Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

Banglasahitta

Welcome to Banglasahitta

One Step to the Heart

বাংলা ছােটগল্পে বনফুলের অবদান মূল্যায়ন করো

‘বনফুল’—এই নাম, শব্দটির উচ্চারণে ও শ্রবণে বিশাল-বিস্তীর্ণ বনভূমির বিচিত্র পুস্পরাজির আমােদিত সৌরভের আভাস আমাদের মানসপটে উদ্ভাসিত হয়। বস্তুর বিভিন্নতা, প্রকাশভঙ্গির নতুনতা, প্রকরণের অভিনবতা, জীবনব্যাখ্যার সাবলীলতা ও স্বচ্ছতা প্রভৃতি আমাদের এক অনাস্বাদিতপূর্ব ছােটগল্পের জগতে নিয়ে যায়। যে জগতে ছোট লােক-বড় লােক, ধনী-দরিদ্র, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, কটাক্ষ শ্রেষ—সবই আছে। সেখানে সহজ-সরল-স্বাভাবিক মানৰঞ্জীবনের কথা যেমন আছে তেমনি তার অন্তর্শায়ী ভণ্ড, পাপী, অন্তসারশূন্য মানুষের কুটিলজটিল জীবনকথাও। আর আছে মানবচরিত্রের নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি-অসঙ্গতির কথা, দরিদ্র নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জীবন সংগ্রামের কথা, বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের আর্থিক দিক থেকে বিপর্যস্ত মানুষের কথা, আদিম জৈৰ প্রবৃত্তির কাছে মানব জীবনের পরাভবের কথা অদৃষ্টের হাতে মানবজীবনের বিড়ম্বনার কথা, বলিষ্ঠ জীবনবােধের কথা—এক কথায় মানব চরিত্রের ও মানব জীবনের বিভিন্ন দিকের স্বরূপ চিত্রায়িত ও উম্মােচিত হয়েছে তাঁর ৫৭৮ টি গল্পে।
এই বিপুল সংখ্যক গল্প আবার আকৃতির দিক থেকেও বিভিন্ন। কোনটি ‘ছােট’ কোনটি ‘মাঝারি কোনটি ‘বড়’ আকৃতির। তা সে যে ‘অকৃিতিরই হোক না কেন প্রত্যেকটি শপে বনফুল এমন অনুিষ্ট জীবন দৃষ্টির পরিচয় রেখেছেন, যা তাঁর স্বভাব ধর্মকেও চিহ্নিত করে। বনফুল ছোটবেলা থেকেই যে পারিবারিক আবেষ্টনীতে বড় হয়ে উঠছিলেন, তাতেই তাঁর ব্যক্তিত্ব আপনা-আপনিই গড়ে উঠেছিল। বনফুলের সংযমী ব্যক্তিত্বের হুপি অমিরা তাঁর প্রত্যেকটি গল্পেই পাই। যেখানে বাক্যের বৃথা ব্যয় নেই, উদ্দিষ্ট লক্ষ্যের প্রতি কাহিনী নাটকীয় ভঙ্গিতে ঐক্ত ধাবিত হয়েছে। গল্পের কাহিনী বিন্যাসে নাটকীয় কৌশল পাঠকচিত্তকে এক অনির্বচনীয় আকর্ষণে আকৃষ্ট করে। “Dramatic suspense- কে ক্রমশই পুঞ্জীভূত করে অত্যন্ত সন্তর্পণে অথচ স্বভাব সিদ্ধ আনমনে, শিল্প যেন সুক্ষ্মতন্ত্রী জীবনের ভাঁজ খুলে চলেছেন একের পর এক,—তি ভাঁজে নতুন উৎকণ্ঠা নতুন কৌতূহল নতুন উদ্দীপনার পথে ঠেলে নিয়ে চলে। এই অর্থেই বনফুলের প্রকরণ ও বিজ্ঞানী প্রবণতার সৃষ্টি—ভাঁজে ভাঁজে সংকুচিত গােপন জীবনসত্যকে ধাপে ধাপে আবিষ্কার করে এগিয়ে চলেছেন তিনি। প্রতিটি পদক্ষেপ নির্ভুল আঙ্কিক হিসাবে পরিচালিত—ফলে প্রত্যেকটি বাক্য, এমনকি প্রতিটি শব্দও, গল্প-রহস্যের উন্মােচনে যেন অনিবার্যতার কঠিন বন্ধনে সংলগ্ন। এই কারণে বনফুলের ছোটগল্পের শরীরে একটি শব্দকে পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত অথবা পরিমার্জিত করার উপায় নেই।”
