সূচনা: রবীন্দ্র যুগে বসবাস করে রবীন্দ্র বলয় থেকে মুক্ত হয়ে যাঁরা বাংলা সাহিত্যের নতুন পথ তৈরি করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) তাঁদের মধ্যে অন্যতম। কাজী নজরুল ইসলাম মূলত রোম্যান্টিক কবি। সিন্ধু-হিন্দোল (১৩৩৪) কাব্যে নজরুল-মানসের অসংযত রোম্যান্টিক আবেগ চক্রবাক (১৩৩৬) কাব্যে এসে লাভ করেছে সংহতি, দর্শনের সঙ্গে আত্মলগ্ন হয়ে তা উত্তীর্ণ হয়েছে পরমার্থ বোধে। প্রথম পর্বের কাব্যে প্রেমের প্রাঙ্গণে মানবাত্মার শাশ্বত বিরহকে তিনি আবিষ্কার করতে পারেননি । কিন্তু চক্রবাক কাব্যে এসে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কবি উপলব্ধি করছেন প্রেমের জগতে প্রাপ্তি নয়, বরং অপ্রাপ্তি, মিলন নয় বরং বিরহই চিরায়ত সত্য, শাশ্বত প্রাপ্তি। নিম্নে বিরহের শ্বাশত পরমার্থ আবিষ্কার এবং গীতল কাব্যরস সৃজনে নজরুলের ‘চক্রবাক’ কাব্যটির বিশিষ্টতা নির্দেশ করা হলো।
মূলভাব: রোম্যান্টিকতার বিবিধ চরিত্র সঞ্চারিত হয়েছিলো নজরুলের মানসলোকে। সূক্ষ্ম রহস্যবোধের চেতনা, মননপ্রধান উদ্দাম কৌতূহলবোধ, প্রকৃতিলোকে আত্মভাবের বিস্তারণ এবং অপ্রাপণীয়ের জন্য অনিঃশেষ হাহাকার নজরুলের কবিচৈতন্যের প্রধান রোম্যান্টিক বিষন্নতার বৈশিষ্ট্য। প্রেমের কবিতায় নজরুলের এই রোম্যান্টিক মানসতার প্রোজ্জ্বল প্রকাশ ঘটেছে। যেমন:
”জানি আমি জানি
তোমারে পাব না আমি” (তোমারে পড়িছে মনে)
সিন্ধু-হিন্দোল কাব্যে প্রেমের প্রাঙ্গণে মানবাত্মার শাশ্বত বিরহকে তিনি আবিষ্কার করতে পারেননি । কিন্তু চক্রবাক কাব্যে এসে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কবি উপলব্ধি করছেন প্রেমের জগতে প্রাপ্তি নয়, বরং অপ্রাপ্তি, মিলন নয় বরং বিরহই চিরায়ত সত্য, শাশ্বত প্রাপ্তি। তাই কবি বলেন-
আমার বেদনা আজি রূপ ধরি’ শত গীত-সুরে
নিখিল বিরহী-কণ্ঠে — বিরহিণী— তব তরে ঝুরে!
এ -পারে ও-পারে মোরা, নাই নাই কূল!
তুমি দাও আঁখি-জল, আমি দিই ফুল! (তোমারে পড়িছে মনে)
অর্থাৎ নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথের মতো অবরোহী পদ্ধতিতে নয়, বরং জীবনানন্দ দাশ কিংবা বুদ্ধদেব বসুর মতো আরোহী পদ্ধতিতে আবিষ্কার করেছেন প্রেমের মৌল-সত্য। তাই দেখি, চক্রবাক কাব্যে প্রেমিকার কাছে সিন্ধু-হিন্দোল এর মান-অভিমান আর চিত্তবিক্ষোভ নেই, বরং আছে প্রজ্ঞালালিত এবং অভিজ্ঞতালব্ধ এক বিশ্বাত্মা প্রেমবোধ, যার মূল কথা মানবাত্মার বিরহের শ্বাশত পরমার্থ।
তোমারে লইয়া সাজাব না ঘর, সৃজিব অমরাবতী!
(বাতায়ন-পাশে গুবাক-তরুর সারি)
প্রেমের অঙ্গনে অধরা নারীর জন্য কবির নিরুদ্দেশ যাত্রা শুরু হয়েছে কাব্যচর্চার প্রারম্ভ থেকেই, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেমন স্পর্শ করতে পারেন না রহস্যময়ী অপরিচিতার শাড়ির আঁচল, তেমনি পারেন না নজরুল ইসলামও। কিন্তু এতকাল এই ব্যর্থতার জন্য তাঁর তীব্র হাহাকারবোধ ও মরুভূ যন্ত্রণা চক্রবাক কাব্যের “তুমি মোরে ভুলিয়াছ” এবং “ চক্রবাক ” কবিতায় এসে অভিজ্ঞতালব্ধ দর্শনাশ্রিত হয়ে আবিষ্কার করেছে প্রেমের শাশ্বত সত্য। অপ্রাপ্তির যন্ত্রণার জন্য এখন আর হাহাকার নেই, নেই ব্যাকুলতা কিংবা বেদনার অলজ্জ চিৎকার, বরং এখানে পাই তজ্বলোকে উত্তীর্ণ হবার প্রশান্ত প্রতীতি-
জিজ্ঞাসার সন্দেহের শত আলো- ছায়া
ও-মুখে সৃজিতেছিল কী যেন কি মায়া!
