ভূমিকা : বাউল মতবাদকে একটি মানস পুরাণ বলা হয়। দেহের আধারে যে চেতনা বিরাজ করছে, সে-ই আত্মা । এই আত্মার খোঁজ বা সন্ধানই হচ্ছে বাউল মতবাদের প্রধান লক্ষ্য। অন্যদিকে ভগবান বিষ্ণু বা কৃষ্ণকে ভক্তির মাধ্যমে ভজনা করা বৈষ্ণববাদ বা বৈষ্ণব ধর্মীয় মতবাদের মূল ভিত্তি। তাছাড়া সুফিবাদ একটি ইসলামি আধ্যাত্মিক দর্শন। আত্মা সম্পর্কিত আলোচনা এর মুখ্য বিষয়। আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনই হলো এই দর্শনের মর্মকথা। নিম্নে বাউল, বৈষ্ণব ও সুফিবাদ দর্শনের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য আলোচনা করা হলো :
বাউল, বৈষ্ণব ও সুফিবাদ সম্পর্কে তাত্ত্বিকদের মতামত : ‘বাংলাদেশের লোক সাহিত্য ও লোকঐতিহ্য, লালন শাহ বিবেচনা-পূর্নবিবেচনা’ প্রভৃতি গ্রন্থে গবেষকগণ লিখেছেন: আরবের রাজ শক্তির প্রতিঘাতে জন্ম হয়েছে সুফি মতবাদের । এটিকে লালন-পালন করেছে পারস্য। বিকাশ ইরান ও মধ্য এশিয়ায়। পরবর্তিতে যতই পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে থাকে এর মধ্যে ততই পূর্বদেশীয় ভাবধারার সম্মিলন ঘটতে থাকে। দহ্মিণ এশিয়ায় এসে অধ্যাত্ম সঙ্গীত চর্যাগীতিতে রুপান্তর হয়। অতপর তুর্কী বিজয়ের মধ্যদিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সূফী-দরবেশ গণের আগমনে বৌদ্ধ সিদ্ধাচর্যাগণের আদর্শ মানবতাবাদ, সুফীবাদে সম্মিলিত হয়ে ভাবসঙ্গীতে রুপান্তর হয় । ফলে সুফী দর্শন অতি সহজে বৌদ্ধের কাছের প্রশংসনীয় হয় । কাজেই একদিকে সূফীবাদ এবং অন্যদিকে বৌদ্ধ সাধনা এই সকলের সমম্বয়ে গড়ে উঠে মরমী ভাব-সাধনা৷
গবেষক সৈয়দ মোস্তফা কামাল, ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী সহ অনেকে এ অভিমত পোষন করেন; মধ্যযুগের প্রারম্ভে বাংলার শ্যামল জমিনে অদৈত্ববাদের মধ্যদিয়ে ভারতে চৈতন্যবাদ বিকশিত হয় পঞ্চদশ শতাব্দিতে। তখন ভাগবতধর্ম, আদি রামধর্ম ও কৃষ্ণধর্মের মিলনে বৈঞ্চবধর্ম আত্মপ্রকাশ করে। এতে করে বৈঞ্চবী সাধন পদ্ধতির মধ্যে অনিবার্য রূপে শামিল হয় প্রাচীন মরমীবাদ, যা আজকাল বাউল নামে অভিহিত।
বাউল মতবাদ : বাউল এর ভাব অর্থ হলো, স্রষ্টা প্রেমিক, স্বাধীন চিত্ত, জাতি সম্প্রদায়ের চিহ্নহীন এক দল সত্য সাধক, ভবঘুরে। বাউলদের মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে বাউল সঙ্গীত নামে পরিচিত আধ্যাত্মচেতনার গান।
বাউল ও বাউলা মতবাদের উৎপত্তিকাল আনুমানিক ১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ। ‘বাংলার বাউল ও বাউল গান’ গ্রন্থে প্রফেসর উপেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য এ অভিমত পোষণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করেন, বৌদ্ধদের মহাযান পন্থী থেকে বাউলদের উদ্ভব। বাউলদের রয়েছে নানাবিধ শাখা-প্রশাখা ।