বনফুল এমনই লেখক। তাঁর বিবিধ আকৃতির ও বিবিধ শ্রেণীর গল্পের আলোচনায় এই বৈশিষ্ট্যগুলিই খুঁজে পেয়েছি। তবে কাহিনীর সংস্থাপনে আমার কোথাও বনফুলকে “আনমনে মনে হয়নি। বনফুল তাঁর বক্তব্যকে নিস্ব ব্যক্তিত্ব বৈশিষ্ট্যে গল্পে উপস্থাপিত করেছেন। হ্যাঁ, ব্যক্তিগত জীবনে বাইরে থেকে দেখতে অনেককে ‘আত্মসচেতন’ মনে নাও হতে পারে। কিন্তু সে মানুষটি যখন শিল্পসৃষ্টি করতে যাবেন, তখন নিশ্চয়ই তাঁর উদ্দেশ্য সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন থাকেন, নচেৎ তাঁর সৃষ্টি মাঠে মারা যাবে যে! বনফুলের মধ্যে এক দুর্দান্ত প্রাণশক্তি ছিল যার জন্য তিনি অনায়াসে বাইরের । ঔদাসীন্যকে দুঃসাহসিক ব্যঙ্গের সাহায্যে উল্টে দিতে পারতেন। এটি তাঁর চরিত্রের কোন স্ববিরােধিতা নয়, এটিই তাঁর ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব যা, শিল্পসৃষ্টিতে অন্বিত। বৃত্তিতে চিকিৎসক বনফুল মানবজীবনকে অস্ত্রোপচারের ডিশেকশান টেবিলে রেখে বৈজ্ঞানিকের পরীক্ষাপ্রবণ দৃষ্টিতে মানব চরিত্রের বিবিধ বৃত্তিগুলিকে ‘বুদ্ধিরস’ এর যােগানে চমকপ্রদভাবে রূপায়িত করেছেন। এই জীবন রূপায়ণে তাই কোন ভাবালুতা নেই, আছে একনিস্পৃহ দৃষ্টি। তবে সেই নিশূহ মনোবশেষ পর্যন্ত মানবিক বােধে উত্তীর্ণ হয়েছে। বনফুল নিজের চিন্তা-ভাবনা আদর্শ দ্বারা বিষয় নির্বাচন করে নিজের মত করে তা পরিবেশন করেছেন। মানবজীবন সম্পর্কে তার সর্বদা কৌতুহল জাগরূপ ছিল। তাই মানব চরিত্রের বিবিধ রং- বৈচিত্র্য তাঁকে ‘ইন্সপায়ার’ রত। সেকারণে তাঁর গল্পের এত বৈচিত্র্য, প্রকরণের এত বিভিন্নতা। বনফুলের গল্প সম্পর্কে পূর্বের অধ্যায়গুলির আলােচনায় আমি তা দেখানাের চেষ্টা করেছি।
বনফুলের গল্পের বিষয়গুলি একটু গভীর ও নিবিড় ভাবে লক্ষ্য করলে দেখব সেগুলি কোন কোন ক্ষেত্রে যথেষ্ট অকিঞ্চিতকর। অথচ তারই মধ্যদিয়ে ভীবনের এক চরম সত্য রূপায়িত করেছেন তিনি। ফুল,পশু-পাখি, জনমানুষ থেকে শুরু করে ‘আপাছা পর্যন্ত তাঁর গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে তার অন্তরঙ্গ বন্ধু পরিমল গোস্বামী লিখেছেন- “তোমার কলমে সবরকম গল্পই এসেছে। এ এক চমকপ্রদ ব্যাপার। হাভী থেকে প্রজাপতি সব রকম গল্পসৃষ্টির ব্রহ্মা হয়ে বসে আছ তুমি, তাই তােমার লেখায় আমার বিস্ময় জাগে। তা সে বিষয় যত অকিঞ্চিতকরই হােক না কেন তার মধ্যে গভীর জীবনসত্য