গৌরচন্দ্রিকা: প্রথম মহাযুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল ১৯১৪ সালে, শেষ হলো ১৯১৮ সালে। আর ১৯১৯ সালে সাহিত্যে প্রবেশ করলেন কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯ – ১৯৭৬)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৩৯ সালে; নজরুলের সমগ্র সর্জনাকর্ম আকস্মিক রুদ্ধ হলাে ১৯৪২ সালে। মোটামুটি নজরুলের সৃষ্টিকাজ এই দুই মহাযুদ্ধের ভেতর । এই যে নজরুলের ২৪ বছরের সাহিত্যসাধনা, সত্যি বলতে কি, এর মাত্র অর্ধেক, বছর ১২, নজরুল লিপ্ত ছিলেন কবিতায়। ‘অগ্নি-বীণা’ (১৯২২) কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম কাব্য। এ কাব্যের মূল সুর বিদ্রোহ। সেই বিদ্রোহকে তিনি ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন এ কাব্যে। নিম্নে ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যের বিভিন্ন কবিতায় বাঙালির বিদ্রোহী চেতনা, আত্মচেতনা ও আত্মজাগরণের যে চিত্র প্রকাশ পেয়েছে তার স্বরূপ সন্ধান করা হলো।
মূলপর্ব: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের অস্থির সময় এ কাব্যের পটভূমি। ফলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দ্বারা পদদলিত এদেশে অন্যায় অত্যাচার, বৈষম্য ও শােষণের মধ্যে কৰি সােচ্চার কণ্ঠে প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠেছেন। দেশপ্রেম সমাজনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতি প্রভৃতি বিষয়বস্তুকে আশ্রয় করে কবির বিক্ষোভ, নৈরাশ্য, আশা-উদ্দীপনা কাব্যরূপ পেয়েছে এ কাব্যের প্রতিটি কবিতায়। বিদ্রোহ ও ভাঙনের আহ্বানে এ কাব্য রচিত হলেও এর মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তার বহুমুখী প্রতিভা। ধ্বংসের ভিত্তিভূমিতে সৃষ্টির অনুপ্রেরণার সার্থক যুগ প্রতিনিধিত্ব করেছে নজরুলের বিদ্রোহী সত্তা। সমাজ, সংস্কার প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন তিনি। এই বিদ্রোহজাত শব্দ, ছন্দ, অলঙ্কারের যথার্থ ব্যবহারে আরাে প্রাণময় হয়ে উঠেছে। প্রলয়োল্লাস কবিতায় নজরুল লিখেছেন-
ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর ? –প্রলয় নূতন সৃজন – বেদন! আসছে নবীন — জীবন – হারা অসুন্দরে করতে ছেদন! (প্রলয়োল্লাস)
ঔপনিবেশিক সমাজে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। তিনি জন্মের পর থেকে লক্ষ করেছেন ব্রিটিশদের বিভিন্ন ধরনের শােষণ, নির্যাতন আর অবহেলার শিকার এ ভারতবর্ষের মানুষ। প্রতিনিয়ত ব্রিটিশদের যাতাকলে নিষ্পষ্ট ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ। সেই শােষণ নির্যাতন থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষকে রক্ষা করতেই তিনি বিদ্রোহ ঘােষণা করলেন। যে বিদ্রোহের বাণী ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যের প্রতিটি কবিতায়। অগ্নি-বীণা’ কাব্যে তিনি বলেছেন-
“যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রােল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না।
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত।
আমি সেই দিন হব শান্ত।” (বিদ্রোহী)
অর্থাৎ কবিকে কোনােভাবেই শান্ত করা যাবে না। কারণ এ শােষণ নির্যাতনকে তিনি সহ্য করতে পারেননি। তাইতাে তিনি সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে বিদ্রোহী সত্তা জাগিয়ে তােলার চেষ্টায় ব্যাপৃত হয়েছেন।
’অগ্নি-বীণা’ কাব্যের বারটি কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহের লেলিহান শিখা প্রজ্বলিত করেছেন যা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শােষকদের মর্মমূলে আঘাত করতে পেরেছে। যে আঘাতে তাকে বার বার জেলে বন্দী করে রেখেছে এবং তাদের মর্মমূলে আঘাতকারী সাহিত্যকে তাঁরা নিষিদ্ধ করেছে। তবুও তিনি থেমে যাননি। বিভিন্নভাবে তাকে লােভ দেখানাে হয়েছে। কিন্তু তিনি লােভে বশবর্তী না হয়ে তাঁর জীবনের যে উদ্দেশ্য তা বাস্তবায়নে এগিয়ে গিয়েছে। রক্তাম্বর-ধারিণী মা কবিতায় আমরা পাই-
