Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

কাজী নজরুল ইসলামের ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যে হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্য চেতনা বা ঐতিহ্যপ্রীতির লক্ষণগুলো আলোচনা কর! ”স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে ঐতিহ্যপ্রীতি নজরুল কবিমানসের অন্যতম বৈশিষ্ট”- আলোচনা কর!

ভূমিকা: প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে পৃথিবীব্যাপী, হতাশা, মূল্যবােধের অবক্ষয় এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের প্রতিবেশে বাংলা কাব্যে কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) আবির্ভাব। উনিশ শতকের বাঙালির নবজাগরণকে নজরুল আত্মস্থ করেছিলেন সচেতনভাবে। জনসম্পৃক্ততা তাঁর কবি চৈতন্যে এনেছিল এক নতুন মাত্রা। প্রেমে ব্যর্থতায় যেমন তেমনি বিদ্রোহ প্রকাশের জন্যেও তিনি সচেতনভাবে ভারতীয় এবং পশ্চিম এশীয় উভয় ঐতিহ্য সাদরে বরণ করেছেন। নজরুল ইসলাম যেহেতু জন্মসূত্রে ভারতীয় এই ভারতীয় উওরাধিকারকে তিনি আপন উওরাধিকার বলে জেনেছেন এবং গ্রহণ করেছেন। অপরদিকে যেহেতু ধর্মীয় বিশ্বালে তিনি ছিলেন পশ্চিম এশীয় তথা ইসলামের অতীত গৌরব ও ঐতিহ্যের উনুয়াধিকারী, তাই আপন কবিতায় তিনি উভয় ঐতিহ্যকেই সচেতনভাবে গ্রহণ করেছেন।

মূলপর্ব: কাজী নজরুল ইসলাম যে মাটিতে দাঁড়িয়ে কাব্যচর্চা করেছেন হাজার বছর আগে সেখানে অনার্য সংস্কৃতির লীলাভূমি ছিল। বহিরাগত আৰ্য সংস্কৃতির সঙ্গে দেশীয় সংস্কৃতির বিরােধ-মিলনের ফলে এদেশে জন্মলাভ করেছিলো এক নতুন প্রশস্ত সংস্কৃতি। জন্মসূত্রে নজরুল তাই রামায়ণ, মহাভারত, বিভিন্ন পুরাণ এবং ধৰ্মসূত্রে কোরআন, হাদিস, তফসির, নবি-রসুল ও খলিফাদের কীতি-কাহিনী ও ইসলামি সভ্যতা-সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী। ফলে তাঁর কাব্যে এই উভয়দিকের উত্তরাধিকারিত্নের লক্ষণ সুস্পষ্ট।

‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যে নজরুলের ঐতিহ্য চেতনার সচেতন প্রকাশ লক্ষণীয়ভাবে বিদ্যমান। এই কাব্যের প্রধান কবিতা বিদ্রোহী। কবিতায় মুসলিম ঐতিহ্য ও জীবনবােধের প্রসঙ্গে খোদার আসন, আরশ ছেদিয়া, বোররাক, জিব্রাইল, হাবিয়া-দোযখ, প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। নটরাজ ধূর্জটি, হােমশিখা, জমদগ্নি, ইন্দ্রানী, কৃষ্ণ-কন্ঠ, ব্যোমকেশ, ইশান, পিনাক-পানি, ধর্মরাজের দণ্ড, প্রনব-নাদ, দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য, উচ্চৈঃশ্রবা, বাসুকি, শ্যাম, বিষ্ণু, চঞ্জী, পরাম, বলরাম, তৃণ্ড প্রভৃতি শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে নজরুলের সচেতন প্রয়াস লক্ষ করা যায়। বলা যায়, ঐতিহ্য থেকে আর এক ঐতিহ্যে নজরুলের পদচারণার উদ্দেশ্য ছিল সমাজ বিনির্মাণের জন্যে শক্তি সন্ধান করা। নজরুল ইসলাম উল্লেখিত চরিত্র এবং প্রসঙ্গসমূহ ব্যবহার করেছেন শুধু ইতিহাস এবং পুরাণ উল্লেখিত চরিত্র হিসেবে নয়, তার সচেতন Historical sense এর ফলে ঐতিহ্যভিওিক চরিএসমূহ এবং শপ-অনুষঙ্গ এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। সৃষ্টিশীল ঐতিহ্য চেতুনার এটাই অন্যতম লক্ষণ যে, তা ঐতিহ্যকে অবলম্বন করে নতুন ঐতিহ্যের সৃষ্টি করে।

এ কাব্যের ১২টি কবিতার মধ্যে সাতটি ইসলামী ঐতিহ্য, তিনটি বিশুদ্ধ হিন্দু ঐতিহ্য এবং দুটি কবিতা হিন্দু-মুসলিম উভয় ঐতিহ্যের মিশ্রণে রচিত। নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতায় ঐতিহ্যের ব্যবহার করেছেন। একলিকে ঔপনিবেশিক সমাজকে ভাঙার উদ্দেশ্যে, অন্যদিকে সেই ভাঙ্গনের মধ্য দিয়ে নতুন সৃষ্টির লক্ষ্যে। এক্ষেত্রে নটরাজ শিবের চিত্রকল্পে উপস্থাপিত হয়েছে ঐতিহ্য চেতনার দ্বৈত উদ্দেশ্য। ‘প্রলয়ােল্লাস’ কবিতায় দেখা যায় :

দিগম্বরের জটায় লুটায় শিশু চাঁদের কর,

আলাে তার জন্যে এবার ঘর!

