নামকরণ একটি শিল্প। নাটকের বিষয়বস্তু, ভাবসম্ভার, অন্তর্নিহিত তাৎপর্য জগৎ ও জীবন সম্পর্কে নাট্যকারের উপলব্ধি-জাত চিন্তাচেতনার যে প্রকাশ তাই এ নাটকের নামকরণের ক্ষেত্রে তাৎপর্য বয়ে এনেছে। তবে সংক্ষিপ্ত অথচ শ্রুতিমধুর নামকরনের মধ্যে নাটকের অধিকাংশ অংশে যদি প্রতিফলন থাকে তাহলেই নামকরণ সার্থক হয়।
জীবনের সঙ্গে শিল্প-সাহিত্যের যে একটা অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ রয়েছে একথা সর্বজনস্বীকৃত। জীবনের ভিত্তি যখন নড়ে যায়, যখন এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আঘাতে জীবনের প্রাচীন অর্থ ও আদর্শ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, জীবনাকাশে যখন বিচিত্র রঙ্গের রােমান্স ঢেউ তােলে তখন শিল্পের ও রূপান্তর ঘটতে বাধ্য। জীবনের গতিবেগের সঙ্গে সাহিত্য তখন স্বচ্ছন্দে মিলিত হয়ে যায়। দীনবন্ধু মিত্রের উদ্দেশ্য ছিল নাটকের মধ্যে দিয়ে সাধারণ চাষী প্রজাদের উপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিশ্বাসযোগ্য ও বাস্তব সম্মত ছবি সবার সামনে তুলে ধরা এবং ধরেছেনও তাই। নাটকটিকে দর্পণের মতো ব্যবহার করে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য বর্গ ও সাধু ইংরেজদের তিনি দেখাতে চেয়েছেন অসাধু ইংরেজ নীলকর সাহেবদের চরিত্রকে। দর্পণের সামনে দাঁড়ালে নিজের প্রতিকৃতি দেখা যায়। এই নাটকটির দিকে তাকালে ইংরেজ জাতি নিজেদের কলঙ্কময় দিকটা দেখবেন এবং সংশোধনের দ্বারা শুদ্ধ হয়ে উঠবেন। এই আকাঙ্ক্ষা নিয়েই নাটকটি রচনা করা হয়। শুধু সাহেবরা নন নাটকের দর্শক মাত্রই নাটকটি দেখলে নীলকরদের অত্যাচার সম্পর্কে অবহিত হতে পারবেন। এই জন্যই “নীলদর্পণ” নামকরণটি সার্থক হয়েছে বলে আমরা মনে করি।
‘নীলদর্পণ’ নামকরণের মধ্যে ‘দর্পণ’ শব্দটির একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। ‘ভূমিকা’তে নাট্যকার নিজেই লিখেছে, ‘নীলকরনিকরকরে নীল-দর্পণ অৰ্পণ করিলাম। এক্ষণে তাহারা নিজ নিজ মুখ সন্দর্শন পূর্বক তাহাদিগের ললাটে বিরাজমান স্বার্থপরতা কলঙ্ক-তিলক বিমােচন করিয়া তৎপরিবর্তে পরােপকারশ্বেতচন্দন ধারণ করুন, তাহা হইলেই আমার পরিশ্রমের সাফল্য, নিরাশ্রয় প্রজাব্রজের মঙ্গল এবং বিলাতের মুখ রক্ষা…”
এই মন্তব্যের মধ্যে দর্পণ’ শব্দের ব্যবহারের মূল উদ্দেশ্য ধরা পড়েছে। নীলকরগণের স্বার্থময় ক্রিয়াকলাপের দর্পণবৎ প্রতিবিম্ব নিজেরা দেখে নিজেরাই লজ্জিত হবেন, তার ফলে একদিকে রাইয়তদের মঙ্গল, অন্যদিকে উদার ইংরেজগণের মুখরক্ষা হবে। কাজেই এই তিনটি উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য সাধনের জন্য নাট্যকার আলােচ্য বিষয়ের দর্পণবৎ প্রতিবিম্ব প্রদর্শন করেছেন।
একাধিক কারণে এই ‘দর্পণ’ শব্দ প্রযুক্ত হয়েছে। প্রথমত, তখনকার এবং তৎপূর্বকালের সংবাদপত্রের নামকরণে ‘দর্পণ’ শব্দটির ব্যবহারের প্রথা। নীলদর্পণের আখ্যা পত্রে যে সংস্কৃত ভাষায় রচিত বাণী। মেলে (নীলদর্পণং/নাটকং/নীলকর-বিষধর-দংশন কাতর-প্রজানিকর ক্ষেমঙ্করেণ কেনচিৎ পথিকেনাভি প্রণীতং), সে প্রথা তখনকার সাময়িক পত্রের নিজস্ব Motto নির্দেশ করতেও অনুসৃত হত। সাময়িক পত্র হল সাময়িক সংবাদাদির সত্য-প্ৰকৃত-যথার্থ বিম্ব, দর্পণের মতাে। নীল অত্যাচারের সংবাদ প্রদানও যেন এই নাটকের উদ্দেশ্য। সুতরাং, একদিকে সংবাদপত্রের নামকরণে ‘দর্পণ” শব্দের প্রয়ােগ এবং সেগুলির নিজস্ব এক-একটি Moto নির্দেশ করতে সংস্কৃত ভাষায় রচিত বাণীযুক্ত করবার প্রথা।
