ভূমিকা : চার্বাক দর্শন বা লোকায়ত দর্শন ভারতীয় দর্শনের প্রধান শাখাগুলোর অন্যতম। এটি অধ্যাত্মবাদ বিরোধী নিরীশ্বরবাদী ও বস্তুবাদী দর্শন। এই দর্শন কোনো প্রকার প্রত্যাদেশে বিশ্বাসী নয়, ‘প্রমাণ’ই এ-দর্শন অনুসারে যথার্থ জ্ঞানের উৎস। পারলৌকিক নয়, ইহজাগতিক সুখ ভোগই মানুষের একমাত্র কাম্য বলে চার্বাকরা মনে করত। চার্বাক দর্শনের প্রভাব বুদ্ধের সময় ও প্রাক-বুদ্ধ যুগে উপস্থিত ছিল বলে অনেকে মনে করে থাকেন। এ দর্শনের অপর নাম লোকায়ত দর্শন। নিম্নে চার্বাক দর্শনের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হলো :
মূল আলোচনা : চার্বাক দর্শনের মূল গ্রন্থ এখনো পাওয়া যায়নি বলে চার্বাক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা কে , এ সম্পর্কে মতভেদ লক্ষ্য করা যায় । কেউ কেউ বলেন প্রাচীন কালে চার্বাক এক ঋষি ছিলেন ; তিনিই চার্বাক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা । আবার কারো মতে ‘চর্ব’ ধাতু থেকেই চার্বাক শব্দটির উৎপত্তি। চর্ব ধাতুর অর্থ চর্বণ বা খাওয়া । এই দর্শন খাওয়া দাওয়াকেই জীবনের চরম লক্ষ্য মনে করে । তাই এ দর্শনের নাম চার্বাক দর্শন । আর একদলের মতে চাবাক শব্দের অর্থ চারু + বাক , অর্থাৎ মধুর কথা । আবার কারো মতে , অসুরগনকে ধ্বংস করবার জন্য লোক – পুত্র বৃহস্পতি অসুরদের মধ্যে এই ভোগমূলক বা জড়বাদী দর্শনের প্রচলন করেছিলেন । চার্বাক শব্দের অর্থ যাই হোক না কেন বা যিনিই এর প্রতিষ্ঠাতা হোক না কেন চার্বাক দর্শন বলতে জড়বাদী নাস্তিক দর্শনকেই বুঝায় । সাধারন মানুষের কাম্য হলো জাগতিক সুখভোগ, এই দর্শনের মতেও জীবনের চরম লক্ষ্য সুখভোগ । সুতরাং দেখা যাচ্ছে সাধারন লোকের চিন্তা ও ভাবধারা এই দর্শন তুলে ধরেছে। এ কারনে এ দর্শনের অপর নাম লোকায়ত দর্শন ।
আবির্ভাব : ছান্দোগ্য উপনিষদে অসুর শব্দটি এক শ্রেণীর অবিশ্বাসী অর্থে ব্যবহৃত যাদের কাছে জাগতিক সুখভোগ জীবনের চরম লক্ষ্য । অসুর সংজ্ঞা যদি চার্বাক মতে বিশ্বাসী কোন গোষ্ঠীকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয় , তাহলে মৈত্রায়ণীয় ও ছান্দোগ্য উপনিষদের রচনাকালেই চার্বাক মতবাদের গোড়াপত্তন হয়েছিল বলে অনুমান করা যায় । বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে উদ্ধৃত চার্বাকী মতের বিবরণ এই চিন্তাধারার সঠিক কাল সম্বন্ধে সামান্যই তথ্যপ্রদান করতে পারে , তবে উপনিষদীয় যুগের বৃহৎ পরিসরে এই কালকে অন্তর্ভুক্ত করা যায় । ছান্দোগ্য উপনিষদ ও বৃহদারণ্যক উপনিষদের রচনাকাল খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বুদ্ধদেবের আবির্ভাবের পূর্ববর্তী বলে অনুমান করা হলে চার্বাক মতের জন্ম এই কালেই হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়।
উৎস : চার্বাক গোষ্ঠীর নিজস্ব রচনা হিসেবে জয়রাশি ভট্টের আনুমানিক অষ্টম শতাব্দীতে রচিত ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ নামক একটি মাত্র গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায় । সেই কারণে চার্বাক দর্শন সম্বন্ধে অধিকাংশ তথ্যের উৎস হিসেবে ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন গ্রন্থের চার্বাকী মতবাদের বিরুদ্ধ সমালোচনা গুলোরই উল্লেখ করা হয়ে থাকে । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ন্যায় দার্শনিক জয় ভট্টের নবম শতাব্দীতে রচিত ন্যামঞ্জরী , বৌদ্ধ পন্ডিত শান্তরক্ষিতের ও অষ্টম শতাব্দীতে রচিত ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ । ভারতীয় দর্শনের যে সকল সঙ্কলন গ্রন্থ চার্বাক দর্শনকে অন্তর্ভুক্ত তা হলো : ষড়দর্শনসমুচ্চয় , চতুর্দশ শতাব্দীতে রচিত মাধবাচার্যের ” সর্বদর্শনসমগ্র ” ও শঙ্করাচার্যের রচনা বলে পরিচিত সর্বদর্শনসিদ্ধান্তসংগ্রহ ।
