বেঙ্গল গেজেট : ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ শে জানুয়ারি কলকাতা থেকে প্রকাশিত ভারতের প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র জেমস অগাস্টাস হিকি সম্পাদিত ‘বেঙ্গল গেজেট’ পত্রিকাটিতে মূলত বিজ্ঞাপন, বিদেশি ইংরেজি পত্রিকা থেকে উদ্ধৃতি , সংবাদদাতাদের বিবরণধর্মী লেখা ছাপা হতো । ‘পোয়েটস্ কর্নার’ বলে একটি বিশেষ অংশ ছিল । প্রকাশের প্রথম মাস দশেক কোন রাজনৈতিক বিষাদপূর্ণ লেখা প্রকাশিত হয় নি । পরে প্রশাসনের বিপক্ষে কিছু লেখা বের হলে ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ই নভেম্বর ফোর্ট উইলিয়াম থেকে এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে ডাকঘর মারফত পত্রিকা বিতরণ বন্ধ করা হয় । পরে হিকি মামলায় জড়িয়ে পড়েন । ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে হিকির ছাপাখানা আটক ও বিক্রি করে দেওয়া হলে ভারতবর্ষের প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্রের অপমৃত্যু ঘটে।
দিগদর্শন : ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে বাংলা মাসিকপত্র হিসেবে হুগলি জেলার শ্রীরাম পুর মিশনারিদের পক্ষ থেকে দিগদর্শন প্রকাশিত হয় । এর সম্পাদক ছিলেন জন ক্লার্ক মার্শম্যান । সংবাদ অপেক্ষা ধর্মীয় নীতিকথা ও শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তথ্য পরিবেশনই এখানে প্রাধান্য পেতো । ২৬ টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়ে এই পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়।দিগদর্শন সংবাদপত্র ছিল না , ছিল নীতি – ধর্ম তত্ত্বমূলক মাসিক সাময়িকপত্র।
সমাচার দর্পণ : ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে হুগলির শ্রীরাম পুর খ্রিষ্টান মিশনারিরা ‘সমাচার দর্পণ’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করে । পত্রিকাটি চলে ১৮৪০ পর্যন্ত । এর সম্পাদক ছিলেন জন ক্লার্ক মার্শম্যান । মার্শম্যান বিশেষ লিখতেন না, লিখতেন বাঙালি হিন্দু পণ্ডিতরা । এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জয়গোপাল তর্কালঙ্কার । সংবাদই এর প্রাণ ছিল । তবে ধর্ম বা তত্ত্ব আলোচনাও থাকত । এই পত্রিকা কোনো ধর্মীয় বিতর্কে না জড়িয়ে খ্রিষ্টান মতবাদের প্রতি পক্ষপাত দেখাত। সমাচার দর্পণের ভাষায় সারল্য , লেখায় তথ্যবোধ ও মাত্রাজ্ঞান লক্ষযোগ্য।
সম্বাদ প্রভাকর : ‘সম্বাদ প্রভাকর’ সাপ্তাহিক সংবাদপত্র হিসেবে ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ শে জানুয়ারি কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ছিলেন এর সম্পাদক , তাঁর সহকারী ছিলেন পাথুরিয়াঘাটার যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুর । পত্রিকাটির স্বভাব এমন স্বদেশি আন্দোলনের সমর্থক , পাশ্চাত্যমুখী বাবুকালচার বিরোধী, নারী স্বাধীনতার পক্ষে নয় । এ পত্রিকা বছর দেড়েক স্থায়ী ছিল । ১৮৩৬ ঈশ্বর গুপ্তের সম্পাদনাতেই পত্রিকাটি আবার প্রকাশিত হয় বারত্রয়িক ( অর্থাৎ প্রতি সপ্তাহে তিন দিন ) রূপে । এ পত্রিকাই ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ই জুন দৈনিক সংবাদপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে । সম্বাদ প্রভাকর ‘ বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম দৈনিক পত্রিকা হবার গৌরবমাল্য পায় । ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ শে জানুয়ারি ঈশ্বর গুপ্ত মারা গেলে তার সহোদর রামচন্দ্র গুপ্ত পত্রিকার সম্পাদনার ভার নেন।
সম্বাদ কৌমুদী : ভারতীয় জাতীয় জাগরণের লক্ষ্যে রামমোহন রায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতা থেকে ১৮২১ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ঠা ডিসেম্বরে ‘ সম্বাদ কৌমুদী ‘ প্রকাশিত হয় । এর সম্পাদক ছিলেন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রকাশক তারাচাঁদ দত্ত । সামাজিক হিন্দুধর্মীয় রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে উদার মনোভাব নিয়ে এ পত্রিকা লেখনী ধারণ করে । ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয় ।
তত্ত্ববোধিনী : তৎকালের উদার , বিজ্ঞানমনস্ক দেশসচেতন পত্রিকা বললে প্রথমেই আসে ‘ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার নাম । ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ই অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ তত্ত্ববোধিনী সভা ‘ নামে একটি প্রতিষ্ঠান । সাংস্কৃতিক জীবনকে জাতীয় ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং বাহ্যবস্তুর জিজ্ঞাসাকে মুখ্য করে এ প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে । রামমোহনের মৃত্যুর পর স্তিমিত হয়ে যাওয়া ব্রাহ্মসমাজকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় বেগবান করেন । এই পরিপ্রেক্ষিতে ব্রাহ্মসমাজের সভায় অনুপস্থিত সভ্যদের লক্ষ্য করে , আলোচিত বিষয় তাদের সম্মুখে উপস্থিত করার জন্য ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করা হয় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা। এ পত্রিকার সম্পাদক হন- অক্ষয়কুমার দত্ত । এখানেই প্রথম ‘ গ্রন্থাধ্যক্ষগণ ’ ( আজ যাকে সম্পাদকমণ্ডলী বলে ) নির্বাচিত হন এবং সম্পাদক নয় , গ্রন্থাধ্যক্ষগণের মনোনীত রচনাই প্রকাশ করা হয় । দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক লেখা সে কারণে এ পত্রিকায় প্রকাশিত হতে পারে নি । অসুস্থতার জন্য সম্পাদক পদ থেকে অক্ষয়কুমার অবসর নিলে ( ১৮৫৫ ) পত্রিকার সম্পাদক হন ঈশ্বরচন্দ্র।