আর অন্যদিকে সত্য-প্ৰকৃত-যথার্থ সংবাদরূপে নীলকর-অত্যাচারের নিদর্শন রূপে কিছু দৃষ্টান্ত ও চিত্র তুলে ধরবার প্রয়াস এখানে কার্যকরী হয়েছে। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা সাময়িক সাহিত্য’ বইটির পৃষ্ঠা ওল্টালেই এ কথার প্রমাণ পাওয়া যাবে।
সাপ্তাহিক ‘সমাচারদর্পণ’ (প্রথম প্রকাশ : ২৩শে, মে, ১৮১৮) পত্রিকার প্রথম কয়েক বছর একটি সংস্কৃত শ্লোক Moto ক্ষপে যুক্ত হত, যা নীলদর্পণের ভূমিকায় নাট্যকারের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের সঙ্গে তুলনীয় :
দর্পণে মুখসৌন্দর্যমিক কার্যকিঙ্কণাঃ।
বৃত্তান্তানিহ জানস্তু সমাচারস্য দর্পণে সাপ্তাহিক ‘সম্বাদ কৌমুদীর’ (প্রথম প্রকাশ: ৪ঠা ডিসেম্বর, ১৮২১) শিবােভাগে থাকত এই শ্লোকটি,
দর্পণে বদনং ভাতি দীপেন নিকটস্থিতং।
রকি ভুবনং তপ্তং কৌমুদ্যা শীতলং জগৎ।।
এখানে দর্পণে মুখ দেখার অংশটিই আমাদের অভিপ্রেত। সর্বতদীপিকা এবং ব্যবহার দর্পণ (জুলাই, ১৮২৯), সাপ্তাহিক ‘সমাচার জ্ঞানদর্পণ’ (১৭ অক্টোবর, ১৮৪৬), দৈনিক ‘মহাজনদর্পণ’ (সেপ্টেম্বর, ১৮৪৯), সাপ্তাহিক ‘বিদ্যাদর্পণ’ (এপ্রিল, ১৮৫৩), ‘মাসিক সিদ্ধান্ত দর্পণ’ (মার্চ, ১৮৫৫), প্রভৃতি সাময়িক পত্রের নামকরণ এ বিষয়ে লক্ষণীয়। ‘নীলদর্পণের পরেও পাই সাপ্তাহিক “ঢাকাদর্পণ’ (জুলাই, ১৮৬৩), ‘পাবনাদর্পণ” (মার্চ, ১৮৬৪) প্রভৃতি নাম।
সাময়িক পত্রিকার শিরােদেশে এই রকম সংস্কৃত বাণী যুক্ত করবার পেছনে আরাে একটি কারণ আছে। একদিকে ইংরেজীর বিপরীতে সংস্কৃত ভাষাকে স্থান দান, অন্যদিকে প্রাচীন ভারতের ঐশ্বর্যকে মান দান। ‘নীলদর্পণে’ প্রায় সমকালে, ঈষৎ পরে প্রকাশিত মাইকেলের ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের আখ্যাপত্র বিশ্বনাথ কবিরাজের ‘সাহিত্যদর্পণ” থেকে উন্ধিত আছে।
দ্বিতীয়ত, এই ‘দর্পণ’ শব্দের সঙ্গে সাহিত্যের Realism বা বাস্তবতা বােধের তাকালিক ধারণাটির যােগ আছে বলে মনে হয়। আলােচ্য যুগে ‘বাবতা’ বলতে বাস্তবের ফটোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবিকেই যেন প্রাধান্য দেয়া হত। Real কে Idealise করবার সাহিত্যিক গুণ বা ক্ষমতার যে উল্লেখ দীনবর সাহিত্য-প্রতিভা বিচারকালে বঙ্কিমচন্দ্র করেছিলেন, বলা বাহুল্য, তা সবার মধ্যে যেমন ছিল না, তেমনি সাধারণভাবে পাঠক-সাহিত্যিকদের কাছে বাস্তবতা বলতে ফটোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবিটাই প্রাধান্য পেত। এর প্রমাণ মেলে তৎকালীন সাহিত্যের মধ্যেই। সে যুগের সাহিত্যের মধ্যে এ জন্যেই বাস্তবের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা পাঠক-সমালােচক প্রত্যাশা করতেন; সমালােচকগণ তাদের সমালােচনায় সুস্পষ্টভাবে তার উল্লেখও করতেন। সাহিত্যকারগণও সেই সাহিত্য রুচিম্বারা প্রভাবিত, এমন কি নিয়ন্ত্রিতও হতেন। দীনবন্ধুও এর ব্যতিক্রম নন। তার ‘দর্পণ’ শব্দের প্রয়ােগকেও এই ধারার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হবে।