তােরা সব জয়ধ্বনি কর!

তােরা সব জয়ধ্বনি কর।

‘রক্তাম্বরধারিনী মা’, ‘আগমনী’ প্রভৃতি কবিতায় নজরুল দুর্গার বিভিন্ন রূপের চিত্র এঁকেছেন শক্তি সঞ্চয়ের জন্যে। ‘রক্তাম্বরধারিনী মা’ কবিতায় চণ্ডীমাতাকে আহ্বান করে বলা হয়েছে-

নিৰ্দিত শিৱে লাথি মার আজ,

ভাঙ্গো মা ভােলার ভাঙ নেশা,

পিয়াও এবার অ-শিব গরল

নীলের সঙ্গে লাল মেশা।

হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্ধতা, দৈন্যদশা, ক্লীবত্ব দূর করে আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্যে কবি ‘রক্তাম্বরধারিনী মা’ কবিতার চণ্ডীমাতাকে তার শ্বেত শতদল পরিহার করে রক্তাম্বর ধারণ করার জন্যে আহবান করেছেন :

শ্বেত-শতদল-যাগিনী নয় আজ

রক্তাম্বরধারিনী মা,

ধ্বংসের বুকে হাসুক মা তাের

গৃষ্টি নন্য পূর্ণিমা

কারা অবরুদ্ধ বর্তমান সময়ে চণ্ডীর শ্বেতবসন পরিহিতা কুলবধূর রূপকল্পনা অবান্তর। তাই সচেতন নজরুল ইসলামের হাতে চণ্ডী একটি যুগােপযােগী চরিত্র হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। ‘আগমনী’ কবিতায় শিবদুর্গার ছবির নেপথ্যে কবির মূল বক্তব্য প্রতিফলিত হয়েছে এভাবে :

রণ-রঙ্গিণী জগন্মাতার দে মহারণ,

দশ দিকে তার দশ হাতে বাজে দৃশ প্রহরণ।

পদতলে লুটে মহিষাসুর,

মহামাতা ঐ সিংহ-বাহিনী জানায় আজিকে বিশ্ববাসীকে

শাশ্বত নহে দানব-শক্তি, পায়ে পিষে যায় শির পর।

কবির বিদ্রোহী ও বিপ্লবী চেতনার প্রকাশে হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্যের রূপায়ণ কতটা সার্থক ও যথােপযুক্ত হয়েছে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। হিন্দু ঐতিহ্যের রূপায়ণ লক্ষণীয় :

আমি     ক্ষ্যাপা দুর্বাসা বিশ্বামিত্র-শিষ্য,

আমি     দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব।

………………………………..

আমি     পরশুরামের কঠোর কুঠার,

নিঃক্ষত্রীয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!

মুসলিম ঐতিহ্য রূপায়ণে নজরুল ইসলামের চেতনার পরিচয় পাওয়া যায় বিষয়বস্তু নির্বাচনে। ইসলামের ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় ঘটনাবলী যেমন- ‘মােহররম’, ‘কোরবানী’ বা কারবালা তাঁর কাব্যের বিষয় হিসেবে গৃহীত হয়েছে। অন্যায়-অত্যাচার ও শাসন-শােষণের বিরুদ্ধে নজরুলের বিদ্রোহী মনােভাব প্রকাশিত হয়েছে ‘ধূমকেতু’ কবিতায় :

সাত সাতশ নরক-জ্বালা জ্বলে মম ললাটে!

মম   ধূম-কুলী করেছে শিবের ত্রিনয়ন ঘন ঘােলাটে!

মুসলিম ঐতিহ্যের স্বীকৃতি বিজড়িত কবিতাগুলােতে কবি মুসলমান সমাজজীবনের বর্তমান দৈন্যদশা, ভীরুতা ও শঙ্কা দূর করার অভয় মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন।

‘কামাল পাশা’, ‘আনােয়ার’, ‘রণ-ভেরী’ কবিতায় তুরস্ককে এবং ‘শাত-ইল-আরব’ কবিতায় ইরাককে অবলম্বন করে স্বদেশের পরাধীনতার, বেদনা ও স্বাধীনতার আকাক্ষা প্রকাশ করেছেন কবি। কামাল পাশা কবিতায় কবি বলেন :

পরের মুলুক লুট করে খায়, ডাকাত তারা ডাকাত

তাই তাদের তরে বরাদ ভাই আঘাত শুধু আঘাত।

আনােয়ার’ কবিতায় নজরুল তরুণ কবির কষ্ঠে দুনিয়ার মুসলিম সমাজের দুরবস্থার কথা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আনােয়ারের শৌর্য-বীর্যের পরিমা ব্যক্ত করেছেন। মুসলিম সমাজের দুরবস্থায় ব্যথিত হয়ে তাদের মধ্যে প্রাণের উদ্দীপনা আনবার জন্য তিনি আনােয়ারের উদ্দেশ্যে বলেন :

আনােয়ার! আনােয়ার!

