ছােটগল্পের খণ্ড জীবনের রূপায়নে অখণ্ড, বৃহতের, মহতের ব্যঞ্জনা কিভাবে সৃষ্টি করা যায়, বনফুল তা খুব ভালােভাবেই জানতেন। যে খণ্ডজীবনের পরিচয় আমরা হাটে-বাজারে, পথে-ঘাটে, লােকালয়ে, নির্জনে, উৎসবে-আনন্দে বিভিন্ন জায়গায় খুঁজে পাই। বনফুলে “এক ফোঁটা গল্প” -টিতে মানব চরিত্রের আর একটি বিশেষ দিক ফুটে উঠেছে। যেখানে মানব ও পশুতে একাকার হয়ে গেছে। আমরা সাধারণত জন্মদাত্রী মাতাকেই প্রকৃত মাতা হিসেবে মানি, পালিত মাকে নয়, কিন্তু বনফুল জন্মদাত্রী মাতার চেয়ে পালনকর্তী মাতাকেও কোন অংশে কম মনে করেন নি। যার পরিচয় আমরা এক ফোঁটা গল্প’টিতে পাই। অবশ্য এগল্পের পেছনে বনফুলের ব্যক্তিগত জীবনের ছায়াপাত পরােক্ষভাবে থাকলেও থাকতে পারে। কেননা, বনফুল ছােটবেলা তাদের বাড়ির মুসলমান চাষি চামরুর স্ত্রীর স্তনপান করে পুষ্ট ও বড় হয়েছিলেন।
গল্পের আখ্যানটি সংক্ষেপে এরকম— রামগঞ্জের জমিদার শ্যামবাবু একটু খেয়ালী ও খাপছাড়া লােক ছিলেন। তিনি তাঁর মাতৃশ্রাদ্ধে গল্প -কথককে নিমন্ত্রণ করেছেন, গল্পের কথক ভাবলেন ‘শ্যামবাবুর মায়ের অসুখ হল অথচ আমি একটা খবর পেলাম না!’ কারণ তিনিই হলেন সেখানকার একমাত্র ডাক্তার। দ্বিধান্বিত চিত্তে গল্প-কথক নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেলেন। গিয়ে দেখলেন “শ্যামবাবু গলায় কাচা নিয়ে সবাইকে অভ্যর্থনা করছেন। তার মুখে একটা গভীর শােকের ছায়া।” বক্তা এরপর শ্যামবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, “আপনার মায়ের হয়েছিল কি?” শ্যামবাবু একটু বিস্মিত হয়ে উত্তর দিলেন— “ও আপনি শােনেন নি বুঝি? আমার মা তাে আমার ছেলেবেলাতেই মারা গেছেন, তাকে আমার মনেও নেই। ইনি আমার আর এক মা— সত্যিকারের মা ছিলেন।” শ্যামবাবু কথাগুলি বলতে বলতে আবেগান্বিত হয়ে পড়ছিলেন। গল্প-কথক তখন বললেন- “কি রকম? কে তিনি?” শ্যামবাবু বললেন- “আমার মঙ্গলা গাই। আমার মা কবে ছেলেবেলায় মারা গেছেন মনে নেই, সেই থেকে ওই গাইটিই তাে দুধ খাইয়ে আমাকে এতবড় করেছে। ওরই দুধে আমার দেহমন পুষ্ট। আমার সেই মা আমায় এতদিন পরে ছেড়ে গেলেন ডাক্তারবাবু।” এই বলে তিনি হু হু করে কাঁদতে শুরু করলেন। তা দেখে গল্প-কথকের “বিস্ময়ের আর সীমা রইল না।”
বস্তুতঃপক্ষে সত্যিই আমাদের মনে তখন একটি প্রশ্ন জাগে, সত্যিকারের মা কে? জন্মদাত্রী মা, নাকি পালনকর্ত্রী মা। আসলে জন্মদাত্রী মাতার চাইতে পালনকর্ত্রী কোন অংশে ছােট নয় বরং তার ভূমিকা ও মূল্য একটু বেশী। তাই শ্যামবাবুর কাছে জন্মদাত্রী মাতা ও মঙ্গলাগাই একই। কারণ মঙ্গলা গাইয়ের দুধেই তার দেহ মন পুষ্ট এবং তিনি এতবড় হয়েছেন। গল্পটিতে শ্যামবাবুকে আমাদের হয়তাে একটু অদ্ভুত মনে হবে। কিন্তু চরিত্রটির সেই অদ্ভুত খেয়ালীপনার মধ্যে একটি অন্য জীবনবােধ ফুটে উঠেছে। এক ফোঁটা গল্প’ তাই আর একফেঁটা হয়ে থাকেননি, তাতে বৃহতের ব্যঞ্জনা ফুটে উঠেছে।
বনফুলের ছােটগল্প উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ.ডি. (বাংলা) উপাধির জন্য প্রদত্ত গবেষণা অভিসন্দর্ভ
গবেষক: সুবল কান্তি চৌধুরী
তত্ত্বাবধায়ক: ড. নিখিল চন্দ্র রায় বাংলা বিভাগ, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
১. বাংলা ছােটগল্প’ – শিশির কুমার দাস।
২. ‘বনফুলের ছােটগল্প সমগ্র’ – চিরন্তন মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত।
৩. ‘বনফুলের ফুলবন’ – ড. সুকুমার সেন।সাহিত্যলােক।
৪. ‘বনফুলের উপন্যাসে পাখসাট শােনা যায় প্রবন্ধ—মনােজ চাকলাদার।
৫. ‘পশ্চাৎপট – বনফুল (১৬ – তম খণ্ড)।