রূপায়ণ করেছেন বনফুল। সমালােচকে বনফুলের গল্পে ভাবের গভীরতার অভাবের কথা বলেছেন। কিন্তু বনফুলের গল্পগুলি যদি একটু ঝুঁকে পড়ে দেখা যায় ও একটু গভীরভাবে ভাবা যায় তাহলেই আমরা বুঝতে পারি বনফুল কত সাধারণ ভঙ্গিতে, বিষয়ে, কত গভীর ভাবের গল্প বাংলা সাহিত্যকে উপহার দিয়েছেন। বনফুলের সৃষ্টির কালো তার শিম্পমূল্যকে নির্ধারণ করে দিয়েছে। বনফুলের গল্পে পরিহাস, শ্লেষ, কটাক্ষ এমন এক সহজ-সরল ভঙ্গিতে বর্ণিত হয়েছে, যা বনফুলের বিশিষ্টতাকে চিহ্নিত করে। “বলাইবাবু একঘেঁয়ে মসৃণ কাহিনী লেখেন নি। তাছাড়া তাঁর কাহিনীতে বুদ্ধিরসের যােগান আছে। বালী পাঠকের ডিসপেপটিক মানসে বুদ্ধিরস দুম্পাচ্য। এখানেই বলাইবাবুর বিশেষত্ব।
একটি গল্পকে ‘ছোটগল্প হয়ে উঠতে গেলে যে যে বৈশিষ্ট্যগুলি থাকা প্রয়োজন তার সবগুলি তাঁর গল্পে উপস্থিত। তাঁর “ছােট আকৃতির অণুগল্প বা মিনিগল্পগুলি তাকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে। কিন্তু সেগুলি ছাড়াও ‘মাঝারি ও বড় আকৃতির রচনাতেও যে তিনি সমান দক্ষ তা প্রমাণিত হয়েছে। তাঁর ছােট আকৃতির কোন কোন গল্পে যেমন অনেকে গল্প বলে কিছু খুঁজে পান না, তাতে তারা অখ্যানই সেখানে দেখতে পান। কি একটু গভীরভাবে লক্ষকরলে দেখা যাবে, বনফুল ছােটগল্পের সমস্ত বৈশিষ্ট্যে সেগুলিকে উদ্ভাসিত করেছেন। আর আধুনিক ছােটগল্পে ঘটনা থাকলেই হবে এমন কোন প্রতিশ্রুতি নেই। একটি মুহুর্তের বিলাস, একটি মনন, একটুখানি দেখা, একটি মেজাজ, খানিক জাগর-স্বল্প (Surrealism) – এরা সবাই-ই একালের ছােটগল্পের বিষয় হতে পারে। কেননা আধুনিক ছােটগল্পের বিষয় বিন্দুবৎ হয়ে যাচ্ছে। তাই বৃন্তের দিকে লেখক না ঝুঁকে জীবনের এক কোন চিরন্তনসত্যের রূপনির্মাণে আলোক সম্পাত করেন। একথাগুলি বনফুলের ছেটি’ আকৃতির অণুগল্প বা মিনি গল্পগুলির ক্ষেত্রেও প্রযােজ্য। তাই বনফুলের ‘ছােটগল্পগুলি যত ছােটই হােক না কেন তা জীবনের এক চরম সত্য রূপলাভ করেছে এবং তাতে ছােটগল্পের ‘গপত্ব’ও পুরােপুরি উপস্থিত। একইভাবে মাঝারি ও বড় আকৃতির গল্পগুলিতে লক্ষ্য করা যায় যে সার্থক ছােটগল্পের যা যা বৈশিষ্ট্য একটি গল্পে থাকা উচিৎ, সে বৈশিষ্ট্যগুলি সেখানেও লম্বা! এই ত্রিবিধ আকৃতির গল্পে বিষয়বস্তু নির্বাচন, বিষয়বস্তুর বিন্যাস কৌশল, কাহিনীর একমুখিপত্তি, সংযত সংহত ভাষা ব্যবহার, আয়তনের সংক্ষিপ্তি, ব্যঞ্জনাধর্মী—সবকিছু মিলে সেগুলি প্রত্যেকটি সার্থক ছােটগল্পে পর্যবসিত হয়েছে। বনফুলের “ছােট আকৃতির গল্পগুলি লক্ষ্য করলে দেখব যে সেখানে বিষয়বস্তু বিন্যাস এমন আঁটসাঁটভাবে বাধা যেখান থেকে কোন একটি বাক্য বা শব্দকে বাদ দেওয়া অসম্ভব। বনফুলের কঠোর সংযমী ব্যক্তিত্ব এই ব্যতিক্রমী শিল্প সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। কম প্রতিভাবান লেখকের হাতে পড়লে যে বিফলতায় পর্যবসিত হত, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