দিলওয়ার তুমি, জোর তলওয়ার হানাে, আর

নেস্ত-ও-নাবুদ কর, মারাে যত জানােয়ার।

ইসলামি ঐতিহ্য, বীরত্বের প্রতীক হযরত আলী-দুধারী তরবারি, জুলফিকার যা বারবার নজরুল কাব্যে ব্যবহৃত হয়েছে শৌর্য-বীর্যের প্রতীক রূপে। জুলফিকার তার হায়দারি হক ‘হেথা আজো হজরত আলীর’ এ চরণে ইসলামের অতীত ও বর্তমান  এক সূত্রে গাঁথা।

‘আগমনী’ কবিতায় ‘লাল গৈৱিক-গায় সৈনিক ধার তালে তালে’ বলতেই বােঝা যায়, এ যুদ্ধের পতাকা লাল, কিন্তু এ যুদ্ধের হাঁক হর হর হর হুঙ্কার ধ্বনি। ‘খেয়াপারের তরণী’ ঐতিহ্যভিত্তিক শ্রেষ্ঠ কবিতার একটি। তবে এখানেও এসেছে প্রলয়ের হুঙ্কার ধ্বনি। শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নজরুল হিন্দু ও মুসলিম ঐতিহ্য স্মরণ উল্লেখের দাবি রাখে। তিনি সচেতনভাবে আরবি-ফারসি শব্দ যেমন ব্যবহার করেছেন তেমনি ব্যবহার করেছেন তৎসম শব্দ। এই শব্দ ব্যবহার তার ঐতিহ্য-চেতনাকেই প্রকাশ করেছে। ‘খেয়াপারের তরণী’ কবিতায় শোনা যায় উদাত্ত আহ্বান:

আবুবকর উমান উমর আলী হায়দর

দাঁড়ি যে এ তরণীর, নাই ওরে নাই ডর!

কাজ্ঞারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা,

দাড়ি-মুখে সারি গান লা- শরীক আল্লাহ্।

একই ভাবে আরেকটি দৃষ্টান্ত :

আমি ছিন্ন মস্তা চণ্ডী আমি রণদা সর্বনাশী

আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি,

যবনিকা: নজরুলের কবিতায় ঐতিহ্যের এরূপ সচেতন স্বচ্ছন্দ শব্দের মিশ্রণ একটি বিশেষ লক্ষণ। বস্তুত, সাম্যবাদের অনুপ্রেরণা ও মানবতাবােধ হতে মুসলিম সম্প্রতি নজরুল মানসের একটি অংশ। নজরুল অতীতকে স্মরণ করেছেন বর্তমানকে পুনর্নির্মাণের হাতিয়ার রূপে। পরিশেষে বলা যায়, কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন জনজীবন সম্পৃক্ত কবি। তাই তার ঐতিহ্যবােধও ছিল জীবন সম্পৃক্ত। অতীত ঐতিহ্যকে তিনি অন্ধভাবে অনুসরণ করেননি বরং, ঐতিহ্যকে সৃষ্টি করেছেন নতুনভাবে নতুন জীবন ভাবনায় । বহুবিস্তারী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন বলেই তিনি একই সঙ্গে ভারতীয় এবং ইসলামি ঐতিহ্য ব্যবহারে পরম সিদ্ধি অর্জন করেছেন। এভাবেই বাংলা কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি নির্মাণ করেছেন এক স্বতন্ত্র মাত্রা।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

প্রমথ চৌধুরী এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম

প্রমথ চৌধুরী (৭ আগস্ট ১৮৬৮ — ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬) বাংলা সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি প্রাবন্ধিক, কবি ও ছোটগল্পকার হিসেবে পরিচিত। তার পৈতৃক নিবাস বর্তমান

Read More
সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ : অস্তিত্ববাদ কী? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য ও জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ, হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ, কিয়ের্কেগার্দ, জেসপার্স, মার্সেলের অস্তিত্ববাদ

অস্তিত্ববাদ অস্তিত্ববাদ একটি দর্শন। দার্শনিক চিন্তার শুরু থেকেই বাস্তববাদ, ভাববাদ, জড়বাদ, যান্ত্রিকবাদ প্রভৃতি দার্শনিক মতবাদগুলো মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কীয় বাস্তব সমস্যার পরিবর্তে বস্তু, ঈশ্বর, তত্ত্ব বা

Read More
নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

নিজের আপন মাকে বিয়ে করল ইডিপাস; শয্যাসঙ্গী হয়ে জন্ম দিল চার সন্তানের

“বিধির লিখন যায় না খনন” – বিধি অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা যার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন তা কখনো খন্ডন করা যায় না সর্ব প্রকার চেষ্টা বা সাধনার

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.