ব্যক্তিমানুষের ভণ্ডামীর প্রতি বনফুল যেমন খড়গহস্ত হয়েছিলেন, তেমনি সমাজের পচনশীল মানসিকতাকে তিনি ছেড়ে কথা বলেননি। সমাজের দোষত্রুটি, স্বভাব, স্বরূপ তিনি অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরেছেন। সামাজিক অধঃপতনের তেমনি এক নির্লজ্জ উলঙ্গরূপ। “সনাতনপুরের অধিবাসীবৃন্দ” গল্পে উন্মোচিত করেছেন।
গল্পটি এমন- সনাতনপুরের প্রবীণ মােক্তার শৈলেশ্বর বাবু হঠাৎ নিরুদিষ্ট হওয়ায় গ্রাম সুদ্ধ তুমুল উত্তেজনা ও নানা কুৎসিত আলােচনার শুরু হয়েছে। কারণ — ‘শ্যামা নামী ধােপানীটিও সঙ্গে সঙ্গে অন্তৰ্হিতা হইয়াছেন। প্রত্যেকরই ধারণা যে, শৈলেশ্বরবাবুর স্ত্রী-পুত্রপরিজন থাকা সত্ত্বেও সেই ধােপানীর সঙ্গে তার কোন অবৈধ সম্পর্ক ছিল, যার দরুণ এই বৃদ্ধ বয়সে শৈলেশ্বরবাবুর এই চরিত্রচ্যুতি। সকলেই যে-যার মতাে নানা কৌতুককর কুৎসা রটিয়ে চলল, এমন কি গ্রামসুদ্ধ সকলেই উত্তেজিত হয়ে উঠল। নানা জনে নানা তথ্য সংগ্রহ করতে লাগল, খোড়া মল্লিক মহাশয় কৌশলে খবর নিয়ে জানতে পারলেন, শ্যামা ধােপানীর স্বামী পিক ধােপর কাছে কাল মার খেয়েছে। পাড়ার লােকজনের কারাে সন্দেহ হল, এর পরেই তারা আত্মগােপন করেছে। বৃদ্ধ গােস্বামী মহাশয় তাে বলেই ফেললেন, ‘পাড়-ঘুঘুটি এইবার ফাঁদে পড়েছেন। গ্রামের প্রত্যেকেই প্রত্যেকের বিরূদ্ধে উত্তেজনার বশে অন্তর্কলহে লিপ্ত হয়ে পড়লেন এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে। অচিরকালের মধ্যে শৈলেশ্বরবাবুকে কেন্দ্র করিয়া ভাদুড়ি মহাশয়ের বিরূদ্ধে রায় মহাশয়ের, রায় মহাশয়ের বিরূদ্ধে মুকুজ্জে মহাশয়ের, মুকুজ্জে মহাশয়ের বিরূদ্ধে গাঙ্গুলী মহাশয় উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়া গেলেন। গ্রামের এমন চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতিতে গ্রামে দু’টি ঘটনা ঘটল – এক, শ্যামা ধােপানী হঠাৎ গ্রামে ফিরে আসল, জানা গেল, সে তার মামার বাড়ি গিয়েছিল, পিরুর সঙ্গেও তার কোন কলহ নেই। দুই. “শৈলেশ্বর মােক্তার আর ফিরিলেন না কারণ তিনি মারা গিয়াছিলেন। প্রেমে পড়িয়া নয়,কূপে পড়িয়া। গ্রামের একটা অব্যবহৃত এঁদো নেড়া কুঁয়া ছিল।” তার ভিতর থেকে গলিত শবদেহটা আবিষ্কার করেছেন মল্লিক মহাশয়।।
সমগ্র গল্পটিতে বনফুল গ্রামের মানুষের নগ্ন কলুষিত মানসিকতা, বিকৃত রুচির যে পরিচয় তুলে ধরেছেন তাতে সমাজের কি শিক্ষিত, কি অশিক্ষিত – সকল শ্রেণীর মানুষের রুগ্ন মানসিকতাকে চিহ্নিত করে। সমাজের অভ্যন্তরে এই ব্যাধির স্বরূপ রূপায়ণ সত্যিই যেমন উপভােগ্য, তেমনি বাস্তব সম্মত।
বনফুলের ছােটগল্প উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ.ডি. (বাংলা) উপাধির জন্য প্রদত্ত গবেষণা অভিসন্দর্ভ
গবেষক: সুবল কান্তি চৌধুরী
তত্ত্বাবধায়ক: ড. নিখিল চন্দ্র রায় বাংলা বিভাগ, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
১. বাংলা ছােটগল্প’ – শিশির কুমার দাস।
২. ‘বনফুলের ছােটগল্প সমগ্র’ – চিরন্তন মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত।
৩. ‘বনফুলের ফুলবন’ – ড. সুকুমার সেন।সাহিত্যলােক।
৪. ‘বনফুলের উপন্যাসে পাখসাট শােনা যায় প্রবন্ধ—মনােজ চাকলাদার।
৫. ‘পশ্চাৎপট – বনফুল (১৬ – তম খণ্ড)।