কবি-জীবন: ভারতের বর্ধমান জেলার আসানসােল মহকুমার জামুরিয়া থানার অন্তর্গত চুরুলিয়া গ্রামে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১৪ই জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে মে) মঙ্গলবার এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ এবং মায়ের নাম জাহেদা খাতুন। তাঁর পিতামহের নাম কাজী আমিনুল্লাহ ও মাতামহের নাম মুনশী তােফায়েল আলী। কাজী ফকির আহমদ সাহেবের দুটি বিয়ে। সাতপুত্র এবং দুই কন্যার মধ্যে নজরুলের সহােদর বড়ভাই কাৰ্জী সাহেবজান, ছােটভাই কাজী আলী হােসেন এবং একমাত্র বােন উম্মে কুলসুম। কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর চার পুত্রের অকাল মৃত্যু হওয়ার পর নজরুলের জন্ম, তাই তার ডাকনাম রাখা হয় দুখু মিয়া।
নজরুলের শৈশব অতিবাহিত হয়েছে নিদারুণ দারিদ্র্যের সঙ্গে কঠোর সংগ্রাম করে। তিনি বাল্যকালে অত্যন্ত দুরন্ত ও চঞ্চল ছিলেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি নজরুলের পিতার মৃত্যুর পর কাজী পরিবার চরম দারিদ্র্যের সম্মুখীন হয়। দুবেলা দুমুঠো অন্নের সংস্থান হওয়াই কঠিন হয়ে পড়ে। দারিদ্রের চাপে নজরুলের বিদ্যাশিক্ষার সুব্যবস্থা হয়নি। তিনি গ্রামের মক্তবে পড়াশােনা আরম্ভ করেন। তাঁর প্রখর বুদ্ধি ও মেধা ছিল। তাঁর জ্ঞান পিপাসা শুধু বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত না। যেখানে কীর্তন হত, কথকতা হত, যাত্রাগান হত, মৌলভীর কোরান পাঠ ও ব্যাখ্যা হত, দুরন্ত বালক গভীর আগ্রহ ও মনােযােগের সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতেন। বাউল, সুফী দরবেশ ও সাধু সন্ন্যাসীর সঙ্গে তিনি অন্তরঙ্গভাবে মিশতেন। তার আচার ব্যবহারে গভীর উদাসীনতা লক্ষ করে লােকে তাকে খ্যাপা’ বলে ডাকত। অনেকের কাছে তার আদরের নাম ছিল ‘নজর আলি’।
দশ বৎসর বয়সে নজরুল গ্রামের মক্তব থেকে নিম্নপ্রাথমিক পরীক্ষা পাস করেই সংসারের চাপে এই মক্তবেই একবছর শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। এই সময়ে নজরুলকে অর্থোপার্জনের জন্যে শিক্ষকতা ছাড়াও নিকটবর্তী গ্রামে মােগ্লাগিরি করতে হত। কখনও তিনি হাজী পাহলােয়ানের মাজার শরীফের খাদেম হন। মাঝে মধ্যেই তিনি মসজিদের এমামতিও লছেন।
পশ্চিমবঙ্গে ’লেটোনাচ’ নামে এক কম আমােদ-প্রমােদের ব্যবস্থা আছে, যাকে যাত্রাগান ও কবির লড়াইয়ের একটা মিশ্রিত সংস্করণ বলা চলে। বাড়ির অবস্থা ভালাে ছিল না বলে নজরুল এইসব লেটোর দলে গান এবং নাটক রচনা করে অর্থোপার্জন করতেন। তার বয়স যখন বারো কিংবা তেরাে বছর মাত্র এসময়ে তিনি নিমসা, চুরুলিয়া এবং রাখাখুড়া এই তিনটি লেটোনাচের দলে নাটক রচনার ভার পেলেন। এই সময়ে তিনি কয়েকটি গ্রামে বড় বড় ঐতিহাসিক নাটক ও ‘মেঘনাদবধ’ নামে একটি নাটক রচনা করেন। শকুনিবধ, মেঘনাদবধ, চাষার সঙ, রাজপুত্র, আকবর বাদসা, ইত্যাদি কয়েকটি পালাগান রচনা করেন এই সময়ে।