কোন গল্প কোথায় শুরু করতে হৰে ৰা শেষ করতে হবে তা তিনি ভালোভাবেই জানতেন। বনফুলের এই কঠোর সংযমী ব্যক্তিত্বই তাঁর গল্পের আয়তন সৃষ্টির পক্ষে বড় ভূমিকা পালন করেছে। তাছাড়া বিষয়বস্তুর নির্বাচন এবং তাকে উপস্থাপন করার মধ্যে একটি বিশেষ কৌশল নিয়েছিলেন বনফুল। যা তৎকালীন অন্যান্য লেখকদের রচণীয় পাই না।বনফুলের প্রায় প্রত্যেকটি গল্পেই বিরােধ বাবিপ্রতীপতা সৃষ্টি করা হয়েছে। এই বিরােধসৃষ্টিতে কাহিনী ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে আপনা-আপনি পরিণতির পথে এগিয়েছে। আর শেষে নাটকীয় ভঙ্গিতে “চাবুক-হাঁকড়ানাে সমাপ্তিতে (‘Whip crack ending) পাঠকের মনে বিস্ময় উৎপাদন করেছে। বনফুলের গল্পের পরিণামী ব্যঞ্জনাই তাঁকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। বনফুলের বেশিরভাগ গল্পেরই বৃত্তান্ত অংশ খুব কম। সংযত ভাষায় ব্যাখ্যাহীন, বর্ণনাহীন, দৃশ্যম্পষ্ট হীন পদাকাক্ষার দ্বারা অন্বিত কাটা কাটা বাক্যে কার্য-কারণ সূত্রে গ্রন্থিত কয়েকটি ঘটনার ধাপ নির্মাণ কবে অকস্মাৎ উঁচু সিঁড়ি থেকে অন্ধকারে ঝাঁপ দেবার মত সংঘটনে সমাপ্তি টানেন।
এবিষয়ে সতীনাথ ভাদুড়ী মহাশয় লিখেছেন- “কুতুহলী পক্ষপাতহীন দৃষ্টিতে দূর থেকে দেখেন ‘বনফুল’। সবটুকুকে একসঙ্গে এক নজরে দেখেন না। নাটকের দৃশ্যের মত ছোট টুকরাে করে নিয়ে দেখেন। বৈজ্ঞানিক বাইনােকুলার দিয়ে যেন পাখি দেখছেন। এক এক সময় এক সীমাবদ্ধ বৃত্তের উপর তার নজর। এই কাটা কাটা ভাবটাই তাঁর পছন্দ। এই বৈশিষ্ট্যগুলি বনফুলের ‘ছােট’ (নিমগাছ’, ‘ছােটলােক,’জ্যোৎস্না, প্রভৃতি), মাঝারি (জৈবিক নিয়ম’, ‘মুহূর্তের মহিমা’ প্রভৃতি) এবং ‘বড়’ (ঐরাবত’ প্রভৃতি)—এই তিন আয়তনের পল্পেই লক্ষ্য করা যায়। প্রত্যেকটি কাটা কাটা বর্ণনা পদাকার দ্বারা কাহিনীর মধ্যে ঐক্য বজায় রেখেছে। এই কাটা কাটা বর্ণনাতে গল্প দ্রুত গতি প্রাপ্ত হয়েছে এবং পরিণতিকে তীব্রতর,শক্তি শালী ও নাটকীয় করে তুলেছে।”
বনফুলের গল্পের বিষয় মহাকাব্যোপম স্বর্গ-মর্ত-পাতাল বিস্তারী। তাই সেখানে মানব জীবনের বিবিধ অনুভূতি রূপায়িত হয়েছে। বিষয়বস্তু বাস্তব আর কল্পনার মিশ্রণে,লৌকিক ‘আর অলৌকিতার মিশ্রণে, বর্তমান আর পুরাণের সংমিশ্রণে, সমান্তরতা আর বিরােধের সমবায়ে চমৎকারিত্ব প্রাপ্ত হয়েছে। একালের সমালোচনায় যাকে ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’ (যাদু বাস্তবতা), বা ‘হ্যালােসিনেশন’ বা ‘ড্রিম রিয়ালিজম’ বলেছেন তা বনফুলের গল্পে অমিরা নানাভাবে ব্যবহৃত হতে দেখি। এ সবের রূপায়ণ হয়েছে কাহিনীর চয়ন, বয়ন এবং ‘Cohesion’ নির্মাণে। ‘Cohesion’ হল পূর্বের সঙ্গে পরবর্তী ঘটনাকে যুক্ত করে আখ্যানকে ঐক্য দান করা। আসলে তিনি ছিলেন আধুনিক ও উত্তীর্ণ-আধুনিক সাহিত্যের আঙ্গিক অনুশীলনকারী যা আমরা সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে পাইনি।
কোন মহান সাহিত্যিকই দেশ-কাল নিরপেক্ষ হতে পারেন না। সমকালের ও পূর্ববর্তীকালের নানা ঘটনা, বিষয়, পরিবেশ-পরিস্থিতি, পারিপার্শ্বিকতা, সমাজ-অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সাহিত্যিকদের রচনা কোন না কোন ভাবে পড়বেই। অন্যান্য সাহিত্যিকদের মত বনফুলের মধ্যেও পড়েছিল। তাঁর সমসাময়িক নানা ঘটনা, বিষয়, রাজনীতি, রাষ্ট্রিক পরিস্থিতি, সমাজনীতি লেখক শিল্পীদের রচনার ধারা ও ধরন কোন কোন ক্ষেত্রে পড়লেও পড়তে পারে। কেননা সমালােচকেরা বনফুলের ‘ছােট আকৃতির অণু বা মিনি গলিতে রবীন্দ্রনাথের লিপিকার ও ওহেনরির প্রভাব লক্ষ্য করেছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে এধরনের ছােট ছােট (‘Short short’) গল্প রচনার প্রবণতা বহু প্রাচীন। বিষ্ণুশর্মার ‘পঞ্চতন্ত্র”, “হিতােপদেশ’, ইশপের গল্পগুলি, সোমদেবের ‘কথাসরিৎসাগর’ বাইবেলের দুখণ্ডের গল্পগুলি, ইংরেজিতে প্যারাবল বা রূপকাৰ্তীয় গল্পগুলি, জোকস জাতীয় রচনাগুলিতে ইতিপূর্বে তার আভাস ফুটে উঠেছে। তবে মােদ্দাকথা হল সেই।
তথ্যসূত্র ও সহায়ক গ্রন্থ:
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ.ডি. (বাংলা) উপাধির জন্য প্রদত্ত গবেষণা অভিসন্দর্ভ
গবেষক: সুবল কান্তি চৌধুরী
তত্ত্বাবধায়ক: ড. নিখিল চন্দ্র রায় বাংলা বিভাগ, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় রাজা রামমােহনপুর দার্জিলিং-৭৩৪০১৩, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
১) বাংলা সাহিত্যের ছােটগল্প ও গল্পকার’ –শ্রীভূদেব চৌধুরী। মডার্ণ বুক এজেন্সি প্রাঃলিঃ। পুনর্মুদ্রণ ২০০৬-২০০৭। পৃ.- ৫৪১। ‘
২) “বনফুলের ছােটগল্প সমগ্র’—চিরন্তন মুখােপাধ্যায় সম্পাদিত। বাণীশিল্প। দ্বিতীয় সংস্করণ:, সেপ্টেম্বর ২০০৫, দ্বিতীয় খণ্ড। পৃ.-৭৫৫।
৩) “বনফুলের ফুলবন’—ড.সুকুমার সেন। সাহিত্যলােক। প্রথম প্রকাশ: দোল পূর্ণিমা ১৩৯০। পৃ.-১০।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিন অথবা পোস্ট করে রাখুন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন, তাতে আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

