ভূমিকা : মহাকাব্য হচ্ছে দীর্ঘ ও বিস্তৃত কবিতা বিশেষ। সাধারণত দেশ কিংবা সংস্কৃতির বীরত্ব গাঁথা এবং ঘটনাক্রমের বিস্তৃত বিবরণ এতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরা হয়। সুপ্রাচীনকালে মুখে মুখে প্রচলিত কবিতাসমগ্রও মহাকাব্যের মর্যাদা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের সূত্রপাত থেকে কাব্যের একচ্ছত্র আধিপত্য বিদ্যমান থাকলেও উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের পূর্ব পর্যন্ত কোন মহাকাব্য রচিত হয়নি। তখন নানা কাহিনী কাব্য প্রচলিত থাকলেও সেসব মহাকাব্য হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার অধিকার ছিলনা। পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাবে বাংলা সাহিত্যে এই বিশেষ শাখাটির সূত্রপাত এবং বিশেষভাবে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বেশ কিছুসংখ্যক মহাকাব্য রচিত হয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। উনিশ শতকের জাতীয়তাবোধ এই রচনা প্রাচুর্যের মূল কারণ। নিম্নে বাংলা সাহিত্যে মহাকাব্যের ধারা তুলে ধরা হলো:
মূল পর্ব : উনিশ শতকে বাঙালির জাতীয় জীবনে যে নবচেতনার সৃষ্টি হয়েছিল তারই প্রতিফলন ঘটেছে বাংলা মহাকাব্য গুলোতে। জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করে জাতীয় জীবনে পরিবর্তন আনয়নের চেষ্টাই এর পশ্চাতে কার্যকর ছিল।
মহাকাব্য সম্পর্কে এরিস্টটল বলেন, “মহাকাব্য আধিপত্য অন্তর সমন্বিত বর্ণনাত্মক কাব্য। এতে বিশিষ্ট কোন নায়কের জীবন কাহিনী অখন্ড রূপে একই বিরচিত যন্ত্রের সাহায্যে কীর্তিত হয়”।
মহাকাব্য নিয়ে আলবার্ট লর্ড এবং মিলম্যান প্যারী গবেষণা করেছেন। তারা উভয়েই যুক্তিপ্রদর্শন সহকারে ঐক্যমতে পৌঁছেছেন যে, “আধুনিককালের মহাকাব্যগুলো প্রকৃত অর্থে প্রাচীনকালের মৌখিকভাবে প্রচলিত ও প্রচারিত কবিতাসমগ্রেরই শ্রেণীবিভাগ মাত্র”।
বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত মহাকাব্যের যে ধারার প্রবর্তন করেছিলেন পরবর্তী পর্যায়ে তা হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, কায়কোবাদ প্রমুখ মহাকবি কর্তৃক অনুসৃত হয়। কিন্তু তাঁদের পরবর্তী কালের বাংলা সাহিত্যে আর মহাকাব্য রচিত হচ্ছে না। এমনকি রবীন্দ্রনাথের মতো বিস্ময়কর প্রতিভা সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রে নিয়োজিত হলেও মহাকাব্য রচনায় নিয়োজিত হয়নি। বর্তমানে মহাকাব্যের যুগ শেষ হয়ে গেছে বলে মনে করা হয়। মহাকাব্যের ধারায় যাঁরা অবদান রেখেছে তাদের নিম্নে তুলে ধরা হলো :
মাইকেল মধুসূদন দত্ত : বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মহাকাব্যের ধারার সূত্রপাত করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-৭৩)। ১৮৬১ সালে প্রকাশিত ‘মেঘনাদবধ কাব্যের’ মাধ্যমে মহাকাব্যের পূর্ণাঙ্গ রূপের অনবদ্য প্রকাশ ঘটে এবং বাংলা সাহিত্যের তা প্রথম মহাকাব্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। মধুসূদন এর যুগে মহাকাব্য রচনাই সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মর্যাদালাভের একমাত্র উপায় ও পরীক্ষা স্তর বলে বিবেচিত হতো। সেজন্য মধুসূদন যখন বাংলায় শ্রেষ্ঠত্য প্রতিষ্ঠার জন্য মনস্থির করলেন তখন তিনি হোমার, ভার্জিল, দান্তে, ট্যাসো প্রভৃতি বিদেশি এবং ব্যাস, বাল্মীকি প্রভৃতি দেশীয় মহাকবিদের রচনার প্রতিস্পর্ধী মহাকাব্য রচনার দুঃসাহসিক কল্পনাকেই রূপদানের কাজে প্রবৃত্ত হলেন।