স্কুলের ছক বাঁধা জীবনে কিছুদিনের মধ্যেই নজরুল অস্থির হয়ে পড়লেন। কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ একদিন স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন। এই সময়ে তিনি শখের কবিগানের আসরে যােগ দিলেন। তিনি গান ও পালা লিখতেন এবং সেগুলােতে সুরারােপ করতেন। তিনি ঢােলক বাজিয়ে গানও গাইতেন। কবিগানের আসরে নজরুলের গানে মুগ্ধ হয়ে এক গার্ডসাহেব তার প্রসাদপুরের বাংলােতে তাকে বাবুর্চির কাজ দেন। গার্ডসাহেব ছিলেন মদ্যপ। কিছুদিনের মধ্যেই এক হাঙ্গামার সূত্র ধরে নজরুল গার্ডসাহেবের চাকুরি ছেড়ে দেন। এরপর নজরল আসানসােলে চলে আসেন এবং আব্দুল ওয়াহেদের রুটির দোকানে কাজ পেলেন। বেতন মাসে মাত্র পাঁচ টাকা। খুব ভােরে উঠে রুটির ময়দা মাখতে হয়, আর সমস্ত দিন ধরে রুটি তৈরি বিক্রি করতে হয়। রাতে যে সামান্য সময়ের জন্যে ছুটি পেতেন তা তিনি বই পড়ে কাটিয়ে দিতেন। এই সময়ে নজরুল তার যন্ত্রসংগীত নৈপুণ্যের জন্যে কাজী রফিজউদ্দীন আহমদ নামে আসানসােলের এক দারােগার নজরে পড়েন। নজরুলের বুদ্ধিমত্তা ও প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তিনি ১৯১৪ সালের গােড়ার দিকে নিজগ্রাম ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার অর্ন্তগত কাজীর সিমলাতে নিয়ে গিয়ে দরিরামপুর হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। কিন্তু স্কুলের রুটিন-বাঁধা জীবন তাকে একেবারেই আকৃষ্ট করত না। ফলে ঐ বছরই বাৎসরিক পরীক্ষার ঠিক পরেই তিনি কাউকে কিছু না জানিয়ে ময়মনসিংহ ত্যাগ করেন।
কিছুকাল ঘােরাঘরি করে ১৯১৫ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি নিজের ইচ্ছাতেই আবার রানীগঞ্জে এসে ভর্তি হলেন। শিয়ারশােল রাজস্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে। এই স্কুল থেকেই তিনি প্রি-টেস্ট দেন। তখন শহরে চলছে সৈন্য যােগাড়ের তােড়জোড়। এই সময়ে স্বেচ্ছায় নজরুল ১৩২৪ বঙ্গাব্দে (১৯১৭) ৪৯নং বাঙালি পল্টনে (49″ Bengalis Regiment) সৈনিক রূপে যােগ দেন। যুদ্ধ শেষে পল্টন ভেঙ্গে যাওয়ায় কৰি ফিরে এলেন মাতৃভূমিতে। শুরু হলাে কবির নিরবচ্ছিন্ন কাব্য সাধনার কাল। নজরুলের শৈশব থেকে কৈশােরােত্তীর্ণ যৌবনের এ সময়ে দুটি ঘটনা কবি মানস গঠনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। স্বল্প বয়সে বর্ধমানের লেটো গানের দলে যােগ দিয়ে কবির মধ্যে কবিত্বশক্তি পূরণের প্রাথমিক পর্যায় সম্পন্ন হয়েছিল এবং এই প্রাণােচ্ছল সহজ কবিত্বশক্তি পরবর্তীকালে বিশ্বযুদ্ধের বিচিত্র পটভূমিকায় বিদ্রোহের তপ্ত চাপা অগ্নিশিখায় জারিত হয়েছিল।
কবি কাজী নজরুল তাঁর বিচিত্র সাহিত্য জীবন আরম্ভ করেন গল্প রচনার মধ্য দিয়ে। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি কবি। কাব্যরচনার স্থায়ী ভিতের উপরই নজরুলের খ্যাতির সুউচ্চ ভবন দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিনি তার প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’ রচনা করেন ১৯১৮ সালে। কবিতাটি ১৩২৬ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসের বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু যুদ্ধ ফেরত কৰি নজরুল ১৯২০ সালে বিদ্রোহী নামক যে কবিতাটি “মােসলেম ভারত” পত্রিকায় প্রকাশ করেন তাই তাকে পৌছে দেয় কবি হিসেবে খ্যাতির শীর্ষে। “বিদ্রোহী” রচনার পর থেকে নজরুল আর পেছনে ফিরে থাকাননি। অসংখ্য রচনা ও সৃষ্টিসম্ভারে বাংলাসাহিত্যকে ক্রমাগত ঐশ্বর্যশালী করে তুলেছিলেন।
