বিশ শতকের পত্র পত্রিকা : সমাজ সংস্কৃতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে এমন বিশ শতকের পত্র পত্রিকা গুলো হলো : ‘সবুজ পত্র’, ‘প্রবাসী ও ভারতবর্ষ’, ‘কল্লোল’, কালিকলম, ‘মোসলেম ভারত’, ‘ধূমকেতু’, ‘শিখা’, প্রভৃতি।
সবুজ পত্র : প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজ পত্র’ বিশ শতকের বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিহাসে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য । ১৯১৪ সালে সবুজ পত্রের প্রথম প্রকাশ ঘটে । সবুজ পত্র প্রকাশকালে সম্পাদকের উদ্দেশ্য ছিল , আমাদের বাংলা সাহিত্যের ভোরের পাখিরা যদি আমাদের প্রতিষ্ঠিত সবুজ পত্র মণ্ডিত সাহিত্যের নব শাখার ওপর এসে অবতীর্ণ হন , তাহলে আমরা বাঙালি জাতির সবচেয়ে যে বড় অভাব , তা কতকটা দূর করতে পারব? সে অভাব হচ্ছে আমাদের মনের ও চরিত্রের অভাব যে কতটা , তারি জ্ঞান । একটা নতুন কিছু করবার জন্য নয় , বাঙালির জীবনে যে নতুনত্ব এসে পড়েছে , তাই পরিষ্কার করে প্রকাশ করবার জন্য সবুজ পত্রের প্রতিষ্ঠা।
প্রবাসী ও ভারতবর্ষ : এই সময়কার অন্য দুটি উল্লেখযোগ্য পত্রিকা ‘প্রবাসী ‘ (১৯০১) ও ‘ভারতবর্ষ’ (১৯১৩) ছিল গণসেব্য পত্রিকা— নানা রকমের পাঠকের বিচিত্র চাহিদা মেটানোর প্রয়াসে তাদের আয়তন বিপুল , সূচি বিচিত্র , আদর্শ পাঁচমিশালী , সাধনা প্রসারমুখী , সিদ্ধি অর্থঘটিত । প্রবাসীর সম্পাদক ছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় । রবীন্দ্রনাথের অজস্র রচনা এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল৷ শরঙ্কন্দ্রের আত্মপ্রকাশে এই পত্রিকার অবদান গুরুত্বপূর্ণ ।
কল্লোল : ‘কল্লোল’ সমগ্র বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বিশিষ্ট পত্রিকা । দীনেশরঞ্জন দাসের সম্পাদনায় কলকাতা থেকে এই মাসিক সাহিত্য পত্রিকাটি অতি আধুনিক লেখকগোষ্ঠীর মুখপত্র হিসেবে ১৯২৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় । তৎকালীন তরুণ লেখক রবীন্দ্র বিরোধিতার নাম করে এখানে সমবেত হয়েছিলেন। কল্লোল প্রায় সাত বছর চলেছিল , কিন্তু এই অল্প সময়েই একটা প্রগতিশীল লেখকগোষ্ঠীর সমাবেশ ঘটাতে পেরেছিল । অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তার “কল্লোল যুগ” গ্রন্থে এই সময়কার সাহিত্যচক্রের উপাদেয় বর্ণনা দিয়েছেন । অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত , মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় , প্রেমেন্দ্র মিত্র , বুদ্ধদেব বসু , কাজী নজরুল ইসলাম , মোহিতলাল মজুমদার প্রমুখ অনেকেই কল্লোলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়েছিলেন৷ এই লেখকেরা তৎকালীন ইউরোপীয় আদর্শে বাস্তব জীবন, মনস্তত্ত্বের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ এবং রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিষয়কে তাদের রচনার উপজীব্য করলেন । যা বিশ শতকের সমাজ সংস্কৃতির উন্নয়নে অপরিসীম ভুমিকা পালন করেছিল।