বাউলদের বিশ্বাস : জগমোহন গোঁসাই, জগন্মোহিনী বাউল সম্প্রদায়ের প্রবর্তক। তাকে আদি বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক হিসেবেও গণ্য করা হয়। বাউলদের আদি জগন্মোহিনী সম্প্রদায়ের জপতপের মূলমন্ত্র ‘গুরু সত্য’। এরা পরলোকগত গুরুর পাদুকা বা জুতাকে সযত্নে সংরক্ষণ করে ভক্তি শ্রদ্ধা করে। বিবাহ-শাদীও হয় তাদের নিজস্ব তরিকায়। এরা কোন ধরনের জাতপাতের ধার ধারে না। এদের মধ্যে ছোয়াছুইরও কোন বালাই নেই। এ সম্প্রদায়ের বাউলরা তিন ভাগে বিভক্ত। গৃহী, সংযোগী ও উদাসী। এটি বেশ প্রাচীন ধারা। তারা মনে করেন, এই এক জীবনে স্রষ্টার ভালোবাসা পাওয়া যথেষ্ট, তবে সে ভালোবাসা খুব সহজে পাওয়া সম্ভব নয়। এর জন্য প্রচুর সাধনা করতে হবে। পরবর্তীকালে (আনুমাণিকঃ ১৯ শতকের শুরু থেকে) এদের প্রভাব এক শ্রেণীর মুসলমান বাউলদের মাঝে আছর করে। ফলে বাউল কবি মুসলমান হলেও এরা ইসলামী শরীয়তের হুকুম আহকামের ধার ধারে না। এরা মানবধর্মে বিশ্বাসী। এরা বিভিন্ন ধরনের বাক-ভঙ্গি ও মুখরুচক বাক্য দ্বারা সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করে ।
বৈষ্ণববাদ : ভগবান বিষ্ণু বা কৃষ্ণকে ভক্তির মাধ্যমে ভজনা করা বৈষ্ণববাদ বা বৈষ্ণব ধর্মীয় মতবাদের মূল ভিত্তি। এখন বাংলাভাষী অঞ্চলে বৈষ্ণব ধর্ম গৌড়ীয় ধর্ম-দর্শনের প্রায় সমার্থক, যা প্রধানত কৃষ্ণের আদি রসাত্মক লীলায় ভরপুর। এই ধর্ম-দর্শনের প্রেরণা ও প্রতিষ্ঠাতা হলেন শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩), যাঁর ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে, তিনি হলেন স্বয়ং ভগবান পরমেশ্বর কৃষ্ণের প্রতিমূর্তি এবং যিনি চির মিলনে ও বিরহে রাধাকৃষ্ণের যুগলসত্তাস্বরূপ। চৈতন্য ও কৃষ্ণ এতটাই একীভূত যে, একজনকে পূজা করা মানে অন্য জনকেও পূজা করা। গৌড়ীয় ধর্মতত্ত্বের চমৎকারিত্ব এবং এর প্রাথমিক কৃত্যসমূহের সহজ রূপ, যেমন, কীর্তন গানে খুব সহজভাবে কৃষ্ণের সংকীর্তন, পাঁচ শতক ধরে বাংলার প্রত্যেক রাজনৈতিক ভাঙ্গাগড়ায় বৈষ্ণব সম্প্রদায়কে অভূতপূর্ব সাফল্যের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সক্ষম করেছে।
প্রায়শ নৃত্যযোগে পরিবেশিত কীর্তন গান নবদ্বীপে চৈতন্য-সম্প্রদায়কে ভক্তির উন্মত্ততায় উদ্বেলিত করে তোলে, যা অতি সহসা ঐ অঞ্চলের অন্য বৈষ্ণবদের ভাবনাকেও উদ্দীপিত করে। ঐ কালের ইতিহাসমূলক ও জীবনচরিতমূলক উপাদানের শাস্ত্রীয় ভাষা এই যুক্তি দেয় যে, এই সময়ে এ অঞ্চলে বৈষ্ণব ধর্ম ছিল ভয়াবহ অবক্ষয়ের সম্মুখীন এবং কেবল বৈষ্ণব ধর্ম থেকে ভক্তিবাদের উত্থান ঘটে নি। আগে থেকেই ভক্তিবাদের নব উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছিল এবং তা সহসা জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল।
