মূলপর্ব: ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৩২৮ সালের কার্তিকে, ২য় বর্ষের ৩য় সংখ্যক ‘মােসলেম ভারত’ পত্রিকায়। কবিতাটি রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের দুর্গাপূজার কাছাকাছি সময়ে। কবিতাটি রচনার উৎস সম্পর্কে মুজাফফর আহমদ বলেছেন, মােহিত লাল মজুমদার তাঁর ‘আমি’ শীর্ষক একটি কথিকা নজরুলকে পড়ে শােনান। তিনি দাবী করেন, ‘আমি’র ভাবসম্পদ ধার করেই নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি রচনা করেন।
‘আমি’ কথিকার অংশ বিশেষ উল্লেখ করা যেতে পারে: “আমি ভীষণ-অমানিশীথের সমুদ্র, শ্মশানের চিতাগ্নি, সৃষ্টি নেপথ্যের ছিন্নমস্তা, কালবৈশাখীর বক্ষাগ্নি, হত্যাকারীর স্বপ্নবিভীষিকা ব্রাহ্মণের অভিশাপ, দম্ভান্ধ পিতৃরােষ।”
নজরুল সাহিত্য সমালােচক ড. সুশীল কুমার গুপ্ত বলেন— ‘বিদ্রোহী’ কবিতার সঙ্গে ‘আমি’ কর্থিকার মিল রয়েছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবােধের দিক দিয়ে। আমি’ কথিকাটি পড়ে বােঝা যায়‘আমি’র মধ্যে দার্শনিক মনােভাব প্রবল; কিন্তু ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি অনেকখানি সামাজিক ও রাজনীতিক চেতনা সম্পন্ন। একথা সর্বজনস্বীকৃত যে, একটি রচনার প্রেরণা থেকে অন্য একটি উঁচুদরের রচনা জন্মগ্রহণ করতে পারে। এক্ষেত্রে ‘আমি’ যদি ‘বিদ্রোহী’কে কিঞ্চিৎ প্রেরণা যুগিয়ে থাকে তাহলেও ‘বিদ্রোহী’ বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। জীবনবােধে ‘বিদ্রোহী’ ‘আমি’র চেয়ে উদ্ধৃষ্টতর রচনা।”
এই কবিতাটির জন্যে নজরুলের ওপর অজস্র ব্যঙ্গবিদ্রুপ বর্ষিত হয়। কিন্তু এসব ব্যঙ্গবিদ্রুপ নজরুলের পক্ষে শাপেবর হয়ে দাঁড়ায়। কবিতাটি বহুল আলােচিত হওয়ায় অভূতপূর্ব প্রচারের সৌভাগ্য লাভ করে। নজরুলের পরিচিতি এবং খ্যাতি দুই-ই বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায় এই কবিতাটির জন্যে। বিভিন্ন সাহিত্য সমালােচক ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মূলভাব ব্যাখ্যা করে বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন।
কেউ কেউ বলেছেন, নজরুলের বিদ্রোহে রাজনীতিক ও সমাজনীতিক চেতনার স্বাক্ষর থাকলেও তা মূলত রােমান্টিক। রােমান্টিসিজমের অনেকটা স্বাধীনতা থাকে, কিন্তু এই কবিতার রােমান্টিক বিদ্রোহ অনেকক্ষেত্রে ঐ চিত্তের সীমা লংঘন করেছে।
আবার কেউ কেউ বলেছেন, ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকৃতই কোনাে বিদ্রোহের বাণীর বাহক নয়, এর মর্মকথা হচ্ছে এক অপূর্ব উন্মাদনা- এক অভূতপূর্ব আত্মবােধ, সেই আত্মবােধের প্রচণ্ডতায় ও ব্যাপকতায় কবি উচ্চকিত- প্রায় দিশেহারা।
প্রকাশভঙ্গির দিক দিয়ে বলা যায়, এই কবিতার ভাষা শুধু অর্থপূর্ণ ভাষা না হয়ে যেন কতগুলি ভাবের অভিব্যক্তি ব্যঞ্জক ইঙ্গিতমাত্র হয়ে উঠেছে। সুসংবদ্ধ অর্থ সর্বত্র খুঁজে না পাওয়া গেলেও কবির উচ্ছাস হৃদয় দিয়ে তা অনুভবগম্য। এইভাবে বিচার করলে বলা যায়, ‘বিদ্রোহী’ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিম্বলিক (symbolic) কবিতা। নজরুলের এই সার্থক সিম্বলিকতার মূলে কাজ করেছে তার দুর্দান্ত পৌরুষ, উদ্দাম উন্মুক্ত হৃদয়াবেগ এবং বীর্যবন্ত চির উন্নত শির অহমিকা (egotism)। এই অহমিকার উদগ্রতম প্রকাশের সার্থক রূপায়ণ ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দ্বারা