কেবলি রহস্য হায়, রহস্য কেবল,
পার নাই সীমা নাই অগাধ অতল! (তুমি মোরে ভুলিয়াছ)
বিরহ এবং বেদনার এই সৌন্দর্যসন্ধান “চক্রবাক” কবিতায় এসে উত্তীর্ণ হয়েছে পরমার্থ চেতনায়। বেদনাবিজয়ী নজরুল এ কবিতায় প্রেমের রহস্যলোকে বিরহকে পরমসত্য, অনন্ত-মধুররূপে গ্রহণ করেছেন এবং বিরহের সৌন্দর্যসন্ধানকেই আপন কবিসত্তার মৌল ব্রত, পরম প্রাণনা হিসেবে আবিষ্কার করেছেন:
পায়নি যাহারে ভোলেনি তাহারে
কচু তাহারি লাগিয়া শত সুরে শত গানে
কাব্যে, কথায়, চিত্রে, জড় পাষাণে
লিখিছে তাহার অমর অশু-লেখা। (চক্রবাক)
মৃত্যুচেতনা রোম্যান্টিক কবির স্বভাব লক্ষণ । চক্রবাক কাব্যের “ সাজিয়াছি বর মৃত্যুর উৎসবে ” কবিতায় নজরুল – মানসের এই রোম্যান্টিক চারিত্রবৈশিষ্ট্য ধরা পড়েছে। যথা:
নব-জীবনের বাসর-দুয়ারে কবে ‘প্রিয়া’ ‘বধূ’ হবে-
এসই সুখে, প্রিয়, সাজিয়াছি বর মৃত্যুর উৎসবে। (সাজিয়াছি বর মৃত্যুর উৎসবে)
প্রকৃতির উপাদানকে প্রতীক রূপে ব্যবহার করে আত্মভাবের প্রকাশ হিসেবে ‘চক্রবাক’ এর কোন কোন কবিতা বা কবিতাংশ বিশিষ্ট। যেমন: ‘বাদল – রাতের পাখী ‘ কবিতায় বর্ষণ-সিক্ত রাতের পাখি হয়ে ওঠে নজরুলের বেদনাবিজয়ী চিত্তলোকের চিত্রল-প্রতীক:
বাদল-রাতের পাখী!
উড়ে চল্- যথা আজো করে জল, নাহিক’ ফুলের ফাঁকি! (বাদল-রাতের পাখী)
প্রকৃতির বিচিত্র উপাদানকে কবি কল্পনা করেছেন তাঁর মানসপ্রিয়ার প্রেম আর প্রকৃতি নিয়েই কবির প্রতিরূপ সত্তায়। সমালোচকের ভাষায়, কারবার, কবি নিজের প্রিয়াকে দেখেছেন প্রকৃতির ভিতরে। প্রকৃতি আর প্রিয়া একাকার হয়ে যায়।
যবনিকা: নজরুলের রোম্যান্টিক মানসতার দ্বিবিধ প্রকাশ আমরা লক্ষ করি, একদিকে অনুধ্যেয় সৌন্দর্য এবং প্রেমের জন্য বাসনা, ব্যর্থতার অসহনীয় বেদনা, ফলত নৈঃসঙ্গ্য ও একাকিত্বের শিকার; অপরদিকে ইতিহাস-ঐতিহ্য-পুরাণ কিংবা দর্শনে সংলগ্ন হয়ে আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবরূপ দেয়ার জন্য দ্রোহ-বিদ্রোহ প্রতিবাদ-সংগ্রাম। নজরুলের প্রেম ও বিদ্রোহের মধ্যে কোন বিরোধ নেই, বরং তা একই উৎসের দুই পরিপূরক প্রতিভাস। বিরহের শ্বাশত পরমার্থ আবিষ্কার এবং গীতল কাব্যরস সৃজনে নজরুলের ‘চক্রবাক’ কাব্যটিকে বিশিষ্টতা প্রদান করেছে।
তথ্যনির্দেশ
১. বিশ্বজিৎ ঘোষ- “নজরুল মানস ও অন্যান্য প্রসঙ্গ”