জীবনের জন্যেই শিল্প। তাই জীবনের সঙ্গে শিল্প-সাহিত্যের যে একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে একথা সর্বজন স্বীকৃত। জীবনের মৌল ভিত্তি যখন টলে যায়, যখন এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আঘাতে জীবনের প্রাচীন অর্থ ও আদর্শ, মূল্যবোধ-সৰ যখন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, তখন শিল্প-সাহিত্যেও তার রূপান্তর ঘটতে বাধ্য, জীবনের গতিবেগের সঙ্গে সাহিত্য স্বচ্ছন্দে মিলে যায় তখন। নজরুলের সাহিত্যকর্মে জীবনের এই গতিবেগের মিলিত রূপ দেখতে পাই।
নজরুল যখন বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বাংলাদেশে প্রথম মহাযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে এলেন, তখন একদিকে সমগ্র বাংলার তথা ভারতবর্ষে এক বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। বুদ্ধিজীবীদের উপর সাম্রাজ্যবাদের ভ্রুক্ষেপ, জালিয়ানওয়ালাবাগে নিরস্ত্র নরনারীর রক্তে রক্তাক্ত রাজপথ, যুদ্ধের ফলে দুনিয়া জোড়া অর্থনৈতিক সংকট; বেকার সমস্যা প্রভৃতির চাপে মধ্যবিত্ত সমাজের সাজানাে বাগানে তীব্রতর ভাঙন দেখা দিয়েছে। রুশ বিপ্লব এবং তৎকালীন ইউরােপের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী লেখকদের প্রভাবে পুরােনাে আমলের ধ্যান ধারণার বুনিয়াদ অবিশ্বাসের তীব্র আঘাত, মৃত্যু দুঃখ-বেদনার মধ্য দিয়ে বৃহৎ নবযুগের রক্তাক্ত অরুণােদয় আসন্ন। সংকটাপন্ন বুদ্ধিবাদ তখন খুঁজছে নতুন আলাের দিশা, নতুন বাস্তব অবস্থাকে আত্মসাৎ করার জন্যে হয়ে উঠেছে ব্যাকুল। অধিকাংশ কবি তাঁর সর্বব্যাপী প্রতিভার কাছে দ্বিধাহীন চিত্তে আত্মসমর্পণ করে কাব্য সরস্বতীর আরাধনা করছিলেন। এ অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে নজরুল তাঁর “অগ্নি-বীণা” হাতে নিয়ে বিদ্রোহী বেশে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে আর্বিভূত হলেন। রবীন্দ্র বিরােধিতার ক্ষেত্রে প্রথম বলিষ্ঠ কণ্ঠ তারই। জনজীবনের সঙ্গে কাব্যকে সার্থকভাবে যুক্ত করার প্রথম গৌরব বহুলাংশে তিনিই দাবি করতে পারেন। বাংলা কাব্যের বিদ্রোহ, পৌরুষ ও যৌবনের অগ্রগণ্য ভাষ্যকারদের মধ্যেও তিনি অন্যতম।
‘অগ্নি-বীণা’, ‘বিশেৱ ৰাশী”, সাম্যবাদী”, “সর্বহারা’, ‘ফণিমনসা’, জিঞ্জির’, ‘সন্ধ্যা’ ও “প্রলয়শিখা”- কাব্যগ্রন্থের মূল সুর প্রায় এক। কবির বিদ্রোহীরূপ এগুলাের মধ্যে প্রায় বিদ্যমান। দেশপ্রেম, সমাজনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতি প্রতি বিষয়বস্তুকে আশ্রয় করে কবির বিক্ষোভ, আশা-নিরাশা ইত্যাদি কাব্যরূপ পেয়েছে।
‘অগ্নি-বীণা’ প্রকাশিত হলে এ কাব্যের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশ তাকে চিনেছিল। যৌবনধর্মী কবিমানসের অস্থির, অধৈর্য, দিশেহাৱা মন, ব্যক্তি ও আদর্শবাদ শাসনের নামে অবাধ কুশাসনের প্রতিবাদ, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে অত্যাচারিতের বিক্ষুব্ধ ভাষা ও বিদ্রোহের বাণী অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে তার জবরদস্ত সংহত সংগ্রাম ও সংগঠনের উদাত্ত আহ্বান কবিতাটির ছত্রে ছত্রে বিদ্যমান।
নজরুলের আবির্ভাবকালে সমকালীন সাহিত্যে বিদ্রোহের সুর ক্রমশ উচ্চকিত হয়ে উঠছিলাে। কিন্তু তখনাে পর্যন্ত অত্যাচারীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে অসি চালানাের মতাে দুঃসাহস কেউ অর্জন করেনি। এই দুরূহ কাজটি সম্পন্ন করেছেন নজরুল। তিনি শুধু সরব বিদ্রোহ ঘােষণায় অত্যাচারীর বিরুদ্ধে অসি ধারণই করেননি, স্বয়ং বিধাতা পুরুষের বুকে পদাঘাত হানার দুর্জয় শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠলেন।
‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন’—এখানেই নজরুলের বিদ্রোহী চেতনার বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব। বিদ্রোহী কবিতার মতো ধূমকেতুতেও কবির বিদ্রোহের রুদ্ররূপ প্রকাশিত হয়েছে।