চৈতন্য প্রকাশ্যভাবে ভাব-ভক্তি নামে অভিহিত প্রেমের মূল আবেগের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে এমন এক অভিজ্ঞতাকে ধারণ করেছে যা সকল মানুষের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ বৃত্তি হিসেবে পর্যবসিত এবং যা মুক্তির উপায় হিসেবে নব রূপও লাভ করে। এই নব ভক্তিবাদী ধর্মাচারের মূল সূত্র হলো গতানুগতিক আদিরস বা কাম ভাবের সঙ্গে যুক্ত মৌল মানবিক বৃত্তিগুলি এবং সকল মানুষের অনুভবগম্য অন্যান্য কম জটিল বা স্বাভাবিক প্রেমরূপকে সূচনাবিন্দু ধরে শৃঙ্খলার সঙ্গে কৃষ্ণপ্রেমের অনুভূতির নিবিষ্ট পরিচর্যা। এই জাগতিক প্রেমকে আধ্যাত্মিক ভাবাদর্শে সফলভাবে রূপ দিতে জাতপাত নির্বিশেষে প্রত্যেক ভক্তকে বৈদিক বিধানের অনুশাসনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এক গুচ্ছ ধর্মকৃত্য অনুসরণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্দেশিত চৌষট্টিটি কৃত্যের মধ্যে ভক্তিরসামৃত সিন্ধু (১.২.৯০-৯২, ২৩৮-৪৫) পাঁচটিকে সর্বাধিক ফলদায়ক হিসেবে উল্লেখ করেছে, কারণ এগুলি অপর সকল কৃত্যের ভিত্তিরূপে পরিগণিত। এই পাঁচটি কৃত্য হচ্ছে
১. কৃষ্ণের নাম সংকীর্তন;
২. কৃষ্ণের কীর্তিগাথাপুষ্ট ভাগবত পুরাণের বিশেষ বিশেষ অংশ স্মরণ ও আস্বাদ লাভ;
৩. মন্দিরে শ্রদ্ধা ও প্রেমভাবে কৃষ্ণমূর্তির পরিচর্যা;
৪. সাধুসঙ্গে অধিবাস এবং
৫. মথুরা বা ব্রজমন্ডলে অবস্থান।
পাঁচটি মূল নির্দেশের প্রথমটি থেকেই ভক্তরা কৃষ্ণের নাম কীর্তনে ব্যবহূত সবচেয়ে সাধারণ মন্ত্র শ্রবণ করে থাকে। মন্ত্রটি হলো ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে/ হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে’। নামকীর্তনের এই সহজ কর্ম থেকেই ভক্তির সকল রূপ উদ্ভূত এবং ঐসব কৃত্যানুষ্ঠান থেকে ভক্তের হূদয়মনে বিশুদ্ধ প্রেমের ধারাক্রমিক বিকাশ ঘটে থাকে।
ধর্মের কর্তৃত্ব-শক্তি এখন গ্রন্থ প্রণয়ন ও মুদ্রণের কাজে নিয়োজিত, যা আইন সঙ্গত নেতৃত্ব ও প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে সেবাধর্ম পালন করে থাকে। পাঁচ শতকের অব্যাহত বিকাশের পরে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ঐতিহ্য সাধারণভাবে রক্ষণশীলতার দিকে মোড় নিয়েছে, যা সমাজে এর কেন্দ্রীয় অবস্থান রক্ষা করেছে এবং বাংলা ভাষী অঞ্চলে এর বিশিষ্টতা নিশ্চিত করেছে।