পদদলিত এদেশ দীর্ঘকাল শাসন-শােষণ, অন্যায়-অবিচার আর বৈষম্যের পঙ্কিলতায় আচ্ছন্ন থেকেছে। একজন যথার্থ কবি তাঁর সমাজ, দেশ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির মধ্যে শিকড় ছড়িয়ে দিয়ে যে রস গ্রহণ করেন। তাই তাঁর কাব্য ফসলের প্রাণশক্তি। সমাজ সচেতন কবি তাই সমাজ, রাষ্ট্রের অবিচার ও বৈষম্যের প্রতি তার বিপ্লবী মনের প্রতিবাদ জানাতে কুণ্ঠিত নন। পৃথিবীজুড়ে যে অন্যায়, অবিচার আর বৈষম্য- তার বিরুদ্ধে তাঁর এই বিদ্রোহ, প্রতিবাদ উচ্চকিত থাকবে, যতদিন না তার মূল উৎপাটিত হবে।
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রােল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ ভূমি রণিবে না,
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত। (বিদ্রোহী)
এই সূত্রে আমেরিকার জাতীয় কবি হুইটম্যানের One’s-self I sing নামে একটি অনবদ্য কবিতার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। কবিতাটি রাজনীতিক ও সামাজিক চেতনায় উদ্বোধিত মানবচিত্তের ঘােষণা। Whitman-এর প্রভাব নজরুল ইসলামের উপর অত্যন্ত বেশি স্পষ্ট, দীপ্ত ও প্রত্যক্ষ। বিদ্রোহ, বিপ্লব ও যৌবনের আবেগ যেখানে তাঁর কাব্যের উপপাদ্য হয়েছে, সেখানেই তিনি Whitman-কে অনুসরণ করেছেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের অস্থির সময় এ কাব্যের পটভূমি। ফলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দ্বারা পদদলিত এদেশে অন্যায় অত্যাচার, বৈষম্য ও শােষণের মধ্যে কৰি সােচ্চার কণ্ঠে প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠেছেন। দেশপ্রেম সমাজনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতি প্রভৃতি বিষয়বস্তুকে আশ্রয় করে কবির বিক্ষোভ, নৈরাশ্য, আশা-উদ্দীপনা কাব্যরূপ পেয়েছে এ কাব্যের প্রতিটি কবিতায়। বিদ্রোহ ও ভাঙনের আহ্বানে এ কাব্য রচিত হলেও এর মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তার বহুমুখী প্রতিভা। ধ্বংসের ভিত্তিভূমিতে সৃষ্টির অনুপ্রেরণার সার্থক যুগ প্রতিনিধিত্ব করেছে নজরুলের বিদ্রোহী সত্তা। সমাজ, সংস্কার প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন তিনি। এই বিদ্রোহজাত শব্দ, ছন্দ, অলঙ্কারের যথার্থ ব্যবহারে আরাে প্রাণময় হয়ে উঠেছে। বিদ্রোহী কবিতায় নজরুল লিখেছেন-
“যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রােল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না।
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত।
আমি সেই দিন হব শান্ত।” (বিদ্রোহী)
অর্থাৎ কবিকে কোনােভাবেই শান্ত করা যাবে না। কারণ এ শােষণ নির্যাতনকে তিনি সহ্য করতে পারেননি। তাইতাে তিনি সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে বিদ্রোহী সত্তা জাগিয়ে তােলার চেষ্টায় ব্যাপৃত হয়েছেন।
ঔপনিবেশিক সমাজে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। তিনি জন্মের পর থেকে লক্ষ করেছেন ব্রিটিশদের বিভিন্ন ধরনের শােষণ, নির্যাতন আর অবহেলার শিকার এ ভারতবর্ষের মানুষ। প্রতিনিয়ত ব্রিটিশদের যাতাকলে নিষ্পষ্ট ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ। সেই শােষণ নির্যাতন থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষকে রক্ষা করতেই তিনি বিদ্রোহ ঘােষণা করলেন। যে বিদ্রোহের বাণী ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যের প্রতিটি কবিতায়।