মেঘনাদবধ কাব্যে মধুসূদন বাল্মীকির রামায়ণ থেকে স্বল্প পরিমিত কাহিনী সংগ্রহ করেন। বীরবাহুর নিহত হওয়ার সংবাদ থেকে মেঘনাদের হত্যা এবং প্রমীলার চিতারোহণ পর্যন্ত তিন দিন, দু রাত্রির ঘটনা এতে বর্ণিত হয়েছে। নয় সর্গের কাব্যকে মধুসূদন ঠিক মহাকাব্য বলেন নি, বলেছেন Epicling – ছোট মাপের মহাকাব্য। মধুসূদনের ব্যক্তিজীবন, কবিমানস ও যুগমানসে যে বিদ্রোহ বিদ্যমান ছিল মেঘনাদবধ কাব্যের ছন্দে ও ভাবে তার প্রকাশ ঘটেছে। মধুসূদনের ব্যক্তিজীবনে যেমন প্রথমদিকে তাঁর ঐশ্বর্য ছিল কিন্তু শেষ দিকে তাঁকে দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে জীবন কাটাতে হয়েছে তেমনি এই বিষয়টি তার মেঘনাদবধ কাব্যে ফুটে উঠেছে।মেঘনাদবধ কাব্যের রাবণ চরিত্রটির প্রথমদিকে ঐশ্বর্য ছিল কিন্তু শেষ দিকে তার সব ঐশ্বর্য লোপ পেয়েছে। ফলে বাস্তবতাই মহাকাব্যটি সার্থক করে তুলেছে।
হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় : মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রবর্তিত মহাকাব্যের ধারা অনুসরণে যাঁরা এক্ষেত্রে আত্মনিয়োগ করেছিলেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৯০৩) তাদের অন্যতম । বিধর্মী মধুসূদন কর্তৃক হিন্দু সংস্কৃতির মহিমা উচ্চারণ তার অনুসারীগণকে হিন্দু জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে মহাকাব্য রচনায় প্রেরণা দান করেছিল। পৌরাণিক বিষয় অবলম্বনে কাব্য রচনার দৃষ্টান্ত স্থাপনে মধুসূদনের কৃতিত্ব পরবর্তী কবিগণের মনে উৎসাহ উদ্দীপনার সঞ্চার করে । হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রেরণায় উৎসাহিত হয়ে হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে হিন্দু জাতীয়তাবোধ প্রকাশক “বৃত্রসংহার কাব্য” (প্রথম খণ্ড ১৮৭৫ , দ্বিতীয় খণ্ড ১৮৭৭) রচনা করেন । পৌরাণিক কাহিনি মূল কাঠামো হিসেবে গ্রহণ করে হেমচন্দ্র তার কৰিমানসের বিচিত্র কল্পনা রূপায়িত করে তুলেছেন । বৃত্র নামক অসুরুকর্তৃক স্বর্গবিজয় এবং দেবরাজ ইন্দ্ৰকর্তৃক স্বর্গের অধিকার পুনঃস্থাপনা ও বৃত্রাসুরের নিধন এই মহাকাব্যের মূল বিষয়বস্তু ।
হেমচন্দ্রের কাব্যসাধনার পশ্চাতে জাতীয়তাবোধের যে বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে তা এদেশের সমগ্র অধিবাসীর একটা অংশমাত্র — বিশেষত হিন্দুজাতিকে কেন্দ্র করেই প্রকাশ পেয়েছে । মাইকেল মদুসূদন দত্তের কাব্যসাধনায় জন্মভূমি প্রীতির মধ্যে যে উদারতা প্রত্যক্ষ করা যায় , হেমচন্দ্রের মধ্যে তা একেবারেই অনুপস্থিত। দেশের সর্বাঙ্গীন রূপটি তাঁর কাব্যে বিধৃত না হয়ে শুধু হিন্দুজাতি অবলম্বনে বক্তব্য পরিবেশিত হয়েছে ।
নবীনচন্দ্র সেন : উনিশ শতকের মহাকাব্যের যাত্রায় নবীনচন্দ্র সেন (১৮৪৭-১৯০৯) হেমচন্দ্রের সমসাময়িক কবি । মাইকেল মধুসূদন দত্তের আদর্শ সম্মুখে রেখে তিনি মহাকাব্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। তবে তিনি মহাকাব্যের কাহিনি নির্বাচনে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য দেখিয়েছেন । মহাকাব্যের সুবিপুল কাহিনি নির্বাচন করে তিনি কাহিনিগত দিক থেকে সবচেয়ে বেশি বিশিষ্টতা অর্জন করেন । কবি নবীনচন্দ্র সেন বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি গীতিকবিতা , গাঁথাকাব্য ও মহাকাব্য – উনিশ শতকের রীতি অনুযায়ী এই তিন ধরনের কাব্য রচনা করেছিলেন । পাশ্চাত্য সাহিত্যাদর্শের প্রভাবে এদেশের সাহিত্যে যে নতুন হাওয়া প্রবাহিত হয় , নবীন সেন তা উপলব্ধি করে স্বীয় কাব্যধারায় তা পরিস্ফুটনে সচেষ্ট হন । অনিয়ন্ত্রিত কল্পনা এবং হৃদয়াবেগের প্রাচুর্য নিয়ে তিনি পুরাতন ভাবধারাকে নতুন রূপদানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন । সমসাময়িক যুগের যুগের আদর্শ তিনি বরণ করেন , তার নিদর্শন রেখেছেন জাতীয়তাবোধ নিয়ে রচিত তার মহাকাব্যে। নবীন সেনের মহাকাব্য ‘ রৈবতক ‘ (১৮৮৩) , ‘কুরুক্ষেত্র’ (১৮৯৩) ও ‘ প্রভাস (১৮৯৬) —এই তিনটি কাব্য ‘ত্রয়ীকাব্য’ নামে পরিচিত । তিনি মহাভারত, ভাগবত বিষ্ণু পুরাণ প্রভৃতি কৃষ্ণলীলাবিষয়ক গ্রন্থ থেকে উপকরণ নিয়ে তৎকালীন ভারতের সমাজ ও ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষ্ণচরিত্র অবলম্বনে চৌদ্দ বছরে এই মহাকাব্য রচনা করেন । কাব্য তিনখানির কাহিনিগত তাৎপর্যের দিক থেকে তা ‘উনবিংশ শতাব্দীর মহাভারত’ নামে অভিহিত ।
