Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

কাজী নজরুল ইসলামের ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্য-পরিচিতি, মূলভাব, নামকরণ, আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য, শিল্পমূল্য ও সাহিত্যমূল্য বিচার এবং সম্পূর্ণ আলোচনা ও সমালোচনা

নজরুল ইসলামের সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ এবং সর্বাধিক প্রচারিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নি-বীণা’ প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের কার্তিক মাসে। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে “ভাঙা-বালার রাস্তা-যুগের আদি পুরােহিত, সাগ্নিক বীর শ্রীবারীন্দ্রকুমার ঘােষ শ্রীশ্রীচরণারবিন্দেষু”। উৎসর্গপত্রের গানটি ‘অগ্নিঋষি’ নামে ১৩২৮ সালের শ্রাবণ মাসের ‘উপাসনায় আত্মপ্রকাশ করে।  

‘অগ্নি-বীণা’ কাব্য-পরিচিতি

‘অগ্নি-বীণা’ প্রকাশিত হয় ১৩২৯ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে (অক্টোবর ১৯২২)। প্রকাশক : গ্রন্থকার, ৭ প্রতাপ চাটুজ্যে লেন, কলিকাতা; প্রকাশকরূপে অনেক ক্ষেত্রে উল্লিখিত হয়েছেন শরৎচন্দ্র গুহ, আর্য পাবলিশিং হাউজ, কলেজ স্ট্রিট মার্কেট, কলিকাতা। পৃ. ২+৬৬; দাম এক টাকা।

এই কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩৩০ বঙ্গাব্দের আশ্বিনে, তৃতীয় সংস্করণ ১৩৩৩-এর অগ্রহায়ণে এবং চতুর্থ সংস্করণ ১৩৩৫-এর শ্রাবণে। কবির সুস্থাবস্থায় প্রকাশিত অগ্নি-বীণার যে কটি সংস্করণ প্রকাশিত হয় তারমধ্যে চতুর্থ সংস্করণই সর্বশেষ। এর প্রকাশক ছিলেন ডি এম লাইব্রেরির পক্ষে গােপাল দাস মজুমদার, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪+৫৮, মূল্য পাঁচ সিকা; মুদ্রণসংখ্যা ২২০০।
‘প্রলয়ােল্লাস’ কবিতাটি ১৩২৯ জ্যৈষ্ঠের “প্রবাসী’তে প্রকাশিত হয়েছিল এবং প্রবাসী’ থেকে ১৩২৯ আষাঢ়ের ‘নারায়ণ’-এ সংকলিত হয়েছিল।
বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ১৩২৮ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসের ২য় বর্ষের ৩য় সংখ্যক ‘মােসলেম ভারত’-এ প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৩২৮ সালের ২২শে পৌষের সাপ্তাহিক ‘বিজলী’-তে এবং ১৩২৮ মাঘের ‘প্রবাসী’তে এই কবিতাটি সংকলিত হয়েছিল। ‘রক্তাম্বরধারিনী মা’ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ৫ই ভাদ্র তারিখে ১ম বর্ষের ৪র্থ সংখ্যক ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায়।
‘আগমনী ১৩২৮ আশ্বিনের ‘উপাসনায়’ প্রকাশিত হয়েছিল। এ সম্পর্কে ‘উপাসনা’-সম্পাদক শ্রীসাবিত্রী প্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “নজরুলের এক বিশিষ্ট দিকের কবিতা ‘শাতিল আরব’ যখন ‘মােসলেম ভারতে প্রকাশ হয়, প্রায় ঠিক সেই সময়ে হিন্দুর দেব-দেবী নিয়ে প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ‘উপাসনা’য়- এ কি রণ বাজা বাজে ঝনঝন।” (কবিতা, কার্তিক-পৌষ, ১৩৫১)।
‘আগমনী’ ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ৯ই আশ্বিন তারিখের ‘ধূমকেতু’তে পুনর্মুত্রিত হয়েছিল।
‘ধূমকেতু’ শীর্ষক কবিতাটি ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২৬শে শ্রাবণ (১৯২২, ১১ই আগস্ট) ১ম বর্ষের ১ম সংখ্যক অর্ধ-সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু পত্রিকায় (যার সারথি ও স্বত্বাধিকারী : কাজী নজরুল ইসলাম) প্রকাশিত হয়েছিল।
‘কামাল পাশা’ ১৩২৮ কার্তিকের ‘মােসলেম ভারতে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২৬শে ভদ্র তারিখের ‘ধূমকেতু পত্রিকায় কবিতাটির কিছু অংশ সংকলিত হয়েছিল।
‘আনােয়ার ১৩২৮ কার্তিকেয় এবং রণভেরী’ ১৩২৮ আশ্বিনের সাধনা” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
‘শাহ্-ইল-আৱৰ ছাপা হয়েছিল ১৩২৭ জ্যৈষ্ঠের ‘মােসলেম ভারতে। সে সংখ্যার Frontispiece রূপে শােভিত হয়েছিল। শাতিল্‌-আরবের চিত্র, তার নিচে Caption হিসেবে ছাপা হয়েছিল কবিতাটির প্রথম দুই চরণ।