একজন যথার্থ কৰি তাঁর সমাজ, দেশ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির মধ্যে কাব্যসাধনার ভিত্তিভূমি রচনা করেন। নজরুলও তার ব্যতিক্রম নন। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দ্বারা পদদলিত এ দেশের অন্যায় অত্যাচার বৈষম্য ও শােষণের মধ্যে কবি তাই সােচ্চার। কন্ঠে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন। তিনি লেখনীর ভেতর দিয়ে বিপ্লব ও বিদ্রোহের বীজ বুনে চলেন। এ সময়ে কবির কাছ থেকে আমরা পাই অগ্নি-বীণা, বিষের বাঁশী, ভাঙারগান, প্রলয়শিখা, সর্বহারা, সাম্যবাদী, ফনিমনসা প্রভৃতি অগ্নিগর্ভ কাব্যগ্রন্থ। এ সময়ে রচিত অসংখ্য কবিতায় বিদ্রোহী কবি নজরুল অন্যায়-অত্যাচারপীড়িত মানুষের পুঞ্জীভূত মূক মূঢ় হৃদয়ের ব্যথা বেদনাকে অগ্নি-বীণার জাদুকর সুষমায় ব্যক্ত করেছেন। সমাজ-রাষ্ট্রের অবিচার ও বৈষম্যের প্রতি বিপ্লবী মনের প্রতিবাদ, ভাব-কল্পনা, চিত্ত ও চিন্তার স্বাধীনতা, বাণী প্রকাশের বিস্ময়কর স্বৰ্কীয় সৃজনশীলতা, অবারিত প্রাণশক্তি, উচ্ছল ও বাধাহীন উদ্দামতা এবং সর্বোপরি একটি বিশাল উদার সংস্কারমুক্ত হৃদয়ের সংবেদনশীল আনন্দ উচ্ছাসের অব্যাহত গতিময়তা নজরুল কাব্যকে এক অসামান্য বিশিষ্টতা দান করেছে।
নজরুল মানুষের কবি ছিলেন। মানুষ ও মানবতাই তার জীবনমন্ত্র ছিল। একদিকে মনুষ্যতের পুজারী কৰি মানবতার বেদনাকেই ভাষা ও ছন্দে রূপায়িত করেছেন। অপরদিকে জাতিভেদের ঊর্ধ্বে এই কবি বাঙালি জাতির পুস্থিত অপমান অব্যক্ত বেদনাকে ভাষারূপ দিয়েছেন। এ জন্যেই তিনি সমগ্র বাঙালি জাতিকে সেদিন নব প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে তুলতে পেরেছিলেন।
মাত্র ৪৩ বছর বয়সে কবি নজরুল দুরারােগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে চিরতরে স্তুদ্ধ হয়ে যান। এ সময় কবিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় জগত্তারিনী পুরস্কার এবং ভারত সরকার ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি দান করেন। এরপর কবিকে স্থায়ীভাবে স্বাধীন বাংলাদেশে বসবাসের জন্যে নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘ডক্টর অব লিটারেচার’ সম্মানে ভূষিত করেন। ১৯৭৬ সালে কবি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভ করেন। এই বছরেই আগস্ট মাসে কবি নজরুল ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তৎকালীন পিজি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পাবলিক লাইব্রেরির কাছেই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধি দেওয়া হয়।