চার্বাক সিদ্ধান্ত : চার্বাক দর্শনের মতে প্রত্যক্ষই ( Perception ) একমাত্র প্রমান অর্থাৎ যথার্থ জ্ঞান লাভের উপায় । চার্বাক দর্শন অনুমান ও শব্দকে প্রমাণরুপে গ্রহন করে নাই । অনুমান ( Inference ) ও শব্দের ( Testimony ) দ্বারা কোন নিঃসন্দিগ্ধ ও যথার্থ জ্ঞান লাভ করা যায় না । চার্বাকপন্থীরা বলেন যা ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ লব্ধ নয় তা বিশ্বাসযোগ্য নয় । যে বস্তুকে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে প্রত্যক্ষ করা যায় বা অনুভব করা যায় , একমাত্র সে বস্তুরই অস্তিত্ব স্বীকার করা যায় ।
প্রত্যক্ষ প্রমাণ : চার্বাক দর্শন সম্বন্ধে বিভিন্ন দর্শন সঙ্কলনগুলিতে প্রত্যক্ষ প্রমাণবাদী হিসেবে বর্ণনা করা হযেছে । ষড়দর্শনসমুচ্চয় গ্রন্থে বলা হয়েছে চার্বাকের জগতের আয়তন ইন্দ্রিয়গোচরতার মধ্যে সীমাবদ্ধ । ইন্দ্রিযের দ্বারা প্রত্যক্ষ বস্তুজ জ্ঞানই চার্বাকগোষ্ঠী প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করেন বলে অধিকাংশ দর্শন গ্রন্থগুলি উল্লেখ করলেও জয় ভট্টের “ ন্যায়মঞ্জরী ” গ্রন্থে অপর এক মতবাদকে চার্বাকের মতবাদ বলে উল্লেখ করেছেন । এই মতবাদ অনুসারে , প্রমাণ এবং প্ৰমেয়ের সংখ্যা ও লক্ষণের অনৈক্যই হল তা । “ তত্ত্বোপপ্লবসিংহ ” গ্রন্থে এই মতবাদের সমর্থন পাওয়া যায় । এই তথ্যের মতে জাগতিক বস্তুনিচযের সত্যাসত্য নির্ণযের মান বাস্তবিকপক্ষে কখনোই ত্রুটিমুক্ত না হওযার দরুন প্রমাণ ও প্রমেয় সম্বন্ধে ধারণাও ত্রুটিমুক্ত হয় না ।
অনুমান প্রমাণ : ন্যায় দর্শন দ্বারা স্বীকৃত অনুমানের দ্বারা প্রমাণকে চার্বাক মতে অনুমোদন করা হয়নি। অনুমানলব্ধ জ্ঞানের হেতু বা সাধনের সঙ্গে অনুমান বা সাধ্যের সম্পর্ক বা ব্যাপ্তিকে চার্বাকবাণী দার্শনিকেরা ভ্রান্ত হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন । তাঁদের মতে অভ্রান্ত ব্যাপ্তিজ্ঞানের উৎপত্তি প্রত্যক্ষের সাহায্যে সম্ভব নয় । “ তত্ত্বোপপ্লবসিংহ ” গ্রন্থে এর প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেশ , কাল ও স্বভাবের ব্যবধানকে এর কারণ হিসেবে ধরা হয়েছে । এই পরিবর্তনশীল জগতে দেশ , কাল ও পরিবেশের বিভিন্নতা অনুযায়ী বস্তুজগত ও তার ধর্ম প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয় , তাই অনুমান দ্বারা ব্যাপ্তিজ্ঞানকে চিরকালীন ধরে নেওয়া যায় না । চার্বাক মতে অনুমান সম্ভাবনার আভাষ মাত্র ।
আপ্তবাক্য প্রমাণ : আপ্তবাক্য অনুমানের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় এর দ্বারা প্রমাণ চার্বাকগণের মতে ভ্রান্ত বলে বিবেচিত । আপ্তবাক্যের সত্যতার ভিত্তি নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির উক্তি যা ব্যক্তির ব্যাপ্তিজ্ঞানে বিশ্বাসের ওপর অধিকাংশ সময়ে নির্ভরশীল হওয়ায় তা চাবাক মতে গ্রাহ্য নয় ।
দেহাবাদ : প্রত্যক্ষবাদী চার্বাকেরা বস্তুজগতের মূলগত উপাদানের সংখ্যা চারে সীমিত রাখেন। এগুলি হল ক্ষিতি , অপ , তেজ ও মরুৎ । ব্যোম বা আকাশকে প্রত্যক্ষ করা যায় না বলে একে জগতের মূল উপাদানের মধ্যে তাঁরা ধরেন না ।