কালিকলম : কল্লোলের আদর্শে কলকাতা থেকে ১৯২৬ সালে ‘কালিকলম’ এবং ঢাকা থেকে ১৯২৭ সালে ‘প্রগতি’ সাহিত্য পত্র প্রকাশিত হয়েছিল । রবীন্দ্র প্রভাব থেকে দূরে থেকে বাস্তবতাপ্রধান সাহিত্যসৃষ্টির দিকে এসব পত্রিকার লেখকদের প্রধান লক্ষ্য ছিল । নতুন ভাষারীতি , রচনারীতি ও সাহিত্যাদর্শ সৃষ্টিতে সাময়িক পত্রের অবদান চিরদিন স্বীকৃতি লাভ করেছে। সমাজ সংস্কৃতির উন্নয়নেও এই পত্রিকার অবদান অনস্বীকার্য।
মোসলেম ভারত : ‘মোসলেম ভারত’ ১৯২০ সালে কলকাতা থেকে মোজাম্মেল হকের সম্পাদনায় মাসিক সাহিত্যপত্র হিসেবে প্রথম প্রকাশিত হয় । বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিখ্যাতি লাভের পশ্চাতে এই পত্রিকার বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল । সমকালীন খ্যাতিমান কবি সাহিত্যিকগণের রচনা এতে প্রকাশিত হত ।
ধূমকেতু : ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা অর্ধ সাপ্তাহিক হিসেবে ১৯২২ সালে কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় । ধূমকেতুর উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছিল : ‘ … এ দেশের নাড়ীতে নাড়ীতে অস্থি – মজ্জায় যে পচন ধরেছে তাতে এর একেবারে ধ্বংস না হলে নতুন জাত গড়ে উঠবে না।… দেশের যারা শত্রু , দেশের যা কিছু মিথ্যা , ভণ্ডামী , মেকি তা সব দূর করতে ‘ধূমকেতু’ হবে আগুনের সম্মার্জনী । পত্রিকাটির জন্য ‘আশীর্বাণী’ পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় , বারীণ ঘোষ প্রমুখ অনেকে । কবিগুরুর আশীর্বাণীটি ছিল এ রকম :
আয় চলে আয় , রে ধূমকেতু,
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় – কেতন ।
সে যুগের উত্তাপ উত্তেজনা ধূমকেতুতে প্রতিফলিত হয়েছিল বলে পত্রিকাটি আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে সকলের হৃদয় জয় করে নিয়েছিল । এর জ্বালাময়ী সংবাদ ও সম্পাদকীয় প্রবন্ধাবলী একদিকে যেমন জনগণের মধ্যে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল , অন্যদিকে তেমনি তকালীন ইংরেজ শাসকের রোষের কারণ হয়ে দাঁড়ায় । এই পত্রিকায় রাজদ্রোহমূলক কবিতা প্রকাশের জন্য কবি কাজী নজরুল ইসলাম এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন । নজরুল ইসলামের নিজস্ব অবদানের জন্য সে যুগে ধূমকেতু ছিল একটি অনন্য পত্রিকা ।
শিখা : ‘শিখা’ ঢাকার মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র হিসেবে ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয় । সম্পাদক ছিলেন আবুল হোসেন । ঢাকার সাহিত্যিক গোষ্ঠী ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের সূত্রপাত করেন । ‘শিখা’ ছিল বার্ষিক পত্র । পর পর পাঁচ বছর পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল । শিখার প্রধান উদ্দেশ্য বর্তমান মুসলমান সমাজের জীবন ও চিন্তাধারার গতির পরিবর্তনসাধন। পত্রিকার পরিচালকেরা মনে করতেন , ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ , বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট , মুক্তি সেখানে অসম্ভব’। শিখার রচনাবলীতে এই আদর্শ প্রতিফলিত হয়েছিল বলে পত্রিকাটি সে আমলে বিশেষ সাড়া জাগিয়েছিল।