরিমােহন দেশে ফিরে আবার একটি বিবাহ করে। হরিমােহন অবশ্য প্রথম স্ত্রীকে ভােলেনি, ততটা হৃদয়হীন সে নয়! তাই অনেক খুঁজে খুঁজে সরমা নামেরই আর একজনকে বিয়ে করে।
পতিব্রতা স্ত্রীর জীবনদানের কি অসাধারণ প্রতিদান! যে স্ত্রী নিজের জীবন স্বেচ্ছায় বিপন্ন করে ঐকান্তিক প্রেমে স্বামীর দিন-রাত সেবা করেছে, নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছে, সেই স্বামী সবকিছু ভুলে স্ত্রীর মৃত্যুর পর আবার দ্বিতীয়বার বিবাহ করে বসল! যার মরার কথা ছিল সে বেঁচে গেল, যার বেঁচে থাকার কথা ছিল সেই মরে গেল। হরিমােহনের জীবনের পরিবর্তন ঘটেছে, সে আবার বিবাহ করেছে, পাত্রী পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু নাম পরিবর্তন হয়নি। আর পরিবর্তন হয়নি হরিমােহনের চরিত্র। আমাদের সমাজে এমন হরিমােহনের অভাব নেই। বনফুল হরিমােহনের জীবনচিত্রে সে কথাই বােঝাতে চেয়েছেন।
বনফুল ছিলেন সুস্থবােধ সম্পন্ন জীবন-শিল্পী। তাই তাঁর গল্পে অন্তহীন জীবন বৈচিত্র্য যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি ফুটে উঠেছে তার অন্তঃ প্রবেশী নিরপেক্ষ দৃষ্টি, যাতে গল্পগুলি আরাে অনুভবতায় গভীর হয়ে উঠেছে। বনফুলের গল্পভাবনার বলিষ্ঠ অভিজ্ঞান সেখানেই। আসলে জীবনে বাঁচার তাে একটা অবলম্বন চাই। সরমার সেই অবলম্বন ছিল তার স্বামী, কারণ তাদের কোন সন্তান ছিল না। তার জীবনের এই নিঃসঙ্গতাৰােধ থেকে সরমা হরিমােহনের উচ্ছিষ্ট খায় আর হরিমােহন বাঁচার জন্য, জীবন উপভােগ করার জন্য সুইজারল্যাণ্ডে পাড়ি দেয় অসুখ সারাতে, সারিয়ে জীবনের অবলম্বন হিসেবে দ্বিতীয়বার বিবাহ করে সরমা নামের অন্য এক নারীকে। হরিমোহনের পত্নীপ্রেম নেই, আছে আত্মপ্রেম, আর সরমা প্রেম তা ছিল না, যখন বুঝেছিল তার স্বামীর বাঁচার সম্ভাবনার কম। সরমার পতিপ্রেম ছিল নিখাদ। হরিমোহনের ছিল ভণ্ড পত্নীপ্রেম। হরিমােহন আত্মসুখপরায়ণ স্বার্থপর শ্রেণীর মানুষ।
বনফুলের ছােটগল্প উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ.ডি. (বাংলা) উপাধির জন্য প্রদত্ত গবেষণা অভিসন্দর্ভ
গবেষক: সুবল কান্তি চৌধুরী
তত্ত্বাবধায়ক: ড. নিখিল চন্দ্র রায় বাংলা বিভাগ, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
১. বাংলা ছােটগল্প’ – শিশির কুমার দাস।
২. ‘বনফুলের ছােটগল্প সমগ্র’ – চিরন্তন মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত।
৩. ‘বনফুলের ফুলবন’ – ড. সুকুমার সেন।সাহিত্যলােক।
৪. ‘বনফুলের উপন্যাসে পাখসাট শােনা যায় প্রবন্ধ—মনােজ চাকলাদার।
৫. ‘পশ্চাৎপট – বনফুল (১৬ – তম খণ্ড)।