গৌরচন্দ্রিকা : জ্ঞান অর্জনের সহজাত মানবিক বৃত্তি বা বৃত্তি সমূহের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে বিশ্বপ্রকৃতি এবং তৎসঙ্গে আমাদের নিজ সত্তার প্রকৃত স্বরূপ ও তাৎপর্য সম্পর্কে একটি যুক্তিনির্ভর বিচারমূলক অনুসন্ধানই হচ্ছে দর্শন। দর্শন ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। যেকোনো সুশৃঙ্খল বা সুসম্বন্ধ যুক্তিসম্মত অনুসন্ধানই হচ্ছে বিজ্ঞান। তাছাড়া দর্শন আর ধর্মের সম্পর্কও লৌকিক ধারণার চেয়ে নিবিড়তর। দর্শন হচ্ছে পরমসত্তা ও জীবনের পরম কল্যাণ সম্পর্কিত একটি শৃংখলাবদ্ধ যুক্তিনির্ভর অনুসন্ধান। পক্ষান্তরে, ধর্ম হচ্ছে মানব জীবনের নিয়ন্ত্রক হিসেবে কল্পিত কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তি বা শক্তিসমূহের ওপর নির্ভরশীলতার অনুভূতি এবং তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের আকাঙ্ক্ষা।ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞান এ তিনের মধ্যে যেমন কিছু আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে তেমনি কিছু সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্যও রয়েছে। নিম্নে ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য গুলো তুলে ধরা হলো:
দর্শন ও বিজ্ঞানের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য :
ক. বিজ্ঞান প্রকৃতির একটি বিশেষ বিভাগ নিয়ে আলোচনা করে, কিন্তু সমগ্র বিশ্বজগতই দর্শনের আলোচ্য বিষয়বস্তু।
খ. বিজ্ঞান কেবল জ্ঞানার্জনে আগ্রহী নয়, মানবকল্যাণে তত্ত্বীয় জ্ঞানকে সে প্রয়োগও করতে চায় ৷ তেমনি ভাবে দর্শনের আগ্রহ কেবল জগতের উৎপত্তি, ইচ্ছার স্বাধীনতা বা ঈশ্বরের অস্তিত্বের মতো তত্ত্বীয় বিষয়ে সীমাবদ্ধ নয়৷ মানুষের সবথেকে ভ্রান্ত ধারণা ও ক্ষতিকর কুসংস্কারগুলো দূর করে তার জীবনকে সুখময় ও অর্থপূর্ণ করাই তার চরম লক্ষ্য।
গ. বিজ্ঞান অবলম্বন করে আরোহ ও অবরোহের মতো বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতি, সেক্ষেত্রে দার্শনিক সত্যগুলো জানার জন্য প্রয়োজন ‘স্বজ্ঞা’ নামক একটি স্বতন্ত্র উচ্চতর পদ্ধতি।
ঘ. বিজ্ঞানের নির্ণীত বিষয় মূর্ত কিন্তু দর্শনের বিষয় হলো অমূর্ত।
ঙ. বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তকে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা যায ৷ কিন্তু দর্শন কতগুলো বিষয় নিয়ে আলোচনা করে যা পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা যায় না।
ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য :
ক. দর্শন যেক্ষেত্রে মূলত একটি তত্ত্বীয় বিষয় সেক্ষেত্রে ধর্ম মূলত ব্যবহারিক ৷ দর্শনের প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে – সংশয়াতীত জ্ঞান, আর ধর্ম হচ্ছে মোক্ষলাভের উদ্দেশ্যে শান্তিময় ও সমন্বয়পূর্ণ জীবনের পথনির্দেশক।
খ. দর্শন জোর দেয় প্রধানত উপলব্ধি, প্রজ্ঞা বা জ্ঞানালোকসম্পাতের উপর, ধর্ম সে ক্ষেত্রে জোর দেয় নৈতিক সদগুণ অফ পরমসত্তার সঙ্গে আধ্যাত্মিক সংযোগ স্থাপনের উপর।
গ. দর্শন যুক্তিবাদী ও বিচারধর্মী এবং তার পদ্ধতি বৈজ্ঞানি ৷ কিন্তু ধর্ম প্রধান বিশ্বাসের ব্যাপার এবং তার ধারণা ও নীতিমালার উৎস কোনো একটি প্রাধিকার ( ব্যক্তি বা শাস্ত্র )।
ঘ. দর্শনের ক্ষেত্রে স্বাধীন চিন্তা ও পরিশীলিত জ্ঞানের দরজা প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য উন্মুক্ত। কিন্তু ধর্ম বিশ্বাস করে ঐশীসত্তার নিকট থেকে বিশেষ অধিকারপ্রাপ্ত অল্পসংখ্যক নির্বাচিত ব্যক্তির অস্তিত্বে।
ঙ. যুক্তিবৃত্তি দর্শনকে যে সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যাক না কেন দর্শন সে দিকেই যাবে ৷ কিন্তু ধর্ম কেবল ততক্ষণ পর্যন্ত যুক্তিবৃত্তি কে অনুসরণ করবে যতক্ষণ যুক্তিবৃত্তি ধর্মের নীতি ও বিশ্বাসের পক্ষে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। বলা হয়ে থাকে যে দর্শন হচ্ছে মস্তিষ্কের ব্যাপার আর ধর্ম হৃদয়ের ব্যাপার।
যবনিকা : উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞান একে অপরের পরিপূরক হলেও তাদের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য বিদ্যমান ৷ যা ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানে গভীর মনোনিবেশ করেই উপলব্ধি করা সম্ভব। ফলে এ পার্থক্যগুলো থাকা সত্ত্বেও আমরা বলতে পারি যে ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞান একে অপরের উপর নির্ভরশীল।
তথ্যসূত্র :
১. ড. আবদুল মতিন, “দর্শনের রূপরেখা” পৃষ্ঠা : ১৬–২০.
২. আর. সি. পাল সম্পাদিত, “দর্শনের সমস্যাবলি” পৃষ্ঠা : ৩৭–৪৪.