কায়কোবাদ : বাংলা মহাকাব্যের ধারায় কায়কোবাদ (১৮৫৮-১৯৫২) অন্যতম উল্লেখযোগ্য কবি । মুসলমানদের গৌরবময় ইতিহাসের কাহিনি অবলম্বনে ‘মহাশ্মশান’ নামে মহাকাব্য রচনা করে তিনি জাতীয় জীবনে উদ্দীপনা সৃষ্টির প্রয়াস পান । প্রকৃতপক্ষে জাতীয়তাবোধের কবি হিসেবেই বাঙালি মুসলমানদের কাছে তাঁর শ্রদ্ধার আসন । ‘মহাশ্মশান’ ১৯০৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়।সমগ্র কাব্যটি ৩ খন্ডে বিভক্ত।সমগ্র কাব্য প্রকাশের জন্য ১০ বছর সময় লেগেছিল।
উনিশ শতকের জাতীয়তাবোধে অনুপ্রাণিত হয়ে কায়কোবাদ জাতীয় উদ্দীপনামূলক মহাকাব্য রচনা করেছেন । এদিক থেকে তিনি হেম-নবীনের সমগোত্রের কবি । কিন্তু কায়কোবাদ সমকালীন কবিগণের মতো সাম্প্রদায়িক মনোভাবসম্পন্ন ছিলেন না । এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন হিন্দু কবিগণের বৈশিষ্ট্য থেকে ভিন্নতর প্রকৃতির অধিকারী । তাঁর কাব্যে স্বদেশ ও স্বজাতিপ্রীতি সমস্ত সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে উঠেছে — যা হিন্দু কবিগণের মধ্যে প্রত্যক্ষ করা যায় না ।
সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী : বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগে মুসলমানদের নবজাগরণে ইসলামি আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে যারা কাব্যরচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন সিরাজগঞ্জের কৰি সৈয়দ আবু মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ( ১৮৭৯-১৯৩১ ) তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ।
“সেবিবে সমগ্র বিশ্ব মোসলেম চরণ” – এই মূল উদ্দেশ্য কেন্দ্র করে বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী কবি সিরাজী জাতির সেবায় গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করেন । তাঁর বলিষ্ঠ লেখনীর প্রভাবে বাংলাদেশে মুসলমানদের মধ্যে নবজাগরণের সৃষ্টি হয় । ইসমাইল হোসেন সিরাজীর উদাত্ত আহ্বানে বাঙালি মুসলমানের জীবনে সাড়া জেগেছিল৷ সিরাজী ছিলেন স্বাধীনতার অক্লান্ত সৈনিক, ছিলেন মুসলিম পুনর্জাগরণের কবি। স্বজাতির জাগরণের জন্য ইসমাইল হোসেন সিরাজী যে বলিষ্ঠ বাণী প্রকাশ করেছিলেন তার পরিচয় মিলে ‘অনল প্রবাহ’ (১৮৯৯) নামক কাব্যগ্রন্থে। ‘অনল প্রবাহ’ কাব্যের অগ্নিবাণী ভাবের তীব্রতা ও ভাষার ওজস্বিতা -গুনে সমাজের সর্বত্র অভূতপূর্ব আলোড়নের সৃষ্টি করে। কাব্যটি যে কতদূর আবেদনশীল হয়েছিল তা উপলব্ধি করা যায় ইংরেজ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্তকরণ এর ঘটনা দ্বারা। ইসমাইল হোসেন সিরাজী ‘স্পেনবিজয় কাব্য’ (১৯১৪) নামে মহাকাব্যের রচয়িতা।
উপসংহার : উনিশ শতকে বাঙালির জাতীয় জীবনে যে নবচেতনার সৃষ্টি হয়েছিল তারই প্রতিফলন ঘটেছে বাংলা মহাকাব্য গুলোতে। জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করে জাতীয় জীবনে পরিবর্তন আনয়নের চেষ্টাই এর পশ্চাতে কার্যকর ছিল। পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাবে বাংলা সাহিত্যে এই বিশেষ শাখাটির সূত্রপাত এবং বিশেষভাবে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বেশ কিছুসংখ্যক মহাকাব্য রচিত হয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তাই বলা যায় যে, বাংলা সাহিত্যে প্রবন্ধের অবদান অপরিসীম।