“সাতিল-আরব! সাতিল আরব! পূত যুগে যুগে তােমার তীর
শহীদের লােহু দিলীল্পের খুন ঢেলেছে যেখানে আরব-বীর।”
‘মােসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশকালে এবং প্রথম সংস্করণে ‘সাত-ইল আরব’ মুদ্রিত হয় ‘দস্থ্য স’ দিয়ে। চতুর্থ সংস্করণে ব্যবহৃত হয়েছে তালব্য ‘শ’ ‘শাত-ইল-আরব’ বা ‘শাতিল আরব’।
‘খেয়া-পারের তরণী’ ছাপা হয়েছিল ১৩২৭ শ্রাবণের মােসলেম ভারতে। সে সংখ্যায় গােড়ায় শােভিত হয়েছিল একখানি চিত্র। তার Caption এ ছাপা হয়েছিল :
“বৃথা ত্রাসে প্রলয়ের সিন্ধু ও দেয়াভার,
ঐ হলাে পুণ্যের যাত্রীরা খেয়া-পার।”
খেয়া-পারের তরণী প্রসঙ্গে মুজাফফর আহমদ লিখেছেন, “কী কারণে জানিনা, আফজালুল হক সাহেব ঢাকা গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর ‘মােসলেম ভারতে’ ছাপানাের উদ্দেশ্যে ঢাকার বেগম মুহম্মদ আজম সাহেবের (খান বাহাদুর মুহম্মদ আজমের স্ত্রী) আঁকা একখানা নৌকার ছবি সঙ্গে নিয়ে আসেন। তার জন্যে ছবিখানা একদিন বিকাল বেলা নজরুল ইসলামের নিকটে আফজালুল হক সাহেব রেখে গেলেন। তিনি আশা করেছিলেন যে, নজরুল ইসলাম গদ্যে এই আধ্যাত্নিক ছবিখানার একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় লিখে দিবেন। কিন্তু নজরুল তা করলেন না। সে রাত্রিবেলা প্রথমে মনােযােগ সহকারে ছবিখানা অধ্যয়ন করলেন এবং তারপরে লিখলেন এই ছবির বিষয়ে তার বিখ্যাত কবিতা ‘খেয়াপারের তরণী’।“(কাজী নজরুল ইসলাম, স্মৃতিকথা, দ্বিতীয় বাংলাদেশ সংস্করণ, ঢাকা ১৯৭৬, পৃ. ৫৩-৫৪)
‘কোরবানী’ ছাপা হয়েছিল ১৩২৭ ভাদ্রের ‘মােসলেম ভারতে’। এ কবিতাটি রচনার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খান লিখেছেন, “তারিকুল আলম বলে একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ‘কোরবানী’-কে বর্বরযুগের চিহ্ন বলে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এ প্রবন্ধ পড়ে নজরুল ইসলামের কলম গর্জে উঠল। নব্য তুর্কীরা তখন স্বাধীনতার জন্যে অকাতরে জান কোরবান। করছিল। সেই ব্যাপারের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি লিখলেন:
“ওরে হত্যা নয়, আজ সত্যাহ শক্তির উদ্বােধন।”
“মােহম’ ছাপা হয়েছিল ১৩২৭ আশ্বিনের ‘মােসলেম ভারতে’। সে সংখ্যার গােড়ায় ছিল একটি ছবি, তার উপরে লেখা ছিল কারবালা প্রান্তরে ইমাম হােসেনের সমাধি।’ ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ১৬ই ভাদ্র তারিখের বিশেষ মােহররম সংখ্যা ‘ধূমকেতু’তে কবিতাটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল। উৎসর্গ পত্রটি ছাড়া মােট ১২টি কবিতা নিয়ে ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যাকারে প্রকাশিত হয়।

‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যের নামকরণ

নামকরণ একটি শিল্প। কাব্যের বিষয়বস্তু, ভাবসম্ভার, অন্তর্নিহিত তাৎপর্য জগৎ ও জীবন সম্পর্কে কবির উপলব্ধি-জাত চিন্তাচেতনার যে প্রকাশ তাই এ কাব্যের নামকরণের ক্ষেত্রে তাৎপর্য বয়ে এনেছে। তবে সংক্ষিপ্ত অথচ শ্রুতিমধুর নামকরনের মধ্যে কাব্যের অধিকাংশ কবিতার যদি প্রতিফলন থাকে তাহলেই নামকরণ সার্থক হয়।
জীবনের সঙ্গে শিল্প-সাহিত্যের যে একটা অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ রয়েছে একথা সর্বজনস্বীকৃত। জীবনের ভিত্তি যখন নড়ে যায়, যখন এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আঘাতে জীবনের প্রাচীন অর্থ ও আদর্শ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, জীবনাকাশে যখন বিচিত্র রঙ্গের রােমান্স ঢেউ তােলে তখন শিল্পের ও রূপান্তর ঘটতে বাধ্য। জীবনের গতিবেগের সঙ্গে সাহিত্য তখন স্বচ্ছন্দে মিলিত হয়ে যায়। নজরুলের সাহিত্য কর্মে জীবনের এই গতিবেগের মিলিত রূপ দেখতে পাই। নজরুল যখন বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বাংলাদেশে প্রথম মহাযুদ্ধের অভিন্নতা নিয়ে এলেন তখন একদিকে সমগ্র বাংলায় তথা ভারতবর্ষে এক বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, বুদ্ধিজীবীদের উপর সাম্রাজ্যবাদের ক্ষেপ, জালিয়ানওয়ালাবাগে নিরস্ত্র নরনারীর রক্তে রক্তাক্ত রাজপথ, যুদ্ধের ফলে দুনিয়াজোড়া অর্থনৈতিক সংকট, বেকার সমস্যা প্রভৃতির চাপে মধ্যবিত্ত সমাজের সাজানাে বাগানে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। রুশ বিপ্লব এবং তৎকালীন ইউরােপের ব্যক্তিস্বার্থ শ্রেণীবাদী লেখকদের প্রভাবে পুরানাে আমলের ধ্যান-ধারণার বুনিয়াদ অবিশ্বাসের তীব্র আঘাত, মৃত্যু, দুঃখ, বেদনার মধ্য দিয়ে বৃহৎ নবযুগের রক্তাক্ত অরুণােদয় আসন্ন। সংকটাপন্ন বুদ্ধিবাদ তখন পথ খুঁজছে নতুন দিকে, নতুন বাস্তব অবস্থাকে আত্মসাৎ করবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ফিরছিল। নজরুল এ অবস্থায় তার অগ্নি-বীণা হাতে নিয়ে বিদ্রোহী বেশে বাংলাসাহিত্যের অঙ্গনে আবির্ভূত হলেন। রবীন্দ্র বিরােধিতার ক্ষেত্রে প্রথম বলিষ্ঠ কণ্ঠ তারই। জনজীবনের সঙ্গে কাব্যকে সার্থকভাবে যুক্ত করার প্রথম গেীরব বহুলাংশে তিনিই দাবি করতে পারেন। বাংলা কাব্যের বিদ্রোহ, পেীরুষ ও যৌবনের অগ্রগণ্য ভাষ্যকারদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
নজরুলের আবির্ভাব তাই একটা আকস্মিক ঘটনা নয়, তিনি যুগমানসের প্রতীক। সমকালীন যুগের মানস-সস্তান। নজরুলের বিদ্রোহের এমন একটা স্বাতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে যা সকল সুর, সকল কণ্ঠ অতিক্রম করে আমাদের কর্ণগােচর হয়েছে।