গৌরব রায়

বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে: ক্লিক করুন

6.7k

SHARES

Related articles

"সোজন বাদিয়ার ঘাট" কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

“সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস

ভূমিকা: বাংলা কাব্যের ভুবনে বাংলাদেশের মানসকবি জসীম উদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) আবির্ভাব বিশ শতকের তৃতীয় দশকে। তিনি রবীন্দ্র-নজরুল ও তিরিশের কবিদের বলয় ও প্রভাব মুক্ত থেকে কবিতায় এক নতুন ও ব্যতিক্রম স্বর সৃষ্টি করেছেন। সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) কবি জসীম উদদীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগরচেতনা, নাগরিক জীবন ও আচার-আচরণ সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তুলে এনেছেন, জসীম উদদীন সেখানে তার কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কবির বিকল্প জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ উপন্যাসধর্মী রচনা। এ কাব্যে প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। নিম্নে … “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ও কবিমানস ১. অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যে অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এ আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস, সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। “নমু পাড়ায় পূজা পরব, শঙ্ক কাঁসর বাজে, … মুসলমানের পাড়ায় বসে ঈদের মহোৎসবে,” ২. প্রেমভাবনা ও সমাজভাবনা দুইই পরস্পরের পরিপূরক: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যেপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে মুসলমান চাষীর ছেলে সোজন আর হিন্দু নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠরতার আলেখ্য। গ্রামের হিন্দু বালিকা দুলীর সাথে মুসলমানের ছেলে সোজনের আবল্য বন্ধুত্ব। বন্ধু থেকে আস্তে আস্তে প্রেমে পরিণত হয়। কবিতায়- “নমুদের মেয়ে আর সোজনের ভারি ভাব দুইজনে, লতার সঙ্গে গাছের মিলন, গাছের লতার সনে।“ প্রেমের তুলনায় সমাজ অতিমাত্রায় কাব্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কাব্যে সামাজিক অনুষঙ্গের উপস্থাপন করেছেন কবি। কবিতাতে তিনি সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষকে আসার আহ্বান করেছেন। সমাজের মানুষের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, খেলাধুলা প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায় কাব্যটিতে। দুলির মায়ের কণ্ঠে সমাজের রূঢ় রূপটি প্রকাশ পায়- “পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যেত পাড়ায় যে ঠেকা ভার, চূণ নাহি ধারি এমন লোকেরো কথা হয় শুনিবার!” ৩. জীবনবোধ, জীবনপদ্ধতি এবং জীবন অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ রচনা: কবি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে। শহরজীবনে বসবাস করলেও তিনি পল্লিগীতির সংগ্রাহক হিসেবে গ্রামে কাজ করেছেন। ফলে তিনি মানুষের সাথে মিশতে পেরেছেন এবং তাঁর জীবনবোধ ও জীবন অভিজ্ঞতা হয়েছে সমৃদ্ধ। তাঁর জীবনপদ্ধতি ব্যতিক্রমধর্মী এবং বড় কবিতার ধারক হিসেবেই তিনি পরিচিত। ৪. উপন্যাসধর্মী রচনা: “সোজন বাদিয়ার ঘাট” একটি উপন্যাসধর্মী রচনা। কাব্যের কবিতাগুলো জসীম উদদীন উপন্যাসের ঢংয়ে লিখেছেন। এ যেন লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক। ৫. মৌলিক রচনাধর্মী ও অনন্য: অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় সম্পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন কাহিনী নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রাম-বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। ৬. আধুনিকতা ও উদারনীতির বৈশিষ্ট্য: সময়কে এড়িয়ে না গিয়ে তাকে স্বীকার করে নিয়ে লেখা আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। প্রাণিজগতের কল্যাণকামনা করে মানবিক হওয়াও আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। এসবের সংমিশ্রণে জসীম উদদীন কবিতায় অবয়ব দিয়েছেন। হিন্দু কিশোরী দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সুজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীমউদ্দীন লিখলেন- এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে . . . এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি। ৭. চরিত্র নির্মাণে দক্ষতা: ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে লেখক চরিত্রের আমদানি করেছেন, চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং চরিত্রের পরিণতি দেখিয়েছেন। চরিত্র যেন অনুভূতির মাধ্যমে কথা বলছে। তিনি চরিত্র অনুযায়ী ভাষার ব্যবহারেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ৮. কাহিনী ও ভাষা বিন্যাসে পাণ্ডিত্য: কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। ৯. ছন্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ: আধুনিক কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীমউদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলঙ্কারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলঙ্কারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ।

Read More
কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলার বংশ পরিচয় কী?

কপালকুণ্ডলা: বাংলা সাহিত্যের একটি চরিত্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়েন। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার

Read More

Keto Diet Recipes

Keto for Beginners: A Simple 7-Day Meal Plan The ketogenic (keto) diet has taken the health and wellness world by storm, promising weight loss, increased

Read More
শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা কোন ধরনের নাটক?

শর্মিষ্ঠা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক নাটক। এটি রচিত হয় ১৮৫৯ সালে। নাটকটি মহাভারতের কাহিনীকে উপজীব্য করে পাশ্চাত্য রীতিতে রচিত হয়। নাটকটির কাহিনী মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত

Read More
Gourab Roy

Gourab Roy

I completed my Honors Degree in Bangla from Shahjalal University of Science & Technology in 2022. Now, I work across multiple genres, combining creativity with an entrepreneurial vision.

বিশ্বসেরা ২০ টি বই রিভিউ

The content is copyright protected.