চার্বাকগণ বলেন , ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা জড় জগৎকে প্রত্যক্ষ করি । এই জড়জগত ক্ষিতি ( Earth ) অপ ( Water ) তেজ ( Fire ) মরুৎ ( Air ) এই চার ভূতের দ্বারাই গঠিত। চার্বাকগণের মতে চন্দ্র , সূর্য , গ্রহ , নক্ষত্র , বৃক্ষ , লতা সহ জগতের যাবতীয় এমনকি মানব দেহও এই চারি ভূতের সমন্বয়ে গঠিত এবং তাহাদের বিয়োগের ফলে বিনষ্ট হয় । চার্বাকগণ চেতনার ( Consciousness ) অস্তিত্ব স্বীকার করেন ; কারন চেতনা দেহের ধর্ম এবং ইন্দ্রিয়গ্ৰহ্য । এখন প্রশ্ন হলো ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ – এই চারি ভূতের কোনটিতেই যখন চেতনা নাই , তবে এই চারি ভূতের সংমিশ্রনে সৃষ্ট চেতনা।
দেহে চেতনা আসবে কেমন করে :
এর উত্তরে চার্বাক গণ বলেন , উক্ত চারিভূভের কোনটিতেই চেতনারুপ না থাকলেও চারিভূতের নির্দিষ্ট পরিমান সংমিশ্রনের ফলে এইগুনটি তৈরি হতে পারে । যেমন – পান, সুপারি ও চুন এই তিনটি বস্তুর ভিতর কোনটিরই লাল রং নেই । তবু এই তিনটি বস্তুকে একসাথে চর্বন করলে লাল রং দেখা যায় । তাঁহার বলেন , দেহ ছাড়া চেতনারুপ গুনের ভিন্ন সত্তা নাই । এবং দেহ ধ্বংস হওয়ার সাথে সাথে চেতনা গুনটি নষ্ট হয়ে যায় । তাঁদের মতে চৈতন্যবিশিষ্ট দেহই হলো আত্মা । দেহ ছাড়া আমার কোন সত্তা নাই । অর্থাৎ আত্মা ও দেহ অভিন্ন ; দেহ বিনষ্ট হলে আম্মাও বিনষ্ট হয় রাং চার্বাকদের মতে আত্মার অমরতার প্রশ্ন অবান্তর । মানুষের বর্তমান জীবনই একমাত্র জীবন ।পরজন্ম বলে কোন কিছু চার্বাকগণ বিশ্বাস করেন না । কারন পরজন্মের অস্তিত্বের কোন প্রমান নেই । সুতরাং মৃতুর পরেও মানুষকে তার কুকর্মের জন্য দুঃখভােগ সুকাজের জন্য মানুষ সুখভােগ করবে – এইসকল কথা তাঁদের মতে অর্থহীন ।
ভগবানের কাহিনী পৌরনিক গল্প ছাড়া আর কিছুই নয় । সুতরাং পরজন্মে সুখভোগের জন্য ঈশ্বরকে তুষ্ট করার জন্য তাঁর পূজা অর্চনা করা বোকামী মাত্র । তাঁরা বলেন ধূর্ত পুরোহিতদের বিশ্বাস করা মানুষের উচিত নয় । কারন পুরোহিতগণ নিজেদের জীবিকা অর্জনের জন্য ঈশ্বরের পূজা করার জন্য মানুষকে প্রলুব্ধ ও প্ররোচিত করে । মৃত ব্যাক্তির শ্রাদ্ধকৃত্যাদির কোনো ফলই নেই , ইহা শুধু ব্রাক্ষণদের রোজগারের পথ ।
ভারতীয় দার্শনিকগণের মধ্যে অনেকেই আত্মার মুক্তি বা মোক্ষলাভকে মানব জীবনের পরম কল্যান বা চরম লক্ষ্য বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু চার্বাকগণ বলেন , আমারই যেখানে কোন সত্তা নাই সেখানে আমার মুক্তির প্রশ্ন অবান্তর মাত্র । তাঁদের মতে ইন্দ্রিয় – সুখই মানুষের পরম কল্যান । তাই এই ইন্দ্রিয় – সুখই তাদের জীবনের চরম লক্ষ্য হওয়া উচিত । চার্বাকগণ আরো বলেন , অতীত চলে গেছে , ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত , কেবল বর্তমান মানুষের আয়ত্বে আছে । সুতরাং বর্তমান জীবনে মানুষ যে উপাযেই হোক , যত বেশি সুখ করতে পারে তা করা উচিত ।
উপসংহার : চার্বাক দর্শন কুসংস্কার , অন্ধবিশ্বাস ও অর্থহীন প্রচলিত রীতি নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে । এই বিদ্রোহ ভারতবর্ষে নির্বিচার দর্শনের ভিত্তি উৎপাটিত করে সবিচার দর্শনের ভিত্তি রচনা করেছে । এই দর্শন সাধারন মানুষকে আত্ম – নির্ভরতার পথ দেখিয়েছে । দর্শনে যে অবিচারিত মত ও মতের মহান নেই চার্বাক দর্শন তা পতিপন্ন করতে সক্ষম হযেছে । স্বার্থান্বেষী ব্রাহ্মণদের ষড়যন্ত্রকে চার্বাক দর্শন কঠোর আঘাত করেছে । এখানেই এ দর্শনের সার্থকতা ।