নজরুল মানুষের কবি ছিলেন। মানুষ ও মানবতাই তার জীবনমন্ত্র ছিল। এদেশের দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত অসহায়, অত্যাচারিত, শােষিত জনগণের মূঢ় হৃদয়ের কথা তিনি এ কাব্যে বিষয়বস্তু করেছেন। মুসলমান হয়েও তিনি নিজেকে ধর্মবর্ণ গােত্রের কোনাে সংকীর্ণ গন্ডিতে বেঁধে রাখেননি। তিনি আজীবন হিন্দু মুসলমানের ক্ষুদ্র মুখােশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা চিরন্তন মানবাত্মার সন্ধান করেছেন এ কাব্যে তিনি তারই জয়গান করেছেন। সমাজের কুটি এবং লাঞ্ছনা, সরকারি স্বৈরাচার এবং কারাগারের বন্দী জীবনও নজরুলকে সত্য সাধনার পথ থেকে বিচলিত করতে পারেনি। প্রচলিত কোনাে বিশেষ মতে বিশ্বাস স্থাপনের পরিবর্তে তিনি নিয়ম ও প্রথার গন্ডিকে ভেছে সত্যাসত্য ও সুন্দরের আহ্বানে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছেন। মনুষ্যত্বের পূজারী কবি একদিকে এ কাব্যে মানবতার বেদনাকেই ভাষা ও ছন্দে রূপায়িত করেছেন একদিকে, অপরদিকে জাতিভেদের উর্ধ্বে উঠে এ কবির বুকে বাঙালি জাতির প্রতি অপমান অব্যক্ত বেদনার ভারে ফেনিয়ে উঠেছে। এজন্যেই তিনি সমগ্র বাঙালি জাতিকে সেদিন এই নৰকাব্য প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে তুলতে পেরেছেন।
১৩৩১ বঙ্গাব্দের (১৯২৪) শ্রাবণ মাসের ‘বঙ্গবাণী’তে অগ্নি-বীণার নামকরণ সম্পর্কে বলা হয়, “কবিতাগুচ্ছের অগ্নি-বীণা নাম সার্থক হয়েছে; কবিতাগুলির ছত্রে ছত্রে আগুনের ফুলকি ছুটিয়াছে, আর কোথাও না সে আগুন দাউ দাউ করিয়া জুলিয়াছে।”
তখনকার দিনের অন্যতম অভিজাত মাসিক পত্রিকা ‘প্রবাসী’তে এই গ্রন্থটি সম্পর্কে বলা হয়, “গ্রন্থখানির সব কবিতাগুলিই অগ্নিগর্ভ, উদ্দীপনাময়। যে যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়াইয়া ভারতবর্ষ আজ আপনার ভাগ্য গড়িয়া তুলিতে চাহিতেছে সেই যুগ-নির্মাতা রুদ্র-দেবতার আগমনধ্বনি গ্রন্থখানিতে শুনতে পাওয়া যায়।”
মুসলমান সমাজের এক রক্ষণশীল অংশ অগ্নি-বীণা কাব্যগ্রন্থকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেছিলেন। তাঁদের কাছে নজরুল ইসলাম ধর্মের শত্রু ও তৌহীদের মূল উৎপাটন করে পৌত্তলিকতা-প্রতিষ্ঠায় তৎপর। অর্থাৎ বিদ্রোহী কবিতাটির জন্যে নজরুলের উপর অজস্র ব্যঙ্গপি বর্ষিত হয়। কিন্তু এইসব ব্যঙ্গপি নজরুলের পক্ষে শাপে বর হয়ে দাঁড়ায়। এ কাব্যে কবির বিদ্রোহে রাজনীতির ও সমাজনীতিক চেতনার স্বাক্ষর থাকলেও তা মূলত রােমান্টিক। প্রকৃত অর্থে এ কাব্য বিদ্রোহ ৰাণীর বাহক নয়, এর মর্মকথা হচ্ছে এক অপূর্ব উন্মাদনা- এক অভূতপূর্ব আত্মবােধ, সেই আত্মবােধের প্রচণ্ডতায় ও ব্যপকথায় কবি দিশেহারা। এ কারণেই এ কালে অগ্নি থাকলেও সে অগ্নি-বীণায় পরিণত হয়েছে। ফলে নামকরণটি বিষয়ানুগ ও সার্থক হয়েছে।
নজরুলের জীবন গতানুগতিক পথ ধরে চলেনি। তাই তাঁর সৃষ্টিও বৈচিত্র্যে ভরে উঠেছিল। তিনি বাঙলার কোমলকান্ত ও নিস্তেজম্লান জীবনে নতুন উদ্দীপনা ও উৎসাহের সঞ্চার করে তাকে বৃহত্তর মুক্ত জীবনের ডাক শুনিয়েছিলেন। জনজাগরণের এই মহৎকাজ তিনি সম্পন্ন করেছেন বলেই মহাকালের কাছে অমরতার স্বীকৃতি পেয়েছেন। ‘অগ্নি-বীণা’ তাই নামকরন তাৎপর্যে সার্থক ও সফল।

‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যের মূলভাব

নজরুল ইসলামের সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ এবং সর্বাধিক প্রচারিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নি-বীণা’ প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের কার্তিক মাসে। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে “ভাঙা-বালার রাস্তা-যুগের আদি পুরােহিত, সাগ্নিক বীর শ্রীবারীন্দ্রকুমার ঘােষ শ্রীশ্রীচরণারবিন্দেষু”। উৎসর্গপত্রের গানটি ‘অগ্নিঋষি’ নামে ১৩২৮ সালের শ্রাবণ মাসের ‘উপাসনায় আত্মপ্রকাশ করে। গানটির দুটি স্তবকের প্রথমটি লক্ষণীয় ।

“অগ্নি-ঋষি! অগ্নি-বীণা তােমায় শুধু সাজে
তাই ত তােমার বহ্নি-রাগেও বেদন-বেহাগ বাজে।।
দহন-বনের গহন-চারী-
হায় ঋষি কোন্ বংশীধারী
নিঙ্ড়ে আন আন্‌লে বারি।
অগ্নি-মর মাঝে।
সর্বনাশা কোন্ বাঁশী সে বুঝতে পারি না যে।”
উৎসর্গ গানটি ছাড়া মােট ১২টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে এ গ্রন্থ। কবিতাগুলাে প্রলয়ােল্লাস, বিদ্রোহী, রক্তাম্বরধারিনী মা, আগমনী, ধূমক্ষেত, কামাল পাশা, আনােয়ার, রণ-ভেরী, শাহ্-ই-আরল, খেয়া-পারের তরণী, কোরবানী ও মোহররম।
এই গ্রন্থেরই শুধু নয়, নজরুলের সকল কবিতার মধ্যে ও অন্যতম উল্লেখযােগ্য কবিতা হচ্ছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি। সেসময়ে এত আলােড়ন তুলেছিল যে, এই বিশেষণটি এখনাে নজরুলের নামের আগে একটি ভূষণের মতাে শােভা বর্ধন করছে। মূলত এই কবিতাটি নজরুলের জীবনও কবি মানসের এক বিশেষ প্রতিনিধি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের অস্থির সময় এ কাব্যের পটভূমি। ফলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দ্বারা পদদলিত এদেশে অন্যায় অত্যাচার, বৈষম্য ও শােষণের মধ্যে কৰি সােচ্চার কণ্ঠে প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠেছেন। দেশপ্রেম সমাজনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতি প্রভৃতি বিষয়বস্তুকে আশ্রয় করে কবির বিক্ষোভ, নৈরাশ্য, আশা-উদ্দীপনা কাব্যরূপ পেয়েছে এ কাব্যের প্রতিটি কবিতায়। বিদ্রোহ ও ভাঙনের আহ্বানে এ কাব্য রচিত হলেও এর মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তার বহুমুখী প্রতিভা। ধ্বংসের ভিত্তিভূমিতে সৃষ্টির অনুপ্রেরণার সার্থক যুগ প্রতিনিধিত্ব করেছে নজরুলের বিদ্রোহী সত্তা। সমাজ, সংস্কার ও পৃষ্ঠা প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন তিনি। এই বিদ্রোহজাত শব্দ ছন্দ, অলঙ্কারের যথার্থ ব্যবহারে আরাে প্রাণময় হয়ে উঠেছে।
এ কাব্যের হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্য রূপায়নের ক্ষেত্রে নজরুলের পারদর্শিতা প্রশংসনীয়। একই কবিতায় ভাৰসৌন্দর্যের জন্য হিন্দু প্রতীক ও মুসলমান মহাপুরুষদের নাম গ্রহণে তিনি কুষ্ঠাবােধ করেননি। তিনি উভয় ঐতিহ্য থেকে অবলীলাক্রমে বিষয়, উপমা, রূপক এমনকি বাকভঙ্গি পর্যন্ত আহরণ করেছেন। বিদ্রোহী কবিতায় এর সার্থক রূপায়ণ লক্ষণীয়-
আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস, 
আমি       আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ।
আমি বজ্র, আমি ইশান-বিষাণে ওঙ্কার,
আমি       ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার, 
আমি       পিনাক-পানির উমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দন্ড, 