নজরুলের বিদ্রোহাত্মক কবিতায় তাঁর বিদ্রোহ কেবল শাসক এবং শােষক শ্রেণির বিরুদ্ধেই ঘােষিত হয়নি, বিভিন্ন দিক থেকে এই বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল। রাষ্ট্র-সমাজ-সাহিত্য যেখানে গােজামিল, জোড়া-তালি, অনাচার ও অনিয়ম লক্ষ করেছেন, বন্ধনহীন নজরুলের সরব কণ্ঠ সেখানেই গর্জন করে উঠেছে।
ভারতীয় রাজনীতিতে যখন খেলাফত আন্দোলনের মাধ্যমে আলী ভ্রাতৃদ্বয় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যাপৃত, তখন নজরুল এই প্রচেষ্টাকে কার্যকরী করে তােলার জন্যে লিখলেন ‘কামালপাশা’ ও ‘শাত-ইল-আরব’। এই কবিতাগুলাে রচনার উদ্দেশ্য ছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকারীদের শাসনে হিন্দু সংস্কৃতি ও মুসলিম তমদ্দুনের সংমিশ্রণে ভারতীয় সংস্কৃতির সনাতনরূপ ফুটিয়ে তােলা। “মােহম”, “কোরবানী”, ‘রণ-ভেরী’ কবিতার প্রত্যেকটি ছত্রে মুসলিম সমাজের গতানুগতিক জীবনের প্রতি ধিক্কার ও সেই সঙ্গে জেগে ওঠার জন্যে মৃত্যুভয়হীন ম্লান ধ্বনি ফুটে বেরিয়েছে। একদিকে যেমন মুসলিম সমাজকে জাগ্রত করতে চেষ্টা করেছেন, তেমনি অপরদিকে হিন্দু সমাজের দুরত্ব ঘােচাবার জন্যে ‘রক্তাম্বরধারিনী মা’, ‘আগমনী’ ইত্যাদি কবিতা লিখেছেন।
”রক্তাম্বর পর মা এবার
জ্বলে পুড়ে যাক শ্বেত বসন;
দেখি ঐ করে সাজে মা কেমন
বাজে তরবারি ঝনঝন্।” (রক্তাম্বরধারিনী মা)
“রণ-রঙ্গিণী জগন্মাতার দেখ মহারণ,
দশ দিকে তাঁর দশহাতে বাজে দশ প্রহরণ!
পদতলে লুটে মহিষাসুর,
মহামাতা ঐ সিংহ-বাহিনী জানায় আজিকে বিশ্ববাসিকে—
শাশ্বত নহে দানব-শক্তি,
পায়ে পিষে যায় শির পশুর!” (আগমনী)
নজরুলের বিদ্রোহ চেতনার আরেকটি দিক হচ্ছে তার অপরিসীম মfনবতাবােধ। মানুষের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধাই তাঁকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। উদার মানবিকতারই পূজারী বিদ্রোহী নজরুল। তার বিদ্রোহ এবং মানবিকতা তাই একসুত্রে প্রথিত । অনেকে মনে করেন নজরুলের এ বিদ্রোহ উদ্দেশ্যবিহীন বােকামী ছাড়া আর কিছুই নয়। এ বিদ্রোহের কোনাে চিরন্তন ফলশ্রুতি নেই আছে চিৎকার। কিন্তু তাঁর বহুল আলােচিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় তাঁর বিদ্রোহের উদ্দেশ্য নির্দেশিত হয়েছে:
“আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রােল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত। (বিদ্রোহী)
উদ্দেশ্যবিহীন বিদ্রোহ যে, পাগলামীর নামান্তর কথা নজরুল ভালােভাবেই জানতেন। তাঁর বিদ্রোহ কেবল ভাঙার জন্য নয়- সে ভাঙার পেছনে রয়েছে নতুন গড়ার সংগ্রাম। অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খাঁ’কে লেখা একটি চিঠিতে নজরুল নিজেই বলেছেন“নতুন করে গড়তে চাই বলেই তাে ভাঙ্গি— শুধু ভাঙ্গার জন্যেই ভাঙ্গার গান আমার নয়।” ভাঙ্গার পেছনে গড়ার মহান সংকল্প রয়েছে বলেই বিদ্রোহ। তাই প্রলয়ােল্লাস’ কবিতায় নজরুল বলেন
“ধ্বংস দেখে ভয় কেন তাের প্রলয় নতুন সুজন-বেদন!
আসছে নবীন-ঈীন-হাৱা অসুন্দর করতে ছেদন!”
জরাজীর্ণ পুরাতনকে ভেঙ্গে ধুলায় গড়িয়ে দিয়ে যৌবনাদীপ্ত নতুন তাজমহল রচার সংকল্পেই তিনি বিদ্রোহ করেছেন। ইংরেজ শাসনে তৎকালীন ভারতবর্ষের যে চেহারা দাঁড়িয়েছিল তার প্রতিবাদে বিদ্রোহী না হয়ে উপায় ছিল না। কেবল ইংরেজ কেন নিখিল বিশ্বের বুর্জোয়া-সমাজ মানুষের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে মানুষকে যে ঘৃণ্যৰূপে দাঁড় করায় তার প্রতিবাদেই নজরুলের বিদ্রোহ। মানুষকে মানুষের যােগ্য আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে- নজরুলের বিদ্রোহবাদের মূলে এই একটি মাত্র শক্তি কাজ করেছে। ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র, সাহিত্য সর্বত্রই তিনি নিখিল বিশ্বের মানবগােষ্ঠীর মানবিকতার আদর্শ প্রকাশ দেখতে চেয়েছেন। যেখানে তা পাননি, সেখানেই তিনি হয়ে উঠেছেন বিদ্রোহী। সকল অন্যায় অবিচারী শক্তির বিরুদ্ধেই তার শির উন্নত।