‘নীলদর্পণ’ রচনার পটভূমিকাটিকেও এক্ষেত্রে স্মরণ করতে হবে। দীনবন্ধু নিশ্চয়ই ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দের আগেই (১৮৫৮) ‘নীলদর্পণ’ রচনা শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই বছরেই Surminary Act, এবং Indigo Commission প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়, লে: গ: স্যার পিটার গ্র্যান্ট ষ্টীমারে করে ঘুরে-ঘুরে গ্রামবাসীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যােগাযােগ রক্ষার চেষ্টা করায়, তার নাটকের কাহিনী-ঘটনা-চরিত্র নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। নীলকমিশনে বহু প্রজা-বায়তের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছিল। দীনবন্ধুও যেন স্বতােপ্রণােদিত হয়ে, নিজেই। একজন ‘পথিক’ রূপে, অদৃশ্য নীলকমিশনের কাছে তার এই রিপাের্ট ও সাক্ষ্য লিখিতভাবে প্রদান করেছেন। ‘পথিক’ শব্দটির প্রয়োগ বিশেষভাবে বিচার্য। শব্দটির মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের নদী বক্ষে ভ্রমণ | যেমন আছে, তেমনি যে “প্ৰজানিকর’ নীলকমিশনে সাক্ষ্য প্রদান করেছে, কিংবা একজন পথচারী তা যেভাবে দেখেছেন, তারই দূর ও ক্ষীণ চিত্রকল্পও আছে। ‘পথিক’ কর্তৃক সৃষ্ট ঘটনার ফটোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবি যেন এই ‘দর্পণ’।
এই ‘দর্পণে যারা মুখ দেখবেন, তারা কিন্তু বিদেশী। স্বদেশের কেউ নয়। সেজন্য এর অনুবাদ ত্বরান্বিত হয়। সেই বিদেশী দুর্বত্ত নীলকরগণ এবং উদার ও মানবতাবাদী ইংরেজগণ। তাদের হাতেই এই দর্পণ সমর্পণ করেছেন নাট্যকার। অতএব সত্য-নিখুত-যথাথ চিত্র চাই। সেই চিত্র-দর্পণ দেখে যেন তঁারা নিজেরাই লজ্জা পান, নীলকরদের মনে শুভ-সূর্যের উদয় যেন হয়। যে সব সমালােচক দুঃখ করেছেন, কেন এ নাটকে বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ বিবরণ নেই, তাদের এ প্রসঙ্গটি স্মরণ করতে বলি। যদি বিদ্রোহের স্পষ্ট প্রত্যক্ষ চিত্র প্রদান করা হত, তবে স্বতঃশর্তভাবে শুভচেতনার উদয় যেমন প্রত্যাশিত থাকত না, তেমনি ইংরেজদের লজ্জা পাবারও কোনাে কারণ ঘটত না। নাট্যকারের লক্ষ্যই ছিল, প্রত্যক্ষ ও যথাযথ দৃপণ তুলে ধরে বিদেশীদের লজ্জা দেওয়া এবং তারই ফলে অত্যাচারের মাত্রার হাস ঘটানাে। প্রত্যক্ষ উপায়ের বদলে তিনি, পরোক্ষ উপায়ের আশ্রয় নিয়েছে এখানে। অবশ্য সিপাহি বিদ্রোহের মল-পরিণামও নাট্যকারকে প্রভাবিত করতে পারে, যদিও নাট্যকার সে কথার উল্লেখ করেন নি। নীলদর্পণ’ প্রকাশের বছর তিনেক আগেই যে সিপাহি বিদ্রোহ ঘটে গেছে, ইংরেজগণ তা দক্ষতার সঙ্গে গমন করেছিল। ভারতবাসীর মনেও সিপাহী বিদ্রোহ সম্পর্কে দ্বিধা ছিল। দক্ষ শাসন এবং ভারতীয় মনের দ্বিধা কি দীনবন্ধুকে এই পরােক্ষ পথে চারণ করতে বাধ্য করেছিল।নীল সমস্যাকে নাট্যকার ভারতীয় মহাজনদের অর্থলােলুপতার পটভূমিকাতেও বিচার করেছেন। এইখানেই তার দৃষ্টির পূর্ণতা, সমস্যাটিকে সার্বিকভাবে প্রণিধান করবার সতর্ক প্রয়াস নীলদর্পণ।
দর্পণের সামনে দাঁড়ালে নিজের প্রতিকৃতি দেখা যায়। এই নাটকটির দিকে তাকালে ইংরেজ জাতি নিজেদের কলঙ্কময় দিকটা দেখবেন এবং সংশোধনের দ্বারা শুদ্ধ হয়ে উঠবেন। এই আকাঙ্ক্ষা নিয়েই নাটকটি রচনা করা হয়। শুধু সাহেবরা নন নাটকের দর্শক মাত্রই নাটকটি দেখলে নীলকরদের অত্যাচার সম্পর্কে অবহিত হতে পারবেন। এই জন্যই “নীলদর্পণ” নামকরণটি সার্থক হয়েছে বলে আমরা মনে করি।