আমি       চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচণ্ড!
নজরুল ইসলামই একমাত্র কৰি যিনি তাঁর কাব্যে হিন্দু-মুসলমান উভয় জাতিকে সমমর্যাদা দিয়ে তার ঐতিহ্যকে ব্যবহার করেছেন অকুণ্ঠচিত্তে।
এ কাব্যে পুৱানের ব্যবহার প্রচুর। দ্রোহ প্রধান কবিতায় খুব স্বাভাবিকভাবেই সর্বাধিক উল্লেখিত চরিত্র শিব, চন্ডী। অপর দিকে, বেদুঈন, চেঙ্গিস, কামাল পাশা, আনােয়ার। এইসব পেীরােনিক ও ঐতিহাসিক চরিত্রকে নজরুল তার জাগরণমূলক কবিতায় ব্যবহার করেছেন অতুলনীয় শিল্প দক্ষতায়। বিদ্রোহী কবিতায় অসংখ্য পৌরাণিক প্রয়ােগ লক্ষণীয়।
আমি ইন্দ্রানী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য, 
মম      একহাতে বা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণ-তূর্য!
কবির শব্দই তাঁর চৈতন্যের ধারক। অন্যভাবে বলা যায়, শব্দই কবিতা। কবির প্রয়ােগ কৌশলে শব্দের অভিধানিক অর্থ ছাড়িয়ে যখন ব্যঞ্জনাময় হয়ে ওঠে- পাঠকের স্মৃতিকে, আবেগকে আলােড়িত কিংবা শিহরিত করে তখনই তা কবিতা। শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে এ কাব্যে তিনি সংস্কারকে ভেঙেছেন। কবিতায় ব্যবহৃত বহুদিনের অলস শব্দ সুষমার বিরুদ্ধে তিনি একটি প্রবল স্রোত ধারা সৃষ্টি করেছেন। বলা যায়, নতুন শব্দ ব্যবহার করে নজরুল রবীন্দ্র বলয় থেকে এক বিস্ময়কর পরিবর্তন এনেছেন যা একেবারেই নতুন এবং একই সঙ্গে ঐতিহ্যবাহীও। শাত-ইল-আরব, খেয়া-পারের তরণী, কোরবানী, মােহররম প্রভৃতি কবিতায় নজরুল যে সাহসিকতা দেখিয়েছেন শব্দ ব্যবহারে – তা কোনােদিন বাংলা কবিতায় ব্যবহৃত হবে এমন চিন্তাও কোনাে কবির মনে আসেনি তখন। যেমন: দিলির, চাঙ্গা, জান্নাত, খামােশ, গর্দানে, আজাদী নওশা, শমশের, নকিব ইত্যাদি।
ছন্দ ব্যবহারের তিনি আপন প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। এ কাব্যের সব কবিতা মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত। তবে নজরুল যে ছন্দটি ব্যবহার করে সর্বাধিক আলােচিত হয়েছেন তা হলাে মাত্রাবৃত্ত। বস্তুত, দ্রোহপ্রধান কবিতার ভাব প্রকাশের বাহন হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন মাত্রাবৃত্তকে। বিদ্রোহী কবিতায় যেমন ব্যবহার করেছেন অতিপর্ব, তেমনি প্রস্বর বা বেনাকের প্রয়ােগ লক্ষণীয়:
বল     বীর-
বল       উন্নত মম শির।
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির। 
দুই শব্দের মিলন ঘটিয়েছেন দক্ষতার সঙ্গে-
ঐ ক্ষেপেছে পাগৃলী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই, 
অসুর-পুরে শাের উঠেছে জোর-সে সামাল সামাল তাই।
এছাড়া আনােয়ার, খেয়া-পারের তরণী, কোরবানী, মােহররম প্রভৃতি কবিতায় এ-রকম অন্তমিল লক্ষণীয়। ছন্দের আর একটি দুঃসাহসিক প্রয়ােগ এই কাব্যের কোথাও কোথাও বলবান হয়ে উঠেছে। ছয়মাত্রার মাত্রাবৃত্তের সঙ্গে হঠাৎ কোনাে পংক্তিতে ব্যবহৃত হয়েছে পাঁচ মাত্রা, এটি পতন নয় বরং এরই ফলে ৬ মাত্রার মাত্রাবৃত্তের যে ক্লান্তি তা কেটে গেছে। যেমন:
আমি অন্যায়/আমি উল্কা/আমি শনি =৬+৫+৪ 
আমি ধূমকেতু’জ্বালা, বিষধর/কালকনী =৬+৬+8 
ভাব, ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কার উপমা, অনুপ্রাস প্রভৃতির সুনিপুণ ব্যবহারের ফলে কাজের গতি আরাে বেগবান হয়েছে। বলা। যায়, অগ্নি-বীণার প্রতিটি কবিতার পরতে পরতে শুকিয়ে আছে এক নিপুণ শিল্পীর মূর্তি।

‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যের আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য

নজরুল ইসলাম তার সহজাত কল্পনা প্রতিভা ও আবেগধর্ম কে অবলম্বন করে কবিতা রচনার ফলে তাঁর কবিতা সর্বত্র মানবধর্মীতায় সূহ্ম ও ক্লিপ্ত হতে পারেনি সত্য কিন্তু এক দুর্লজ্জ আন্তর-প্রেরণার উদ্ভাসনে সজীব হয়ে উঠেছে। তবে কল্পনা প্রতিভাকে অনুশীলন-পরিশীলনে পরিশুদ্ধ এবং মনােসমীক্ষণে মেধাবী করে তুলতে পারলে নজরুলের কবিতা হতে পারতাে আরাে বেশি হৃদয়-সংবেদী। তবে একথা সর্বজন স্বীকৃত যে, নিপীড়িত এ বেদনার্ত মানুষের হাহাকারকে ভাষারূপচিত্রে বাহময় করে তােলার জন্য নজরুলের যে তীব্র আবেগ- সে আবেগ অনুভূতিকে ইতিহাসচেতনা ও মননধর্মিতায় শুদ্ধ করে নেয়ার আবসর তার ছিল না। কারণ তিনি শিল্পের চেয়ে জীবনকে বড় জেনেছিলেন।
কবিতার আরবি-ফারসি শব্দের ব্যাপক ব্যবহার সম্পর্কে নজরুলের নিজের মন্তব্য : “আমি হিন্দু-মুসলমানের পরিপূর্ণ মিলনে বিশ্বাসী; তাই তাদের এ সংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানি শব্দ ব্যবহার করি না; বা হিন্দু দেব-দেবীর নাম নিই। অবশ্য এর জন্যে অনেক জায়গায় আমার কাব্যের সৌন্দর্যহানি হয়েছে। তবু আমি জেনে শুনেই তা করেছি।” 
শব্দই সর্বময় চৈতন্যের ধারক। তার প্রাত্যহিক অথবা আভিধানিক অর্থ হয়তাে একটি বিশেষ বস্তু বা উপলব্ধিয় সংলগ্ন; কিন্তু কবির প্রয়ােগ কৌশলে অভিধানের সীমা ছাড়িয়ে তা হয়ে ওঠে ব্যঞ্জনা ধৰ্মী। পাঠরে স্মৃতিকে, আবেগকে আলােড়িত কিংবা শিহরিত করবে। তাকে বর্তমান থেকে অতীত কিংবা ভবিষ্যতে সম্প্রসারিত করবে। নজরুল ইসলামের কবিতার ভাবগত ও ছন্দগত সৌন্দর্যের প্রথম পরিচয় মেলে বিদ্রোহী কবিতার মধ্যে। যদিও বিদ্রোহীর অনেক চরণে দুর্বল শব্দ বিন্যাস এ অর্থহীন চাতুর্যের পরিচয় মেলে তবু ছন্দের নতুনত্ব ও কোথাও কোথাও অন্তরাবেগের জন্য এই কবিতাটিই নজরুল প্রতিভার পথনির্দেশক হয়ে আছে।
বল    বীর-
বল    উন্নত মম শির। 
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির।
বল   বীর
বল   মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি
ভূলােক দ্যুলােক গােলােক ভেদিয়া 
খােদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাতৃর!
মম     ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটিকা দীপ্ত জয়শ্রীর!” 
মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত এই কাব্যাংশটুকু ভালাে করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় – বীর, শির, হিমাদ্রির : বিধাত্রীর ও জয়শ্রীর প্রত্যেক শব্দের মধ্যবর্তী ‘ই’ অথবা ‘ই’ স্বর বিলম্বিত লয়ের হলেও শব্দাস্তের অ স্বর প্রায় অনুচ্চারিত থাকায় প্রত্যেক শব্দে একটি ঝোঁকের সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া ব্যঞ্জন বর্ণের সংযুক্তস্বরে বিচ্ছিন্নভাবে stress আপতিত হওয়ায় বিভিন্ন পদ-মধ্যে গাম্ভীর্যের সৃষ্টি হয়েছে। কবিতায় উপমা-রূপক-চিত্রকল্প সৃষ্টি কবির সৃজনী প্রতিভার পরিচায়ক। রাজনীতি ওঁ সমাজ বিষয়ক কবিতার বক্তব্য ও ভাবকে কেন্দ্র করেই কবিতার রূপ নির্মিত হয়ে যাকে। বৃহত্তর মানবজীবন এবং সমকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক সমস্যাকে অঙ্গীকার করে সার্থক চিত্ররূপ রচিত হয়েছে। রক্তাম্বরধারিনী মা কবিতায়-
“এলােকেশে তব দুলুক ঝঞা 
কাল-বৈশাখী ভীম তুফান, 
চরণ-আঘাতে উদ্গারে যেন
আহত বিশ্ব রক্ত-বান।”
শব্দচিত্র রচনায় ও রূপক সৃষ্টিতে নজরুলের কবি-শক্তি ও কল্পনা প্রতিভার পরিচয় দীপ্ত। সামাজিক ও রাজনীতি বিষয়ক কবিতার চেয়ে বেদনা-বিষাদময় কবিতাতেই নজরুল শব্দচিত্র রূপকল্প ও চিত্রকল্প সৃষ্টিতে অধিকতর পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছেন। তার বিখ্যাত ‘খেয়াপারের তরণী’ শীর্ষক কবিতার অংশ বিশেষ লক্ষণীয় :
“নাচে পাপ-সিন্ধু তুঙ্গ তরঙ্গ। 
মৃত্যুর মহানিশা রুদ্ৰ উলঙ্গ! 
নিঃশেষে নিশাচর গ্রাসে মহাবিশ্বে, 
এাসে কাপে তরণীর পাপী যত নিঃস্বে! 
তমসাবৃতা ঘাের কিয়ামত রাত্রি,
খেয়া-পারে আশা নাই, ডুবিল রে যাত্রী!”
নজরুলের যেসব কবিতায় আবেগের সততা ও কল্পনার সুদূর বিস্তার লক্ষণীয়, সেসব কবিতায় উপমা উৎপ্রেক্ষা-রূপকল্পে এসেছে এক অস্থির গতিশীল প্রবাহ। শব্দ তৎসম, দেশি কিংবা আরবি-ফারসি যাই হােকনা কেন তা বক্তব্যের অনিবার্য প্রয়ােজনে যদি এসে থাকে তাহলেই তার সার্থকতা। নজরুলের অনেক কবিতায় আবেগের প্রশ্রয়ে শিল্পের চূড়ান্ত ফলশ্রুতি যেমন বিপন্ন হয়েছে তেমনি অনেক ক্ষেত্রে ভাবানুযায়ী সঠিক শব্দ প্রয়ােগে কখনাে তা বিদ্যুতের মতাে ঝলসে উঠেছে। আবেগের আন্তরিকতার কারণে “বিদ্রোহী” কবিতাটি পরম সম্পর্কে পরিণত হয়েছে,
“আমি        গােপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল করে দেখা অনুখন, 
আমি          চলল মেয়ের ভালােলা, তার ন্যা-তুতির ঝ-কন্য! 
আমি          চির-শিশু, চির-কিশাের, 
………………………………
……………………………..
আমি          উত্তর-বায়ু মলয়-অনিল উদাস পূরবী হাওয়া,
আমি          পথিক-কবির গভীর রাগিনী, বেণু-বীণে গান গাওয়া।” 
ভাব-ভাষা ছন্দ ও অলঙ্কার স্বন্যাসে এ কাব্য হয়ে উঠেছে সার্থক। প্রথমত, নজরুল তাঁর আবেগের প্রতি সৎ ছিলেন। দ্বিতীয়ত, তিনি বিনয়বশত শিল্প-চর্যার প্রয়ােজনকে অস্বীকার করলেও এ বিষয়ে সজাগ ছিলেন। এই আবেগ যখন শিল্পচর্যায় সংহত হয়েছে, তখন তা সার্থক কৰিতারর দ্যুতিতে ভাস্বর হয়ে উঠেছে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