ধ্বংসের বুকে হাসুক মা তোর
সৃষ্টির নব পূর্ণিমা। (রক্তাম্বর-ধারিণী মা)
কাজী নজরুল ইসলাম এ কাব্যে বিদ্রোহী চেতনাকে ভিন্ন আঙ্গিকে প্রকাশ করেছেন। তিনি মিথ বা পুরাণের আশ্রয় নিয়ে বিদ্রোহকে ফুটিয়ে তুলেছেন। পশ্চিম এশীয় এবং ভারতীয় উভয় অঞ্চলের মিথ ব্যবহারে তিনি দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন। তিনি জনসূত্রে ভারতীয় নাগরিক অপরদিকে ধর্মসূত্রে পশ্চিম এশীয় তথা মুসলমান ধর্মের অনুসারী। যার ফলে তিনি দুই ধর্মের মিথ বা পুরাণ এক সাথে ব্যবহার করে বিটিশ ঔপনিবেশিকদের বিতাড়িত করতে চেয়েছেন। বিদ্রোহী কবিতায় আমরা পাই-
আমি ছিন্নমস্তা চণ্ডী, আমি রণদা সর্ব্বনাশী, আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি! (বিদ্রোহী)
কৰি দুই এতিহ্যকে অসাধারণ দক্ষতার সাথে মিলিয়ে এই কাব্যে ব্যবহার করেছেন।
জাতীয়তার সূত্রে কাজী নজরুল ইসলাম ভারতবর্ষীয়। তাই তিনি তার বিদ্রোহ প্রকাশ করতে ভারতীয় পুরাণ ঐতিহ্যের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। ঘুমন্ত বাঙালি সমাজকে জাগ্রত করার জন্য তিনি যে ভারতীয় ঐতিহ্যের ব্যবহার করেছেন তা যৌবন ও তারুণ্যের প্রতীক হিসেবে এসেছে। তিনি ব্যবহার করেছেন বিষ্ণু, পরশুরাম, ভৃগু, ভীম, চণ্ডাল, পূর্বাসা, চণ্ডী, শ্যাম, বলরাম, বিশ্বামিত্র প্রভৃতি ভারতীয় পুরাণ।
প্রকৃতপক্ষে পুরাণ বা মিথগুলাে সুপ্ত বা ঘুমন্ত । কিন্তু নজরুল সেই ঘুমন্ত প্রতিমাগুলাের মধ্য থেকে শক্তি সঞ্চয় করেছেন। যে শক্তি শােষক শ্রেণির বিরুদ্ধে প্রয়ােগ করেছেন-
“আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে একে দিই পদচিহ্ন।” (বিদ্রোহী)
অর্থাৎ নিদ্রিত নারায়ণ ভগবান বিষ্ণুর বুকে পদাঘাত করে জাগিয়ে ছিলেন ভৃণ্ড। কবি তেমনি আঘাত করে ঘুমন্ত বাঙালিকে জাগিয়ে তুলতে চান।
তাছাড়া কবি স্বৈরাচারী ব্রিটিশ শাসকদের বিতাড়িত করতে ব্যবহার করেছেন পরশুরামের’ কুঠার।
“আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার,
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার” (বিদ্রোহী)
কবি ভারতীয় ঐতিহ্য থেকে পরশুরামের কঠোর কুঠারকে প্রতীকী ব্যবহার করেছেন সমগ্র অন্যায় অত্যাচার নিঃশেষ করে সারা বিশ্বে শান্তি আনয়নের জন্য।
তাছাড়া কবি, ধূর্জটি, ব্যোমকেশ, বীণাপাণি, শিব আরও অনেক ভারতীয় ঐতিহ্য পুরাণ ব্যবহার করেছেন। এ পুরাণ ঐতিহ্য ব্যবহার করে ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশদের উচ্ছেদ করতে সমগ্র জাতির ঘুমন্ত মানুষের ভিতরে বিদ্রোহের আগুন জ্বালাতে চেষ্টা করেছেন। বিদ্রোহী কবিতায় আমরা পাই-
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তুৰ্য্য। (বিদ্রোহী)
কবির কথা আমরা কেন পরাধীন থাকব। মা, মাটি, মানুষ সবই আমাদের, শুধু শাসক বা শােষক হল ভিন দেশি, আমরা তা মেনে নিতে পারি না। এ ভাবনা কবিকে আজীবন ভাবিয়ে তুলেছে। তিনি নিজে যুদ্ধ করেছেন সেই সাথে যুদ্ধের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। তিনি ছিলেন সাহসী সৈনিক।
যবনিকা: রবীন্দ্র যুগে বসবাস করে রবীন্দ্র বলয় থেকে মুক্ত হয়ে যাঁরা বাংলা সাহিত্যের নতুন পথ তৈরি করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্য বিদ্রোহ ও ভাঙনের আহ্বানে রচিত হলেও এর মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বহুমুখী প্রতিভা। ধ্বংসের ভিত্তিভূমিতে সৃষ্টির অনুপ্রেরণার সার্থক যুগ প্রতিনিধিত্ব করেছে নজরুলের বিদ্রোহী সত্তা। সমাজ, সংস্কার ও পৃষ্ঠা প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন তিনি। এই বিদ্রোহজাত শব্দ ছন্দ, অলঙ্কারের যথার্থ ব্যবহারে আরাে প্রাণময় হয়ে উঠেছে।