কাজী নজরুল ইসলাম এ কাব্যে বিদ্রোহী চেতনাকে ভিন্ন আঙ্গিকে প্রকাশ করেছেন। তিনি মিথ বা পুরাণের আশ্রয় নিয়ে বিদ্রোহকে ফুটিয়ে তুলেছেন। পশ্চিম এশীয় এবং ভারতীয় উভয় অঞ্চলের মিথ ব্যবহারে তিনি দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন। তিনি জনসূত্রে ভারতীয় নাগরিক অপরদিকে ধর্মসূত্রে পশ্চিম এশীয় তথা মুসলমান ধর্মের অনুসারী। যার ফলে তিনি দুই ধর্মের মিথ বা পুরাণ এক সাথে ব্যবহার করে বিটিশ ঔপনিবেশিকদের বিতাড়িত করতে চেয়েছেন। বিদ্রোহী কবিতায় আমরা পাই-
আমি ছিন্নমস্তা চণ্ডী, আমি রণদা সর্ব্বনাশী,
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি! (বিদ্রোহী)
কৰি দুই এতিহ্যকে অসাধারণ দক্ষতার সাথে মিলিয়ে এই কাব্যে ব্যবহার করেছেন।
জাতীয়তার সূত্রে কাজী নজরুল ইসলাম ভারতবর্ষীয়। তাই তিনি তার বিদ্রোহ প্রকাশ করতে ভারতীয় পুরাণ ঐতিহ্যের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। ঘুমন্ত বাঙালি সমাজকে জাগ্রত করার জন্য তিনি যে ভারতীয় ঐতিহ্যের ব্যবহার করেছেন তা যৌবন ও তারুণ্যের প্রতীক হিসেবে এসেছে। তিনি ব্যবহার করেছেন বিষ্ণু, পরশুরাম, ভৃগু, ভীম, চণ্ডাল, পূর্বাসা, চণ্ডী, শ্যাম, বলরাম, বিশ্বামিত্র প্রভৃতি ভারতীয় পুরাণ।
প্রকৃতপক্ষে পুরাণ বা মিথগুলাে সুপ্ত বা ঘুমন্ত । কিন্তু নজরুল সেই ঘুমন্ত প্রতিমাগুলাের মধ্য থেকে শক্তি সঞ্চয় করেছেন। যে শক্তি শােষক শ্রেণির বিরুদ্ধে প্রয়ােগ করেছেন-
“আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে একে দিই পদচিহ্ন।” (বিদ্রোহী)
অর্থাৎ নিদ্রিত নারায়ণ ভগবান বিষ্ণুর বুকে পদাঘাত করে জাগিয়ে ছিলেন ভৃণ্ড। কবি তেমনি আঘাত করে ঘুমন্ত বাঙালিকে জাগিয়ে তুলতে চান।
তাছাড়া কবি স্বৈরাচারী ব্রিটিশ শাসকদের বিতাড়িত করতে ব্যবহার করেছেন পরশুরামের’ কুঠার।
“আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার,
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার” (বিদ্রোহী)
কবি ভারতীয় ঐতিহ্য থেকে পরশুরামের কঠোর কুঠারকে প্রতীকী ব্যবহার করেছেন সমগ্র অন্যায় অত্যাচার নিঃশেষ করে সারা বিশ্বে শান্তি আনয়নের জন্য।
তাছাড়া কবি, ধূর্জটি, ব্যোমকেশ, বীণাপাণি, শিব আরও অনেক ভারতীয় ঐতিহ্য পুরাণ ব্যবহার করেছেন। এ পুরাণ ঐতিহ্য ব্যবহার করে ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশদের উচ্ছেদ করতে সমগ্র জাতির ঘুমন্ত মানুষের ভিতরে বিদ্রোহের আগুন জ্বালাতে চেষ্টা করেছেন। বিদ্রোহী কবিতায় আমরা পাই-
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তুৰ্য্য। (বিদ্রোহী)
যবনিকা: রবীন্দ্র যুগে বসবাস করে রবীন্দ্র বলয় থেকে মুক্ত হয়ে যাঁরা বাংলা সাহিত্যের নতুন পথ তৈরি করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বিদ্রোহী কবিতায় বিদ্রোহ ও ভাঙনের আহ্বানে রচিত হলেও এর মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বহুমুখী প্রতিভা। ধ্বংসের ভিত্তিভূমিতে সৃষ্টির অনুপ্রেরণার সার্থক যুগ প্রতিনিধিত্ব করেছে নজরুলের বিদ্রোহী সত্তা। সমাজ, সংস্কার ও পৃষ্ঠা প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন তিনি। এই বিদ্রোহজাত শব্দ ছন্দ, অলঙ্কারের যথার্থ ব্যবহারে আরাে প্রাণময় হয়ে উঠেছে।