"সোজন বাদিয়ার ঘাট" কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

“সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

ভূমিকা: বাংলা কাব্যের ভুবনে বাংলাদেশের মানসকবি জসীম উদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) আবির্ভাব বিশ শতকের তৃতীয় দশকে। তিনি রবীন্দ্র-নজরুল ও তিরিশের কবিদের বলয় ও প্রভাব মুক্ত থেকে কবিতায় এক নতুন ও ব্যতিক্রম স্বর সৃষ্টি করেছেন। সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগরচেতনা, নাগরিক জীবন ও আচার-আচরণ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তুলে এনেছেন, জসীম উদদীন সেখানে তার কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কবির বিকল্প জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ উপন্যাসধর্মী রচনা। এ কাব্যে প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। নিম্নে … “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস ১. অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যে অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এ আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস, সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। “নমু পাড়ায় পূজা পরব, শঙ্ক কাঁসর বাজে, … মুসলমানের পাড়ায় বসে ঈদের মহোৎসবে,” ২. প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যেপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে মুসলমান চাষীর ছেলে সোজন আর হিন্দু নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠরতার আলেখ্য। গ্রামের হিন্দু বালিকা দুলীর সাথে মুসলমানের ছেলে সোজনের আবল্য বন্ধুত্ব। বন্ধু থেকে আস্তে আস্তে প্রেমে পরিণত হয়। কবিতায়- “নমুদের মেয়ে আর সোজনের ভারি ভাব দুইজনে, লতার সঙ্গে গাছের মিলন, গাছের লতার সনে।“ প্রেমের তুলনায় সমাজ অতিমাত্রায় কাব্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাব্যে সামাজিক অনুষঙ্গের উপস্থাপন করেছেন কবি। কবিতাতে তিনি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষকে আসার আহ্বান করেছেন। সমাজের মানুষের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, খেলাধুলা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায় কাব্যটিতে। দুলির মায়ের কণ্ঠে সমাজের রূঢ় রূপটি প্রকাশ পায়- “পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেত পাড়ায় যে ঠেকা ভার, চূণ নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!” ৩. জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রচনা: কবি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে। শহরজীবনে বসবাস করলেও তিনি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে গ্রামে কাজ করেছেন। ফলে তিনি মানুষের সাথে মিশতে পেরেছেন এবং তাঁর জীবনবোধ ও জীবন অভিজ্ঞতা হয়েছে সমৃদ্ধ। তাঁর জীবনপদ্ধতি ব্যতিক্রমধর্মী এবং বড় কবিতার ধারক হিসেবেই তিনি পরিচিত। ৪. উপন্যাসধর্মী রচনা: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” একটি উপন্যাসধর্মী রচনা। কাব্যের কবিতাগুলো জসীম উদদীন উপন্যাসের ঢংয়ে লিখেছেন। এ যেন লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক। ৫. মৌলিক রচনাধর্মী ও অনন্য: অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় সম্পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন কাহিনী নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রাম-বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। ৬. আধুনিকতা ও উদারনীতির বৈশিষ্ট্য: সময়কে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে স্বীকার করে নিয়ে লেখা আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাণিজগতের কল্যাণকামনা করে মানবিক হওয়াও আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। এসবের সংমিশ্রণে জসীম উদদীন কবিতায় অবয়ব দিয়েছেন। হিন্দু কিশোরী দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সুজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীমউদ্দীন লিখলেন- এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে . . . এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি। ৭. চরিত্র নির্মাণে দক্ষতা: ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে লেখক চরিত্রের আমদানি করেছেন, চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং চরিত্রের পরিণতি দেখিয়েছেন। চরিত্র যেন অনুভূতির মাধ্যমে কথা বলছে। তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভাষার ব্যবহারেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ৮. কাহিনী ও ভাষা বিন্যাসে পাণ্ডিত্য: কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ৯. ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ: আধুনিক কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীমউদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলঙ্কারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলঙ্কারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ।

Read More
কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলা: বাংলা সাহিত্যের একটি চরিত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়েন। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার

Read More

Keto Diet Recipes

Keto for Beginners: A Simple 7-Day Meal Plan The ketogenic (keto) diet has taken the health and wellness world by storm, promising weight loss, increased

Read More
শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক নাটক। এটি রচিত হয় ১৮৫৯ সালে। নাটকটি মহাভারতের কাহিনীকে উপজীব্য করে পাশ্চাত্য রীতিতে রচিত হয়। নাটকটির কাহিনী মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.