সুফিবাদ : সুফিবাদ একটি ইসলামি আধ্যাত্মিক দর্শন। আত্মা সম্পর্কিত আলোচনা এর মুখ্য বিষয়। আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনই হলো এই দর্শনের মর্মকথা। ইসলামি পরিভাষায় সুফিবাদকে তাসাওউফ বলা হয়, যার অর্থ আধ্যাত্মিক তত্ত্বজ্ঞান। তাসাওউফ বা সুফিবাদ বলতে অবিনশ্বর আত্মার পরিশুদ্ধির সাধনাকে বুঝায়। আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে ফানাফিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে অবস্থান করা) এবং ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে স্থায়িভাবে বিলীন হয়ে যাওয়া) লাভ করা যায়। যেহেতু আল্লাহ নিরাকার, তাই তাঁর মধ্যে ফানা হওয়ার জন্য নিরাকার শক্তির প্রতি প্রেমই একমাত্র মাধ্যম। তাসাওউফ দর্শন অনুযায়ী এই সাধনাকে ‘তরিকত’ বা আল্লাহ-প্রাপ্তির পথ বলা হয়। তরিকত সাধনায় মুর্শিদ বা পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন হয়। সেই পথ হলো ফানা ফিশ্শাইখ, ফানা ফিররাসুল ও ফানাফিল্লাহ। ফানাফিল্লাহ হওয়ার পর বাকাবিল্লাহ লাভ হয়। বাকাবিল্লাহ অর্জিত হলে সুফি দর্শন অনুযায়ী সুফি আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ শক্তিতে শক্তিমান হন। তখন সুফির অন্তরে সার্বক্ষণিক শান্তি ও আনন্দ বিরাজ করে।
হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর মতে মানবদেহে একটি বিশেষ অঙ্গ আছে, যা সুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ পরিশুদ্ধ থাকে, আর অসুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ অপরিশুদ্ধ হয়। জেনে রাখো এটি হলো কল্ব বা হূদয়। আল্লাহর জিকর বা স্মরণে কল্ব কলুষমুক্ত হয়। সার্বক্ষণিক আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমে কল্বকে কলুষমুক্ত করে আল্লাহর প্রেমার্জন সুফিবাদের উদ্দেশ্য। যাঁরা তাঁর প্রেমার্জন করেছেন, তাঁদের তরিকা বা পথ অনুসরণ করে ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ অর্জন করাই হলো সুফিদর্শন।
সুফিবাদ উৎকর্ষ লাভ করে পারস্যে। বাংলাদেশে সুফিবাদের আবির্ভাবকাল সঠিকভাবে বলা কঠিন। তবে এগারো শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে সতেরো শতাব্দী পর্যন্ত এদেশে ইসলামের সর্বাধিক প্রচার ও প্রসার হয়েছে বলে জানা যায়। আরব, ইয়েমেন, ইরাক, ইরান, খোরাসান, মধ্য এশিয়া ও উত্তর ভারত থেকে সুফিরা এসে বঙ্গদেশে সুফিবাদ প্রচার করেন।
সৃষ্টির প্রতি প্রেমের মাধ্যমে স্রষ্টার প্রেমার্জন সুফিবাদের এই আদর্শের দ্বারা বৈষ্ণবধর্ম, লৌকিক মরমিবাদ, বাউল ধর্মমত ও অন্যান্য ভক্তিবাদ কমবেশি প্রভাবিত হয়। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনেও সুফিদের প্রভাব লক্ষ করা যায়। যেমন নদী ও সমুদ্রপথে যাতায়াতের সময় মাঝিরা বদর পীরের নাম স্মরণ করে। শুধু তাই নয়, নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে শহরের যানবাহনে পর্যন্ত বিভিন্ন পীর-আউলিয়ার নাম লেখা থাকে। এভাবে বাংলাদেশে মানুষের ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বৈষয়িক জীবনের নানা ক্ষেত্রে সুফিবাদের প্রভাব অক্ষুণ্ণ রয়েছে।